রাসায়নিক অস্ত্র বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের শুরুর দিকে আমরা রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে নানা আলোচনা শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্র বারবার সতর্ক করে বলছিল, রাশিয়া এই যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। রাশিয়াও পাল্টা অভিযোগ করছিল, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গবেষণাগারের রাসায়নিক ও জৈবাস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে পরাশক্তিগুলোর সংবেদনশীলতার কারণ আমরা জানি। কিন্তু রাসায়নিক অস্ত্র নিয়েও কেন এত দুশ্চিন্তা এদের?

কারণ, নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মতো রাসায়নিক অস্ত্রও বিপজ্জনক। পারমাণবিক অস্ত্রগুলো অন্তত সরাসরি দেখা যায়। কিন্তু রাসায়নিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা হয়তো টেরও পাব না, কোন দিক থেকে অস্ত্র এল, আর কীভাবে সবাইকে মেরে রেখো গেল। বিভিন্ন যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারও কম নয়। আবার এর ধরনও আছে অনেক। তবে এখানে আলোচনা করা হবে ক্লোরিন গ্যাস নিয়ে। এটি বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। অন্তত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই আধুনিক রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে আসছে। ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়টা ছিল অনেক ঘটনাবহুল। ১৯১৪ সালে ইউরোপ দেখতে পায় তখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ—প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। একে বলা হয়েছিল ‘সব যুদ্ধ শেষ করার যুদ্ধ’। এই যুদ্ধেই জার্মান বিজ্ঞানীরা প্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেন।

এই বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন ফ্রিৎস হেবার। তাঁর জন্ম বর্তমান পোল্যান্ডে। তবে তিনি পড়াশোনা করেন বার্লিনে রসায়ন বিভাগে। ওই সময় জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি চাইতেন নিজেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইহুদি থেকে সফল জার্মান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি কাজ করতেন বার্লিনের কাইজার ভিলহেম ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির পরিচালক হিসেবে। নিজেকে খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করতে তিনি জার্মানির জন্য বিশেষ কিছু করতে চাইছিলেন।

আরও পড়ুন

হেবার বিশ্বাস করতেন, মিত্রপক্ষের সেনাদের ট্রেঞ্চ থেকে বিতাড়িত করতে রাসায়নিক অস্ত্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ফলে জার্মানি খুব সহজেই বিজয়ী হতে পারবে এ যুদ্ধে। সে জন্য তিনি ব্যবহার করতে চাইছিলেন বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস।

সমস্যা ছিল, এই বিষাক্ত গ্যাস শত্রুপক্ষের ট্রেঞ্চ পর্যন্ত পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া। পূর্ববর্তী এক পরীক্ষায় ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে দেওয়ার সময় খোদ জার্মানির কয়েকজন সেনা মারা যান। জার্মান সেনা কর্মকর্তারা তাই হেবারের অস্ত্র নিয়ে খুব একটা ইতিবাচক ছিলেন না। কিন্তু ১৯১৫ সালে কয়েকটি ফ্রন্টে পরাজয় ঘটে জার্মানির। তখন জার্মান সামরিক বাহিনীকে রাসায়নিক অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার সমস্যা দূর করে মাঠে নামতে হয়।

জার্মান সেনারা তখন কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করেন উপযুক্ত বায়ুপ্রবাহের জন্য। যেন এ বিষাক্ত গ্যাস জার্মান ট্রেঞ্চ থেকে মিত্রবাহিনীর ট্রেঞ্চে যাওয়ার মতো শক্তিশালী হয় এবং নিজেদের ওপর ছড়িয়ে না পড়ে। হেবার বেলজিয়ামের ইপ্রায় অবস্থিত মিত্রবাহিনীর ট্রেঞ্চে প্রায় ১৬৮ টন ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে দেন। এতে একটা সবুজাভ হলুদ দেয়ালের মতো মেঘ সৃষ্টি হয়। আনারস আর মরিচের মিশ্রণের মতো গন্ধের গ্যাসের প্রবাহ চলে যায় মিত্রবাহিনীর সেনাদের দিকে।

