মেন্দেলিভের ভবিষ্যদ্বাণী

রুশ রসায়নবিজ্ঞানী ও আধুনিক পর্যায় সারণীর দিমিত্রি মেন্দেলিভের মৃত্যুদিন আজ। ১৯০৭ সালের আজকের দিনে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেন্টস পিটার্সবার্গে মৃত্যুবরণ করেন। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে এই বিজ্ঞানীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

রসায়নের ক্লাসরুমের দেয়ালে টাঙানো পর্যায় সারণি এখন বিশ্বজুড়েই খুবই পরিচিত দৃশ্য। মৌলগুলোর এই তালিকা আসলে শত বিজ্ঞানীর শত বছরের ভাবনা আর শ্রমের ফসল। সেই ইতিহাসের খানিকটা তুলে ধরা হলো—

প্রতিভাবান ব্রিটিশ পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘সব বিজ্ঞানই আসলে পদার্থবিজ্ঞান, নয়তো ডাকটিকিট সংগ্রহ।’ এ মন্তব্যে পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। বিশেষ করে যাঁরা পদার্থবিদ নন, তাঁদের বেশ চোট লেগেছিল। কিন্তু একদিন তাঁর এই রসিকতাই যে বুমেরাংয়ের মতো তাঁকেই আঘাত হানবে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। একেই বোধ হয় বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কারণ ১৯০৮ সালে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের জনক রাদারফোর্ড। তবে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নয়, সেটি পেয়েছিলেন রসায়নে অবদানের জন্য। এতে অবশ্য রাদারফোর্ড কষ্ট পাওয়ার বদলে মজা করেই বলেছিলেন, তিনি যেন ‘রাতারাতি পদার্থবিদ থেকে রসায়নবিদ বনে গেছেন।’

মূলত পদার্থবিদ হলেও বিশ শতকে রাসায়নিক মৌলগুলোর জন্য পর্যায় সারণির নিয়ম উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন রাদারফোর্ড। মৌলিক পদার্থের চরিত্র বুঝতেও তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে রাসায়নিক মৌলের আধুনিক ধারণা শুরু হয়েছিল তারও প্রায় ১০০ বছর আগে। সেই ১৮ শতকের শেষ ভাগে। ফরাসি রসায়নবিদ আন্তোনি–লরাঁ ল্যাভোয়সিয়েরের গবেষণার কারণেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। সে জন্য তাঁকেই আধুনিক রসায়নের প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। তিনি ১৭৭০ থেকে ১৭৯৪ সাল পর্যন্ত রসায়ন নিয়ে কাজ করেছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো এ বিষয়ে আরও কিছু কাজ করে যেতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওই বছরই ফরাসি বিপ্লবের টালমাটাল সময়ে কিছু অভিযোগে গিলোটনে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে তিনি এলিমেন্টারি ট্রিটিজ অন কেমেস্ট্রি নামের এক বই প্রকাশ করেন। বইটিতে ৩৩টি সরল পদার্থ বা মৌলের তালিকা ছিল। এ তালিকার অনেকগুলোকেই পরে মৌল হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। যেমন: অক্সিজেন, হাইড্রোজেন গ্যাস, প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত ধাতু ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম ও টাংস্টেন। এ ছাড়া ছিল অধাতু কার্বন, সালফার ও ফসফরাস। তবে চুনাপাথর ও বারিতাকেও (বেরিয়াম হাইড্রোক্সাইড) তিনি মৌল বলে মনে করেছিলেন। এগুলো এখন রাসায়নিক যৌগ হিসেবে পরিচিত। এমনকি আলো আর তাপকেও মৌল ভেবেছিলেন ল্যাভোয়সিয়ের।

