ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে দেখা পাই বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবতার এক অমর ভাষ্য

সম্প্রতি হাতে আসে প্রথমা প্রকাশনের শেখ আবদুল হাকিম অনুদিত শিশু-কিশোর সাহিত্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। দুই দিনে পড়া শেষ করি ক্লাসিক এই বই। ভাবতে থাকি, মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেই ১৮১৮ সালে প্রকাশিত বই, অথচ দুই শ বছর পরেও বইটি টাটকা গল্প মনে হয়। অফিসের কাজের ফাঁকে, মেট্রো রেলে মিরপুর-কারওয়ান বাজারে যেতে যেতে বইটি শেষ করি। চারপাশে মানুষের কোলাহল, আর আমি তখন বইটি হাতে নিয়ে—মনে হচ্ছিল মেরু অঞ্চলে কাঠের কোন জাহাজে দুলুনি খাচ্ছি। বইয়ের পাতা থেকে সজাগ হলে দেখি মেট্রোরেলের দুলুনি।

প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সাহিত্য, হরর ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জগতে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এক দিক থেকে ভৌতিক কল্পগল্প বলা যায়। বিজ্ঞান, নৈতিকতার মধ্যে মানুষের সাধারণ আবেগের জটিল সম্পর্কের অন্যরকম ভাষ্য দেখা যায়।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের প্রেক্ষিতে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামক এক তরুণ ও উচ্চাভিলাষী বিজ্ঞানীর গল্প দেখতে পাই। শেখ আবদুল হাকিম অনুদিত বইয়ের শুরুতে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আর আর্কটিক অভিযাত্রী রবার্ট ওয়ালটনের মধ্যে পরিচয় দেখতে পাই। ভিক্টরের মধ্যে মানুষের জীবনের রহস্য ভেদ করার অনুপ্রেরণা শুরুতেই তার নিজের কথা বুঝতে পারি।

আরও পড়ুন

ভিক্টরের প্রাথমিক আগ্রহ ছিল অ্যালকেমির রহস্যময় জগত নিয়ে। তরুণ ভিক্টর মৃতকে জীবিত করার গোপন রহস্য আবিষ্কারের জন্য বদ্ধপরিকর। দারুণ কিছু করার লক্ষ্যে রসায়ন ও শারীরবিদ্যা অধ্যয়ন করে নতুন কিছু তৈরির অনুসন্ধান করে সে। বহু বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এক সময় সে মৃত দেহের অংশ জোড়া লাগিয়ে এক বিশাল ও বীভৎস প্রাণী সৃষ্টি করে। যদিও এক পর্যায়ে নিজের সৃষ্টির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আতঙ্কিত ও অনুতপ্ত হয় ভিক্টর।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসটি প্রকাশের পর থেকে সাহিত্য, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বড় প্রভাব দেখা যায়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রাথমিক সময়কার গল্প হিসেবে শেলির লেখা দারুণ।

সেই দৈত্য ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিগৃহীত হয়ে এক করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। নিজের সৃষ্টিকর্তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয় দৈত্য। অদ্ভুত প্রাণীর ভয়ানক হয়ে ওঠার প্রেক্ষিত শেষ দিকে আমরা জানতে পারি। পুরো গল্পে টানটান উত্তেজনা আছে। কেউ না বলে দিলে বোঝা যাবে না গল্পের পটভূমি আজ থেকে প্রায় দুই শ বছর আগের।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশের সময়কালে জীববিজ্ঞানের অগ্রগতি ও বিজ্ঞানের নৈতিক দিক নিয়ে তখনকার সমাজে নানা বিতর্ক ছিল। শেলি তাঁর উপন্যাসে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ধারণাকে স্পর্শ করেছেন। বিজ্ঞানীর দায়িত্ব ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। গল্পের মূলে জীবনকে জানা ও মৃতকে জীবিত করার কথা থাকলেও মানুষের প্রজ্ঞাই যে সবচেয়ে শক্তিশালী, তা গল্পের বিভিন্ন মোড়ে দেখা যাবে। বিজ্ঞানের ইতিহাস দেখলে সেই সময়কার অনেক তথ্য আমাদের চমকে দেয়। শেলি যেসব কথা লিখেছেন সেই সময় ১৭৮৬ সালে লুইগি গ্যালভানির বিদ্যুতের মাধ্যমে ব্যাঙের পেশী সঞ্চালনের পরীক্ষা করেন। ইতিহাস বলছে, সেই পরীক্ষা মেরি শেলির লেখায় প্রভাব তৈরি করে।

আরও পড়ুন

একনজরে

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন

শেখ আবদুল হাকিম

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রথম প্রকাশক: জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৬

প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

দাম: ১৭৫ টাকা

মেরির লেখায় আমরা দেখতে পাই, ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার সৃষ্টিকে জীবিত করার পর তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। সমাজের ভয়ে ও বীভৎস সৃষ্টিকে দেখে সে পালিয়ে যায়। এই পালিয়ে যাওয়া যে শেষ সমাধান নয়, তা আমি বুঝতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের করিডোরে ক্লাসের ফাঁকে বইটি পড়ার সময়। ভিক্টর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে মৃতকে জীবন দান করেন। শেলির লেখায় দেখা যায়, বিজ্ঞান বা প্রকৃতির সীমা লঙ্ঘনে যতটা খারাপ বৈজ্ঞানিক ও ভয়াবহ পরিণতি হয়, তার চেয়ে মনস্তাত্বিক সংকট বেশি দেখা যায়। আমরা ভিক্টরের স্বজন হারানোর বেদনা দেখতে পাই। ছোট ভাই থেকে শুরু করে নিজের প্রিয় বন্ধুকে হারানোর যন্ত্রণা মানসিকভাবে ভেঙে দেয় ভিক্টরকে।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশের সময়কালে জীববিজ্ঞানের অগ্রগতি ও বিজ্ঞানের নৈতিক দিক নিয়ে তখনকার সমাজে নানা বিতর্ক ছিল। শেলি তাঁর উপন্যাসে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ধারণাকে স্পর্শ করেছেন।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসটি প্রকাশের পর থেকে সাহিত্য, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বড় প্রভাব দেখা যায়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রাথমিক সময়কার গল্প হিসেবে শেলির লেখা দারুণ। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন রচনার দু শ বছর পরে আজও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা দেখা যায়। জিন প্রকৌশল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য বিতর্কিত বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভিক্টরের নৈতিক দ্বিধা ও তার সৃষ্টির পরিণতি অনেক প্রশ্ন তৈরি করছে।

উচ্চাভিলাষী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মেধাবী বিজ্ঞানী। প্রকৃতির নিয়ম ভাঙতে চেয়েছিলেন ভিক্টর। দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই ভিক্টরের জীবনের প্রধান ট্র্যাজেডির মূল কারণ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভিক্টর নিজের পরিবার ও সম্পর্ক নিয়ে বেশ সচেতন বলা যায়। তার ভাই, প্রেমিকা কিংবা বন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা আমরা গল্পে দেখতে পাই।

আরও পড়ুন

মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রেক্ষাপটে এই সময়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নৈতিক অবস্থান নিয়ে আমরা আলাপ করতে পারি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যেমন নিজের সৃষ্টি করা জীবের পরিণতি সম্পর্কে একটা পর্যায় পর্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিলেন। বর্তমান সময়কার এআই নিয়ে নানা আবিষ্কার দেখছি আমরা, সেই সব আবিষ্কারের ব্যবহার নিয়ে ইলন মাস্ক বা স্যাম ওয়ালটনের মধ্যে উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না তো?

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য অনেকগুলো মৃত্যুর কারণ। এআইয়ের নেতিবাচক প্রভাবের কথা জানা যায়। ডেটা সেটের ত্রুটির কারণে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত দেয় এআই। সমাজে নতুন করে বৈষম্য ও অবিচারের জন্ম দিতে পারে বলে অভিযোগ উঠছে। গল্পের শেষে ভিক্টর মারা যায়। মৃত্যুর সময় নিজের তৈরি দৈত্যকে ধ্বংস করতে না পারার আক্ষেপ থাকে ভিক্টরের। তার মৃত্যুর পরে দৈত্য জাহাজে আসে, মৃত ভিক্টরকে দেখে নিজেই চমকে যায় সে। দৈত্যের সেই যান্ত্রিক দুঃখবোধ শেষমেষ অনেক প্রশ্ন তৈরি করবে আপনার মনের মধ্যে। প্রশ্ন তৈরি করতে চাইলে চোখ রাখুন শেলির লেখায়।

আরও পড়ুন