ক্লোরিন গ্যাস

প্রথমে এই রঙিন মেঘ দেখে সেনারা ভেবেছিলে, জার্মানদের কোনো ধূম্রজাল। ধোঁয়ার আড়াল নিয়ে হয়তো পদাতিক বাহিনী আসছে আক্রমণের জন্য। কিন্তু ট্রেঞ্চে যখন গ্যাস চলে এল, তখন যা হলো, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। ক্লোরিন বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ায় তা ট্রেঞ্চের গভীরে ঢুকে পড়ে। সৈনিকেরা প্রশ্বাসের সঙ্গে ক্লোরিন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বুকে ব্যথা ও গলা জ্বালাপোড়া শুরু হয়। পরে এ আক্রমণের বর্ণনা দেওয়া হয় ‘শুকনো মাটিতে ডুবে মৃত্যু’ হিসেবে।

এ রকম বলার কারণ, তাঁদের তীব্র মাথাব্যথা আর মারাত্মক পিপাসা পাচ্ছিল। কিন্তু পানি পান করলেই মৃত্যু হচ্ছিল তৎক্ষণাৎ। এ ছাড়া তাঁদের ফুসফুসে ছুরির আঘাতের মতো ব্যথা হচ্ছিল। আর কাশির সঙ্গে বেরোচ্ছিল সবুজাভ ফেনা। এককথায় বলা যায়, নির্মম মৃত্যু। ওই আক্রমণে ট্রেঞ্চের প্রায় ১০ হাজার সেনা আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শ্বাসরোধে মারা যান। আর সেটি ঘটে ট্রেঞ্চে ক্লোরিন গ্যাস প্রবেশ করার ১০ মিনিটের মধ্যে।

আরও পড়ুন
ক্লোরিন গ্যাস যখন পানিতে দ্রবীভূত হয়, তখন ভেঙে গিয়ে দুই ধরনের অ্যাসিড তৈরি করে—হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড।

হেবার তাঁর রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। ‘হেবারের স্বীকার্য’ নামে একটা গাণিতিক মডেলও বের করেন তিনি। যেখানে গ্যাসের ঘনত্ব, গ্যাসের সংস্পর্শে আসার সময় এবং মৃত্যুর হারের মধ্যে সম্পর্ক দেখান। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লোরিন গ্যাসের তুলনায় চিরায়ত অস্ত্রগুলোর কারণেই বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু নতুন এই রাসায়নিক অস্ত্র যুদ্ধের ভয়াবহতায় যোগ করে নতুন মাত্রা।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ক্লোরিন গ্যাসে কী এমন জিনিস আছে, যার কারণে মাত্র ১০ মিনিটে মানুষের মৃত্যু ঘটে? এই গ্যাস কাজ করে কীভাবে?

বর্তমানে অবশ্য জেনেশুনে কারও এ রকম ক্লোরিন গ্যাসের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু আপনি যদি জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা অতিরিক্ত ক্লোরিনযুক্ত কোনো সুইমিংপুলের পানিতে সাঁতার কেটে থাকেন, তাহলে দেখবেন, চামড়া আর চোখে খুব অস্বস্তি হচ্ছে।

আমাদের চোখ, নাক, মুখ ও ফুসফুসে তরলের একটা পাতলা আবরণ থাকে। তরলের এ আবরণ বিভিন্ন অঙ্গ আর্দ্র রাখে এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। আমাদের মুখের লালারস বা স্যালাইভাতে থাকে মিউকাস নামের একধরনের পদার্থ, যা খাবার গিলতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে এই লালারস। নাক ও শ্বাসযন্ত্রের তরলের আবরণ একটু আঠালো ধরনের—ক্ষতিকারক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ধুলাবালু আটকে রাখে, ফলে এগুলো ফুসফুসে গিয়ে সংক্রমণ করতে পারে না। এই যে তরল আবরণ আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা দেয়, এতে ক্লোরিন গ্যাস প্রবেশ করলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। আর তখনই সৃষ্টি হয় সমস্যা।

ক্লোরিন গ্যাস যখন পানিতে দ্রবীভূত হয়, তখন ভেঙে গিয়ে দুই ধরনের অ্যাসিড তৈরি করে—হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl) ও হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (HClO)। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড অবশ্য আমাদের শরীরের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। আমাদের পাকস্থলীতে এই অ্যাসিড থাকে খাদ্য পরিপাক ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য। পাকস্থলীতে মিউকাসের একটা দৃঢ় আবরণ থাকে, যার কারণে পাকস্থলীর কোষগুলো অ্যাসিডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

