নিউটন যা পড়তেন, তার সবই মনে রাখতেন কীভাবে
স্যার আইজ্যাক নিউটন কেন এত বিখ্যাত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সবার আগে মাথায় আসে সেই আপেল পড়ার গল্প।
অনেকেই ভাবেন, আপেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিউটন ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। বরং ঘটনাটি তাঁর মনে একটা চিন্তার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল—আপেলটা কেন নিচেই পড়ল? মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে নিউটন বিস্তারিত ধারণা দেন এই ঘটনার ২১ বছর পর, ১৬৮৭ সালে। তখন প্রকাশিত হয় তাঁর যুগান্তকারী বই দ্য প্রিন্সিপিয়া: ম্যাথমেটিক্যাল প্রিন্সিপালস অব ন্যাচারাল ফিলোসফি।
কথিত আছে, একবার নিউটনের গবেষণাগারে মোমবাতির আগুনে তাঁর অনেক পাণ্ডুলিপি ও গবেষণাপত্র পুড়ে গিয়েছিল। তখন সবাই হায়! হায়! করলেও নিউটন নাকি ছিলেন খুবই শান্ত। তিনি মোটেও বিচলিত হননি। কারণ, বইগুলোতে যা লেখা ছিল, তার সবই নাকি তাঁর মাথায় ছিল! কিংবদন্তি আছে, নিউটন যা-ই পড়তেন, তার প্রায় সবই মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু কীভাবে? সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটির একটি পোস্ট থেকে জানা গেছে নিউটনের বই পড়ার সেই গোপন কৌশলের কথা।
রয়্যাল সোসাইটির সংগ্রহে নিউটনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির চারটি বই রয়েছে। সেগুলো হলো—স্যামুয়েল ফস্টারের মিসসেলানিস (১৬৫৯), সমুদ্রবিজ্ঞানবিষয়ক একটি বই (১৭০০), অ্যালকেমিসংক্রান্ত প্রবন্ধের সংগ্রহ (১৬১০) এবং হেনরিখ কর্নেলিয়াস অ্যাগ্রিপ্পার গুপ্ত দর্শন এবং জাদুবিদ্যা নিয়ে লেখা দ্য অকাল্ট ফিলোসফি (১৫৩৩)। এখান থেকেই ধারণা পাওয়া যায়, কত বৈচিত্র্যময় বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন নিউটন! ভ্যান গগ বা আইনস্টাইনের মতো নিউটনও ছিলেন জ্যানুসিয়ান চিন্তক, মানে যিনি ভিন্ন ভিন্ন ধারণা একত্রিত করে সৃজনশীল অগ্রগতি আনতে সক্ষম।
এই চারটি বই বিশ্লেষণ করে রয়্যাল সোসাইটির লাইব্রেরি ম্যানেজার রুপার্ট বেকার বেশ মজা করেই নিউটনকে ‘অপরাধী’ বলেছেন। তাঁর মতে, ‘বই ও বইয়ের পাতার কোনা নষ্ট করার বিষয়ে নিউটন একজন অপরাধী। আসলে তিনি বইকে কোনো সম্পদ বা শিল্প হিসেবে কল্পনা করতেন না, বরং জ্ঞান আহরণের একটা মাধ্যম বা টুল হিসেবে দেখতেন।’
কথিত আছে, একবার নিউটনের গবেষণাগারে মোমবাতির আগুনে তাঁর অনেক পাণ্ডুলিপি ও গবেষণাপত্র পুড়ে গিয়েছিল। তখন সবাই হায়! হায়! করলেও নিউটন নাকি ছিলেন খুবই শান্ত।
১. নিউটন যেভাবে বইয়ের পাতা ভাঁজ করতেন
সাধারণত আমরা বইয়ের পৃষ্ঠা মনে রাখার জন্য পাতার ওপরের বা নিচের কোণ ভাঁজ করে রাখি। একে বলে ‘ডগ-ইয়ার’। নিউটনও বইয়ের পাতা ভাঁজ করতেন, তবে তাঁর পদ্ধতি ছিল আলাদা তিনি কুকুরের কানের মতো বইয়ের পাতা ভাঁজ করে রাখতেন। তিনি নিশ্চিত করতেন যে, ভাঁজটির সুঁচালো অংশটি ঠিক সেই লাইনটি নির্দেশ করছে, যেটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি মনে রাখতে চান। সেটা হতে পারে একটি বাক্য, কোনো প্রবাদ বা একটিমাত্র শব্দ।
২. নিউটন বইয়ের ভেতরে প্রচুর নোট নিতেন
নিউটনের পড়া বইয়ের প্রতিটি পাতায়, মার্জিনে অসংখ্য নোট বা মন্তব্য থাকত। সেগুলো এত বিস্তৃত ছিল যে ‘মার্জিনালিয়া’ শব্দটি দিয়ে সেই অভ্যাসকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। অনেক সময় পুরো পাতার ফাঁকা জায়গাজুড়েই তাঁর লেখা থাকত।
৩. নোটের আবার সূচিপত্র
মার্জিনে নোট লেখার পাশাপাশি তিনি নিজ হাতে সেই নোটের সূচিপত্র ও বিষয়বস্তুর তালিকা তৈরি করতেন। সূচিগুলো আজকের বইয়ের সূচিপত্রের মতোই। বিষয় অনুযায়ী বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো এবং প্রতিটি বিষয়ের পাশেই সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার নম্বর লেখা।
৪. বই নষ্ট করতে দ্বিধা করতেন না
এটি সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আমাদের কাছে বই হলো সম্পদ—মাঝেমধ্যে মূল্যবান সম্পদ। কিন্তু নিউটন বইগুলোকে ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম হিসেবেই দেখতেন। যতটা দরকার ততটাই ব্যবহার করতেন। এমনকি প্রয়োজনে বইয়ের ক্ষতি করতেও কার্পণ্য করতেন না। কারণ তিনি বইয়ের মূল্য তার তথ্যের মধ্যে দেখতেন, বইয়ের ভৌত সৌন্দর্যে নয়। রুপার্ট বেকার বলেন, ‘স্পষ্টই নিউটন বইকে কাজের হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন, যা প্রয়োজনে নষ্ট হওয়াও স্বাভাবিক।’
নিউটনের পড়া বইয়ের প্রতিটি পাতায়, মার্জিনে অসংখ্য নোট বা মন্তব্য থাকত। সেগুলো এত বিস্তৃত ছিল যে ‘মার্জিনালিয়া’ শব্দটি দিয়ে সেই অভ্যাসকে ব্যাখ্যা করা কঠিন।
এছাড়া নিউটনের অসাধারণ সাফল্যের পেছনে আছে কঠোর পরিশ্রম। কোনো সমস্যা তাঁর মাথায় ঢুকলে, সেটার সমাধান হাতে না পাওয়া পর্যন্ত থামতে জানতেন না। প্রয়োজনে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতেন না ঘুমিয়ে। এ সময়ে তিনি প্রচুর পড়তেন, নোট নিতেন, নিজের মতো করে ধারণার সারাংশ লিখতেন, কোনো হিসেব মেলাতে পাতার পর পাতা অংক কষতেন। তিনি বইয়ের মার্জিন জুড়ে এত ব্যাপক নোট লিখতেন যে পুরো সাদা জায়গা ভরে যেত। নিউটন শুধু পড়া তথ্য মনে রাখতে চাইতেন না, তিনি তা নিজের হাতে পরীক্ষা করতেন। পর্যবেক্ষণ এবং হাতে-কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান শুধু মনে থাকে না, তা মস্তিষ্কে আরও দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়।
এভাবে একটি নির্দিষ্ট সমস্যার ওপর মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারতেন নিউটন। এই ধরনের গভীর মনোযোগ তথ্যকে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি থেকে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
আবার তিনি কোনো বই কেবল হালকাভাবে পড়তেন না; তিনি এর পেছনের মূল নীতি, গাণিতিক কাঠামো এবং কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেন। কোনো তথ্যকে যখন অন্য তথ্যের সাথে যুক্ত করে ভাবা হয়, তখন তা মনে রাখা সহজ হয়।
মোট কথা, নিউটনের স্মৃতিশক্তির মূল কারণ সম্ভবত তাঁর অসাধারণ গভীর মনোযোগ, সক্রিয় চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞানের বিষয়বস্তুকে একটি সুসংগঠিত কাঠামোতে রাখার ক্ষমতা। তিনি কেবল মুখস্থ করতেন না, তিনি যা পড়তেন, তা নিজের করে নিতেন এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন।