অধ্যাপক জামাল নজরুল ও তাঁর বিজ্ঞানী-জীবন

বরেণ্য অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের (১৯৩৯-২০১৩) জীবনী নিয়ে ইতোপূর্বে শরীফ ছিদ্দিকীর ‘বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম’ (অনুপম প্রকাশনী, ২০২৪) বইটি পাঠকের নজর কেড়েছে। তবে ২০২৫ সালে প্রকাশিত প্রথমা প্রকাশনীর ‘জামাল স্যারের মহাবিশ্ব’ বইটি অধ্যাপক জামাল নজরুলের পূর্ণাঙ্গ জীবনীর একটি বড় মাইলফলক অর্জন করেছে তা বলা যায়। প্রথিতযশা এবং অতিপ্রজ বিজ্ঞান-লেখক শ্রীযুক্ত প্রদীপ দেব অধ্যাপক জামাল নজরুলের একটি ‘বৈজ্ঞানিক জীবনী’ রচনা করতে পেরে কৃতজ্ঞ হয়েছেন এ কারণে যে স্নাতকোত্তর গবেষণাকালে তিনি তাঁর সাথে প্রত্যক্ষ সংলাপে অংশ নিতে পেরেছিলেন, যা লেখকের জীবনে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি নিঃসন্দেহে।

বর্তমান বইটিতে লেখক অনেক পরিশ্রম করে অধ্যাপক জামাল নজরুলের সকল বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার ঠিকুজি সংগ্রহ করেছেন, প্রতিটি পেপারের বিষয়বস্তু অথবা সারসংক্ষেপ পেশ করেছেন, সহ-লেখকদের সংক্ষিপ্ত কর্মকাণ্ড এবং তাঁদের সঙ্গে অধ্যাপক জামাল নজরুলের সম্ভাব্য মিথস্ক্রিয়ার ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে আমরা অধ্যাপক জামাল নজরুলের প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু সম্পর্কে, আন্তর্জাতিক গবেষকদের সাথে তাঁর মিথস্ক্রিয়া সম্বন্ধে, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তাঁর বিচরণ সম্বন্ধে বিশদ জানতে পারি।

অধ্যাপক জামাল নজরুলের প্রায় সকল সহ-লেখক বা বন্ধুরা বিভিন্ন দিকপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমান্বয়ে থিতু হচ্ছেন, অথচ তিনি অতলান্তিকের দুধারে তখনো অনিকেত উন্মূলিত পোস্টডকটরাল হিসেবে এপার-ওপার করছেন।

বিলাতের কেমব্রিজে পড়াশোনা শেষে বিলাত ও আমেরিকার বিবিধ প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক জামাল নজরুলের আনাগোনা ছিল। তিনি বহু বিখ্যাত গবেষকের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু কোথাও থিতু হননি। সিটি ইউনিভার্সিটিতে রিডার-শিপ ত্যাগ করে তিনি ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। এখানেই শেষতক থিতু হন, বাংলার দামাল ছেলে জামাল!

আরও পড়ুন

কেন তিনি বাংলাতেই থিতু হলেন, চট্টগ্রামের নির্জন সার্শন পাহাড়ের ‘সাবজা যার’ তাঁর নিভৃতের উপাসনালয় হয়ে উথল এই প্রসঙ্গটা এই বইতে তেমন নেই। এই রহস্যটা অধ্যাপক জামাল নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকেও খোলাসা হয়নি। এই বইতে আমরা দেখছি, অধ্যাপক জামাল নজরুলের প্রায় সকল সহ-লেখক বা বন্ধুরা বিভিন্ন দিকপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমান্বয়ে থিতু হচ্ছেন, অথচ তিনি অতলান্তিকের দুধারে তখনো অনিকেত উন্মূলিত পোস্টডকটরাল হিসেবে এপার-ওপার করছেন। এর ব্যাখ্যায় অধ্যাপক আরশাদ মোমেন বলেছিলেন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, যেহেতু ফ্রেড হয়েল এবং ‘স্টেডি-স্টেট থিওরি’র তখন পতিতদশা, সেহেতু হয়েলের কোর গ্রুপের সদস্যরাও ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে উঠছেন। সদ্য-প্রয়াত জয়ন্ত নারলিকার ভারতে ফিরে এসে ‘আয়োকা’ গঠন করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক জামাল নজরুলও ফিরে এলেন। 

অধ্যাপক জামাল নজরুলের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল গণিত, তার প্রায়োগিক দিক, বিশেষ করে সৃষ্টিতত্ত্ব বা কসমোলজিতে তার প্রয়োগ। ফলিত গণিতের নানা বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। বিশেষ করে, আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের নানা বিষয় নিয়ে তিনি গণিতের প্রয়োগ নিয়ে, নানা সমাধান-প্রণালি নিয়ে, প্রোটনের স্থায়িত্ব নিয়ে, অর্থনীতির সমস্যা নিয়ে তিনি মাথা ঘামিয়েছেন।

তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, একটি বাদে সবকটিই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটির নাম ‘দ্য আলটিমেট ফেইট অফ দ্য ইউনিভার্স’, বইটির বাংলা অনুবাদ হয়েছে, অন্তত একাধিক। আলোচ্য বইটির অধ্যায় নয় এই গ্রন্থের নানা ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে।

এই বইটির একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল অধ্যায় ছয়। মুক্তিসংগ্রামে অধ্যাপক জামাল নজরুলের ভূমিকা, তাঁর বিরল কিছু চিঠিপত্র, যা তিনি রাষ্ট্রনায়কদের লিখেছিলেন, এইসব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এটি।

অধ্যাপক জামাল নজরুলের সবচেয়ে উপযোগী গ্রন্থ হল ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশোন টু ম্যাথমেটিকাল কসমোলজি’ যার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রদীপ দেব জানিয়েছেন, ‘পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজির শিক্ষার্থীডের জন্য এই বইটি প্রধান বইয়ে পরিণত হয়েছে’। একথা কতটুকু সত্য তা আমি জানি না, তবে বইটি খুললেই ‘চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির’ নামটি যখন জ্বলজ্বল করে ওঠে, একটি আন্তর্জাতিক মানের বইয়ের লেখকের পরিচিতিতে, তখন সেটা বাঙালি হিসেব আত্মশ্লাঘার বিষয় তো বটেই।

আরও পড়ুন

একনজরে

জামাল স্যারের মহাবিশ্ব

প্রদীপ দেব

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রথম প্রকাশক: ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

পৃষ্ঠা: ১৪৩

দাম: ৩৮০ টাকা

এই বইটির একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল অধ্যায় ছয়। মুক্তিসংগ্রামে অধ্যাপক জামাল নজরুলের ভূমিকা, তাঁর বিরল কিছু চিঠিপত্র, যা তিনি রাষ্ট্রনায়কদের লিখেছিলেন, এইসব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এটি।

অধ্যাপক জামাল নজরুলের মূল খ্যাতি আসে ম্যান্ডেলস্টাম রিপ্রেজেন্টেশোন নিয়ে তাঁর করা গাণিতিক গবেষণা, এবং কসমোলজির বিভিন্ন গাণিতিক সম্ভাবনা, সূত্র নির্ধারণ, আইনস্টাইনের সমীকরণের বিবিধ বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্য সমাধান, ইত্যাদি। এইসব কাজের ধারাবাহিক ফল হল গাণিতিক কসমোলজি নিয়ে তাঁর বইটি। তিনি আরেকটি কারণেও বিখ্যাত - মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে তাঁর নিবেদিত গাণিতিক গবেষণা এবং তৎসংক্রান্ত তাঁর সুবিখ্যাত পপুলার গ্রন্থ ‘আলটিমেট ফেইট’। অবশ্য মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে বিশেষ কাজ করেছেন ফ্রিম্যান ডাইসন এবং আরও অনেকে। কিন্তু আশির দশকে এই বিষয়ে অধ্যাপক জামাল নজরুলের বইটি ছিল সবচেয়ে প্রামাণ্য এবং একইসাথে পাঠযোগ্য।

প্রয়াত অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ বলেছিলেন, আমরা ভেবেছিলাম প্রফেসর জামাল আর আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শক্তিশালী কসমোলজি গ্রুপ করব, সেটা হলো না, তিনি চট্টগ্রামেই থেকে গেলেন।

প্রদীপ দেবের বইটি অধ্যাপক জামাল নজরুলের জীবন নিয়ে, তাঁর ধারাবাহিক বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে, তাঁর প্রকাশনার তালিকা (৭টি গ্রন্থ, ৫৯টি পেপার), তাঁর বৈদেশিক জীবন, তাঁর পরিবার-পরিচিতি ইত্যাদি উঠে এসেছে। লেখক অনেক শ্রমসাধ্য কাজ করেছেন, এবং আমাদের প্রভূত উপকার করেছেন অধ্যাপক জামাল নজরুলের জীবন তুলে ধরতে। লেখকের মতে অধ্যাপক জামাল নজরুলের দুটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—উদাসীনতা ও জেদ—তাঁকে কিছুটা নিঃসঙ্গ করে রেখেছিল। আমি লেখকের সঙ্গে একমত, তিনি যখন ঢাকায় বক্তৃতা দিতে আসতেন, প্রায় সবগুলোই আমি নিজে অংশ নেবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু অধ্যাপক জামাল নজরুলকে আমরা নিভৃতে কখনো পাইনি। প্রয়াত অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ বলেছিলেন, আমরা ভেবেছিলাম প্রফেসর জামাল আর আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শক্তিশালী কসমোলজি গ্রুপ করব, সেটা হলো না, তিনি চট্টগ্রামেই থেকে গেলেন। অধ্যাপক জামাল নজরুল উদাসীন না হলে কসমোলজির আরও কিছু বই—বাংলায় ও ইংরেজিতে—আমরা পেতাম।

আমরা প্রত্যাশা করি, প্রদীপ দেবের হাত ধরে নতুন কোনো গবেষক অধ্যাপক জামাল নজরুলের পূর্ণাঙ্গ মানবিক পরিচয় ফুঁটিয়ে তুলবেন। আলোচ্য বইটির নামকরণ নিয়ে আমার কিছুটা দ্বিধা আছে, যদিও। একজন বিজ্ঞানীকে তাঁর পেপার দিয়ে, কাজ দিয়ে চিনতে হয়। তবু মানুষ হিসেবে তিনি কেমন সেটাও জানা দরকার, তাঁর প্রস্তুতিপর্ব, তাঁর প্রিয় বই ও ব্যক্তিত্ব এগুলিও জানা দরকার। দুঃখের বিষয়, অধ্যাপক জামাল নজরুলের বাংলা বই ‘কৃষ্ণবিবর’ বাংলা একাডেমি থেকে পুনর্বার রিপ্রিন্ট হলেও তাঁর অন্য বাংলা বই দুটি আর পাওয়া যায় না। অধ্যাপক জামাল নজরুলের সামগ্রিক লেখালেখি নিয়ে একটি রচনাবলি থাকা প্রয়োজন। 

আরও পড়ুন