বিষাক্ত ক্লোরিনের কোনো প্রতিষেধক নেই

কিন্তু চোখ আর ফুসফুসে এ রকম কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই। ফলে এসব অঙ্গের কোষগুলো সরাসরি অ্যাসিডের মুখে পড়ে যায়। চোখে যদি ক্লোরিন থেকে অ্যাসিড তৈরি হয়, তখন আমাদের চোখে শুরু হয় বেদনাদায়ক জ্বালাপোড়া। তবে চোখের পানি এ ক্ষেত্রে ভালো প্রতিরক্ষা দেয়। ক্লোরিন গ্যাসের পরিমাণ যদি অল্প হয়, তাহলে সেটা চোখের কান্নার পানিতে ভেসে যায়।

অন্যদিকে ফুসফুসে এ রকম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সামান্যই। শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে ক্লোরিন গ্যাস ঢুকে পড়লে যে অ্যাসিড তৈরি হয়, তা ফুসফুসের টিস্যু ধ্বংস করে দেয়, ফলে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। এতে আমাদের শরীর আত্মরক্ষার জন্য শ্বাসনালি সংকুচিত করে দেয়, যেন বিষাক্ত ক্লোরিন ফুসফুসের গভীরে যেতে না পারে। এই ফুসফুসে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই–অক্সাইড বিনিময় ঘটে।

সমস্যা হলো, শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন আসার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কেউ ক্লোরিন গ্যাসের সংস্পর্শে এলে হাঁপাতে শুরু করে, আরও বেশি করে বাতাস টানার চেষ্টা করে। এভাবে আরও বেশি ক্লোরিন ঢুকে পড়ে ফুসফুসে।

আরও পড়ুন
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষাক্ত ক্লোরিনের কোনো প্রতিষেধক নেই। ক্লোরিনের সংস্পর্শ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত সরিয়ে আনাই জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়।

ফুসফুসের টিস্যুতে জ্বালাপোড়া করলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাশি হয়। সাধারণ সময়ে এটা ভালো জিনিস। কারণ, কাশির সঙ্গে বেরিয়ে যায় ছোটখাটো বর্জ্য বা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু ক্লোরিনের সংস্পর্শে সাধারণ কাশিই অনেক তীব্র ও দীর্ঘতর হয়। এতে শ্বাসপ্রশ্বাস খুব কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে শ্বাসনালি ও ফুসফুসে যে দুর্বল কোষগুলো থাকে, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। প্রদাহের কারণে ফুসফুসের টিস্যুগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।

যুদ্ধের ময়দান থেকে যেসব সৈন্য ক্লোরিনের আক্রমণ থেকে জীবিত ফিরতে পেরেছিলেন, তাঁদের অনেকেই বাকি জীবন ফুসফুসের সমস্যায় ভুগেছেন। অনেক বেশি ক্লোরিন দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুসে এত বেশি ক্ষত সৃষ্টি হয় যে এর চারদিকে থাকা রক্তনালিগুলো থেকে অতিরিক্ত তরল এসে জমতে থাকে। এতে আক্রমণের শিকার ব্যক্তির ফুসফুস নিজের শরীরের তরলেই ডুবে যেতে থাকে। আর তখনই শ্বাসরোধে মারা যায় আক্রান্ত ব্যক্তি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষাক্ত ক্লোরিনের কোনো প্রতিষেধক নেই। ক্লোরিনের সংস্পর্শ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত সরিয়ে আনাই জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। এরপর তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আক্রান্ত ব্যক্তির কত দ্রুত বা ধীরগতিতে মৃত্যু হবে, তা নির্ভর করবে কী পরিমাণ ক্লোরিনের সংস্পর্শে এসেছে, আর ফুসফুসে কী পরিমাণ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তার ওপর।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে এক শতাব্দী। রাসায়নিক অস্ত্রও আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। রাশিয়ার বিভিন্ন ধনকুবের ও গুপ্তচররা রাসায়নিক অস্ত্রের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তীব্র সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনি ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং–উনের সৎভাই কিম জং–ন্যামও শিকার হয়েছেন বিষক্রিয়ার।

রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে পরাশক্তিদের উদ্বেগ তাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এটাও পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্রেবিশেষে আরও বেশি ক্ষতিকর। আসলে যেকোনো ধরনের অস্ত্রই মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকর। মানুষ অস্ত্রের ব্যবহার ভুলে গিয়ে সবাই মিলেমিশে পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করলেই কেবল এ ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।

লেখক: এমবিবিএস, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

সূত্র: আ টেস্ট ফর পয়জন: ইলেভেন ডেডলি মলিকিউলস অ্যান্ড দ্য কিলারস হু ইউজড দেম/ নীল ব্র্যাডবেরি

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত