গরুর জাবর কাটা এবং জর্জ গ্যামো

গরু যে একটা গৃহপালিত প্রাণী—সে কথা সবারই মুখস্থ। স্কুলে ‘গরুর রচনা’ পড়তে গিয়ে এই চতুষ্পদী প্রাণীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রায় সব কিছুই আমাদের জানা। কিন্তু জানেন কি, গরু কীভাবে জাবর কাটে? ঘড়ির কাঁটার দিকে নাকি, ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে? এরকম উদ্ভট বিষয় নিয়ে কারো আগ্রহ থাকার কথা নয়। মজার ব্যাপার হলো, এরকম একটা বিষয় নিয়ে এককালে গবেষণা করেছিলেন নামকরা তিন পদার্থবিদ। এমনকি নামকরা জার্নালে এ সম্পর্কে গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছিল।

এরকম একটা বিষয় নিয়ে গবেষণাকে অর্থহীন এবং স্রেফ খামখেয়ালিপনা বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত গবেষকদের নাম শুনলে চমকে যাবেন। সেই গবেষকরা হলেন প্যাসকেল জর্ডান, রাফল ক্রোনিগ এবং জর্জ গ্যামো।

১৯২৭ সালের ঘটনা। জার্মান পদার্থবিদ প্যাসকেল জর্ডান এবং রাফল ক্রোনিগ তখন বয়সে তরুণ। দুজনের বয়স প্রায় চব্বিশ-পঁচিশের কোঠায়। অচিরেই কোয়ান্টাম মেকানিকসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান রাখবেন এই দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু তার আগে হুট করে তাঁদের আগ্রহ জাগল গরু নিয়ে। আরও সঠিকভাবে বললে, গরুর জাবর কাটা নিয়ে।

তাঁদের মনে একগাদা প্রশ্ন: গরু কি জাবর কাটার সময় তার চোয়াল আনুভূমিকভাবে নড়াচড়া করে, নাকি উল্লম্বভাবে? নাকি একইসঙ্গে উভয়দিকে? এ সময় চোয়ালটা কি বৃত্তাকারে ঘোরে? আর চোয়াল যদি ঘোরেই, তাহলে সেটা কি ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে, নাকি বিপরীতে? পুরো পদ্ধতিটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন তাঁরা। একেবারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞান জগতে গ্যামো ছিলেন রসিক ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ গুণের কারণে অনেকের কাছে তিনি ভাঁড় হিসেবেও পরিচিত। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বিগ ব্যাং তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং একে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যার পেছনে তাঁর ভূমিকার কথা সবার জানা।

সব পর্যবেক্ষণ শেষে তথ্য-উপাত্ত জড়ো করলেন। তারপর লিখে ফেললেন একটা আস্ত বৈজ্ঞানিক পেপার। সেটার শিরোনাম ছিল: মুভমেন্ট অব দ্য লোয়ার জ অব ক্যাটল ডিউরিং ম্যাস্টিকেশন। সোজা বাংলায় বললে, জাবর কাটার সময় গবাদি পশুর নিচের চোয়ালের নড়াচড়া।

এ পর্যন্ত না হয় ঠিক ছিল, কিন্তু এরকম একটা পেপার কি জার্নালে ছাপার কথাও ভাবা যায়? সেটাও ভাবলেন প্যাসকেল এবং ক্রোনিগ। অচিরেই সেটা পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার-এ।

প্যাসকেল এবং ক্রোনিগ দুজনেই ছিলেন সে কালের ডাকসাইটে বিজ্ঞানী নীলস বোরের ছাত্র। দুজনেই তখন কোপেনহেগেনে নীলস বোরের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কাজ করছেন। সেই ভয়েই কি না কে জানে, পেপারটা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিল নেচার জার্নাল কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন পর সেটা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিতও হলো। সেই পেপারের সারকথা হলো: জাবর কাটার সময় গরুর চোয়ালের ঘূর্ণন ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকের চেয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে কিছুটা বেশি দেখা যায়।

পদার্থবিদ জর্জ গ্যামো

সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমান রাশিয়া) বসে মজার সেই পেপারটা পড়লেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জর্জ গ্যামো। শুরুতেই মন খুলে একচোট হেসে নিলেন এই পদার্থবিদ। তার পরপরই তাঁর মধ্যেও একটা রসিকতা করার ইচ্ছা জেগে উঠল। সেটা করলেন বৈজ্ঞানিকভাবে।

বিজ্ঞান জগতে গ্যামো ছিলেন রসিক ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ গুণের কারণে অনেকের কাছে তিনি ভাঁড় হিসেবেও পরিচিত। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বিগ ব্যাং তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং একে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যার পেছনে তাঁর ভূমিকার কথা সবার জানা। এমনকি বিগ ব্যাংয়ের প্রমাণ হিসেবে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা পটভূমি বিকিরণের ভবিষ্যদ্বাণীই তিনিই প্রথম করেছিলেন। এ ছাড়া বিগ ব্যাংয়ের সময় আদিম মহাবিশ্বে নিউক্লিওসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম মৌল তৈরির ব্যাখ্যাও দেন তিনি। এর বাইরেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে বিজ্ঞানবিষয়ক বেশকিছু বই লিখেছেন। এর মধ্যে মিস্টার টমকিন্স সিরিজের বইগুলো পাঠকদের কাছে এখনো জনপ্রিয়।

আরও পড়ুন
১৯২৭ সালের ঘটনা। জার্মান পদার্থবিদ প্যাসকেল জর্ডান এবং রাফল ক্রোনিগ তখন বয়সে তরুণ। দুজনের বয়স প্রায় চব্বিশ-পঁচিশের কোঠায়। অচিরেই কোয়ান্টাম মেকানিকসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান রাখবেন এই দুই বিজ্ঞানী।

যা-ই হোক, প্যাসকেল এবং ক্রোনিগের গরুবিষয়ক পেপারটা পড়ে রসিকতার ছলেই হয়তো একে কেন্দ্র করে নিজেও একটা পেপার লিখে ফেললেন তিনি। সেটা পাঠিয়ে দিলেন নেচার জার্নালে। কিন্তু কে জানে কেন—জার্নাল কর্তৃপক্ষ সেটা গুরুত্ব দিল না। তাঁর পেপারটা বাতিল করে দেওয়া হলো। পরে নিজের বন্ধুদের ওই বিষয়ে তাঁর গবেষণা নিয়ে বলেছেন গ্যামো। তিনি বলেন, ডেনমার্কে গিয়ে গরুদের জাবর কাটার ধরন পর্যবেক্ষণ করেছেন। সে দেশে জাবর কাটার সময় গরুর চোয়াল ঘোরে ডানদিকে। এরপর ব্রাজিলেও ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। সেখানে গরুর চোয়াল ঘোরে বাঁদিকে। কিন্তু সেটা কেন ঘটে?

এর উত্তরে গ্যামো রসিকতা করে বন্ধুদের বলেছিলেন, পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে তৈরি হওয়া কেরিওলিস বলের কারণে এমনটি ঘটে। বলে রাখা ভালো, কেরিওলিস বল হলো পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে সৃষ্ট একটি আপাত বল। এ বলের কারণে বড় আকারের গতিশীল বস্তুর (যেমন বায়ুপ্রবাহ বা সমুদ্রের স্রোত) গতিপথকে প্রভাবিত হয়। যেমন পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাস পরস্পরের বিপরীত দিকে ঘোরে। গ্যামোও তাই মজা করে বোঝাতে চেয়েছিলেন, গরুর চোয়ালের ঘূর্ণনও গোলার্ধভেদে ভিন্ন হবে!

পরের বার আপনি যদি কোনো গরুর মুখোমুখি হন, গ্যামোর কথা সত্য কি না, তা পরখ করে দেখবেন। পদার্থবিদ প্যাসকেল আর ক্রোনিগের গবেষণার ফলাফলটাও মিলিয়ে দেখতে ভুলবেন না কিন্তু!

সূত্র: আই নেভার কল ইট বিগ ব্যাং/ অ্যালেসস্যান্দ্রো বোত্তিনো এবং ক্রিস্টিনা ফ্যাভেরো

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন