সাক্ষাৎকার
অনেক জায়গায় কাজ করে ও শিখে নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করেছি—রসায়নে নোবেলজয়ী সুসুমু কিতাগাওয়া
জাপানি রসায়নবিদ সুসুমু কিতাগাওয়া চলতি বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন ও জর্ডানিয়ান-মার্কিন রসায়নবিদ ওমর ইয়াগি। মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক নামে নতুন একধরনের আণবিক কাঠামো আবিষ্কারের জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
পুরস্কার ঘোষণার পরদিন তিনি একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, কীভাবে বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সে জন্য সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ফলাফলের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হয়। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন শতাব্দী রায়।
সুসুমু কিতাগাওয়া: হ্যালো?
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যালো। আমি কি প্রফেসর কিতাগাওয়ার সঙ্গে কথা বলছি?
সুসুমু কিতাগাওয়া: হ্যাঁ, আমিই বলছি।
অ্যাডাম স্মিথ: নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন!
সুসুমু কিতাগাওয়া: ওহ, অসংখ্য ধন্যবাদ।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনার কাজের একটি অসাধারণ দিক হলো, এখন ধাতব-জৈব কাঠামোর ব্যবহার সবাই জানে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে অনেকেই এর সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান ছিল। তা সত্ত্বেও আপনারা কাজ চালিয়ে গেছেন।
সুসুমু কিতাগাওয়া: তা ঠিক। এর একটি বড় কারণ, আমি যখনই কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজ করার চেষ্টা করতাম, তখন দেখতাম সবাই সেটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। এই ব্যাপারটিই আমাকে নতুন কিছু তৈরি করার জন্য অনুপ্রাণিত করত। এককথায়, এটাই কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি জ্ঞানের কেন্দ্র। এখানকার পরিবেশ আমাকে গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে।
অ্যাডাম স্মিথ: গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।
সুসুমু কিতাগাওয়া: হ্যাঁ, একই সঙ্গে গবেষণার ঐতিহ্যও প্রয়োজন। আরেকটি বিষয় হলো, অধ্যাপক কেনিচি ফুকুই ১৯৮১ সালে কোয়ান্টাম অরবিটাল থিওরির জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ছিলেন আমার অ্যাকাডেমিক পিতামহের মতো। আমি সেই একই গবেষণাগারে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে কাজ করেছি।
অ্যাডাম স্মিথ: কী চমৎকার!
সুসুমু কিতাগাওয়া: আর হ্যাঁ, আকিরা ইয়োশিনো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির জন্য নোবেল পেয়েছিলেন। তিনিও আমার পূর্বসূরি এবং একই গবেষণাগারের ছিলেন।
অ্যাডাম স্মিথ: সত্যি? আকিরা ইয়োশিনো!
সুসুমু কিতাগাওয়া: হ্যাঁ। ফুকুই থেকে ইয়োশিনো এবং তারপর আমি—আমাদের মধ্যে কয়েক প্রজন্মের মৌলিক কাজের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। অবশ্য ফুকুই ছিলেন কোয়ান্টাম রসায়নবিদ। ইয়োশিনো কাজ করেছেন কঠিন অবস্থার অজৈব পদার্থ নিয়ে। আর আমার কাজ স্থিতিস্থাপক পদার্থ নিয়ে। আমাদের কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও চিন্তাধারা ছিল একই রকম।
অ্যাডাম স্মিথ: একদম। আমি বুঝতে পারছি, এমন ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজ করে আপনি বড় চ্যালেঞ্জ নিতে শিখেছেন। আপনি কীভাবে গবেষণার প্রশ্ন খুঁজে নেন?
সুসুমু কিতাগাওয়া: আপনি হয়তো জানেন, আমার কাজের ভিত্তি মূলত ভৌত রসায়ন ও কোয়ান্টাম রসায়ন। কঠিন পদার্থের ভৌত প্রকৃতি নিয়েও আমার আগ্রহ ছিল। কঠিন অজৈব পদার্থগুলোর গঠন সাধারণত নিশ্ছিদ্র হয়। কিন্তু একবার কম্পিউটারে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করার সময় আমি ঘটনাক্রমে কিছু ছিদ্রযুক্ত কাঠামো খুঁজে পাই। তখন আমার মনে হলো, এমন ছিদ্রযুক্ত পলিমার দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা যেতে পারে। ঠিক তখনই আমি গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে ফেলি।
অ্যাডাম স্মিথ: তার মানে, নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেতে আমাদের চোখ-কান সব সময় খোলা রাখা উচিৎ।
সুসুমু কিতাগাওয়া: অবশ্যই। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর বলেছেন, ‘মস্তিষ্ক প্রস্তুত থাকলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়।’ আমি অনেক জায়গায় কাজ করে ও শিখে নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করেছি।
অ্যাডাম স্মিথ: একদম। ঠিক যেমনটা লিখেছেন লিখেছেন মার্কিন চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অ্যাব্রাহাম ফ্লেক্সনার তাঁর দ্য ইউজফুলনেস অব ইউজলেস নলেজ বইয়ে।
সুসুমু কিতাগাওয়া: চিন্তা করুন, আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ বছর আগে চীনের দার্শনিক ঝুয়াংজি এসব বিষয় নিয়ে ভেবেছিলেন। জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী অধ্যাপক হিদেকি ইউকাওয়া ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু তিনি চীনা সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন। আমি তাঁর অনেক লেখা পড়েছি।
অ্যাডাম স্মিথ: তার মানে সত্যিই আপনার মস্তিষ্ক একেবারে প্রস্তুত ছিল।
সুসুমু কিতাগাওয়া: একদম তাই।
অ্যাডাম স্মিথ: আর এসবের জন্য বেশ কঠোর পরিশ্রমও দরকার। আমি আসলে বলতে চাই, এমন জটিল বিষয় জানতে ও বুঝতে একজনকে অনেক কঠোরভাবে কাজ করতে হয়। তাই না?
সুসুমু কিতাগাওয়া: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের মতো জাপানি গবেষকদের চিন্তাধারাই হলো, রাতেও গবেষণাগারের আলো নিভতে দেওয়া যাবে না।
অ্যাডাম স্মিথ: বেশ। তাহলে আগামী কয়েকদিনের আনন্দ উদযাপনের জন্যও আপনি প্রস্তুত। এই কয়েকদিনেও আপনার গবেষণাগারের আলো নিভবে না! আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুব ভালো লাগল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সুসুমু কিতাগাওয়া: ধন্যবাদ। বিদায়।
অ্যাডাম স্মিথ: বিদায়।