ল্যাভোয়সিয়েরের পর মৌলগুলোর শ্রেণিবিভাগের কাজটি এক ধাপ এগিয়ে নেন ব্রিটিশ রসায়নবিদ জন ডাল্টন। ১৮০৩ সালের দিকে ডাল্টন অনুমান করলেন, প্রতিটি মৌলে কিছু নির্দিষ্ট পরমাণু থাকে, যেগুলো আসলে অবিভাজ্য। ল্যাভোয়সিয়েরের গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ডাল্টন কিছু মৌলের আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করেছিলেন। সে জন্য তিনি কিছু সরল রাসায়নিক যৌগ বিশ্লেষণ করেছিলেন। দেখা গেল, ওজনের ভিত্তিতে পানিতে প্রায় ৮ ভাগের ১ ভাগ হাইড্রোজেন এবং ৮ ভাগের ৭ ভাগ অক্সিজেন থাকে। এ ফলাফল পেয়ে হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন ঠিক করলেন ১ আর অক্সিজেনের জন্য ৭। তাঁর এই হিসাবের পেছনের কারণটি অবশ্য মাথায় রাখতে হবে। আসলে তিনি পানির অণুর সংকেত H2O–এর বদলে HO ভেবে নিয়েছিলেন। তাঁর ভাবনা যে ভুল ছিল, সেটি এখন আমরা জানি। আবার ল্যাভোয়সিয়েরের যেসব তথ্য-উপাত্ত তিনি ব্যবহার করেছিলেন, সেখানেও অনুপাতের পরিমাপে ভুল ছিল। কিন্তু মানতেই হবে, তাঁর পদ্ধতিটি ছিল চমত্কার। কারণ পরে পর্যায় সারণির জন্য মৌলের আপেক্ষিক পারমাণবিক ওজন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত হয়। অবশ্য সে জন্য পদ্ধতিটি কিছুটা সংশোধন করতে হয়েছিল।

১৮১৭ সালে জার্মান রসায়নবিদ জোহান উলফগ্যাং ডোবারিনার খেয়াল করলেন, ত্রয়ী কিছু মৌলের রাসায়নিক চরিত্র প্রায় একই রকম। আবার তাদের পারমাণবিক ওজনের বিন্যাসেও বেশ মিল। যেমন: আলকেলি বা ক্ষার ধাতু লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের পারমাণবিক ওজন যথাক্রমে ৭, ২৩ ও ৩৯। হিসাব করলেই দেখা যায়, সোডিয়ামের পারমাণবিক ওজন লিথিয়াম আর পটাশিয়ামের মাঝামাঝি—অর্থাৎ ৭+৩৯=৪৬; ৪৬/২=২৩। আবার মৃত্ক্ষার ধাতু শ্রেণির ক্যালসিয়াম, স্ট্রোটিনাম ও ব্যারিয়াম এবং হ্যালোজেন শ্রেণির ক্লোরিন, ব্রোমিন ও আয়োডিনের মধ্যেও একই ধরনের মিল দেখা যায়। ১৮২৭ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে আরও কিছু রসায়নবিদ ওই ত্রয়ী মৌলের সঙ্গে আরও কিছু মৌল মিলিয়ে ডোবারিনার পর্যবেক্ষণকে প্রসারিত করলেন। তারা আগের ত্রয়ী মৃত্ক্ষার ধাতু শ্রেণির সঙ্গে ম্যাগনেশিয়াম এবং হ্যালোজেন শ্রেণির সঙ্গে ফ্লোরিন যোগ করে একই বৈশিষ্ট্য দেখতে পেলেন। আবার অক্সিজেন, সালফার, সেলেনিয়াম ও টেলুরিয়ামকে একটি পরিবার হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করলেন। অন্য দিকে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ও বিসমাথকে আরেক পরিবারে ভাগ করা হলো।

১৮৫৮ সালে ইতালিয়ান রসায়নবিদ স্টানিসলাও কানিজজারো পারমাণবিক ও আণবিক ওজনের একটি তালিকা প্রকাশ করলেন। অবশ্য তিনি তাঁর স্বদেশি রসায়নবিদ ও পদার্থবিদ আমিদিও অ্যাভোগাদ্রোর কাছে ঋণী। ১৮১১ সালে অ্যাভোগাদ্রো গ্যাসের ওপর একটি হাইপোথিসিস প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে অ্যাভোগাদ্রো অনুমান করেছিলেন, বিভিন্ন গ্যাস যেমন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন অণু দিয়ে গঠিত, যারা আবার পরমাণু দিয়ে গঠিত। এর অর্থ দাঁড়ায় গ্যাসের আণবিক ওজন নিঃসন্দেহে তার পারমাণবিক ওজন থেকে ভিন্ন হবে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সেই হাইপোথিসিসটিই আবার পুনর্জীবন দান করলেন কানিজজারো। আণবিক ওজন নির্ভর করে একটি অণুতে কতগুলো মৌল আছে তার ওপর। যেমন অক্সিজেনের একটি অণুতে থাকে দুটি পরমাণু। কানিজজারোর এই বিশ্লেষণ ১৮৬০ সালে জার্মানির কার্লশ্রুতে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক রসায়নবিদ কংগ্রেসে আলোচিত হলো। সম্মেলনে ছিলেন রুশ রসায়নবিদ মেন্দেলিভ, জার্মানির জুলিয়াস লোথার মেয়ার এবং ব্রিটেনের উইলিয়াম ওডলিং। এ তিনজন এবং জন নিউল্যান্ড, গুস্তাভ হিনরিচ ও ফরাসি ভূতত্ত্ববিদ অ্যালেকজাদ্রি-এমিল বেগুয়ার ডি চ্যানকোর্টিস গত শতকের ৬০-এর দশকে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় সারণির প্রস্তাব দিলেন। তাঁদের কারোটা সে সময়ের আবিষ্কৃত ৬৩টি মৌলের পারমাণবিক ওজন, রাসায়নিক চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে এসব পর্যায় সারণি বানিয়েছিলেন তাঁরা। তবে হিনরিচের পর্যায় সারণিটি ছিল পারমাণবিক বর্ণালির ওপর ভিত্তি করে।

রসায়নের ওপর একটি রুশ পাঠ্যবই লিখতে গিয়ে মেন্দেলিভ পর্যায় সারণির ধারণা পেয়েছিলেন। তারপর পরই তিনি এর প্রস্তাব করেছিলেন। তবে অন্যদের তুলনায় তাঁর প্রস্তাবটিই এসেছিল সবার শেষে। ১৮৬৯ সালে তাঁর প্রস্তাবিত পর্যায় সারণির একটি খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল। আর ১৮৭১ সালে পূর্ণাঙ্গ সারণিটি প্রকাশিত হয়। তবে তিনি আগের প্রস্তাবিত পর্যায় সারণির প্রবক্তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল বলেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আসলে প্রস্তাবিত প্রতিটি সারণির আলাদা গুরুত্ব ছিল। কিন্তু শেষ হাসি হেসেছিলেন ওই মেন্দেলিভ। তার সফলতার প্রধান কারণটি হচ্ছে ১৮৬৯ থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে তিনি বেশ কিছু অজানা মৌলের অস্তিত্ব সম্পর্কে আগাম অনুমান করতে পেরেছিলেন। সেগুলোকে তিনি সংস্কৃত শব্দ একা (অর্থ এক) দিয়ে নির্দেশ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল একা-অ্যালুমিনিয়াম, একা-বোরন এবং একা-সিলিকন। তিনি অনুমান করেছিলেন, অনাবিষ্কৃত এই মৌলগুলোর পারমাণবিক ওজন হওয়া উচিত প্রায় ৬৮, ৪৪ ও ৭২। ১৮৭৫ সালেই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করে। সে বছর নতুন একটি মৌল আবিষ্কৃত হয়েছিল, যার নামকরণ করা হয়েছিল গ্যালিয়াম (ফ্রান্সে পাওয়া গিয়েছিল বলেই এমন নাম)। এর পারমাণবিক ওজন পাওয়া গেল ৬৯.৭। এর চার বছর পরেই আবিষ্কৃত হলো স্ক্যান্ডেনিয়াম, যার পারমাণবিক ওজন ৪৫। ১৮৮৬ সালে জার্মানিতে আবিষ্কৃত হলো জার্মানিয়াম (নামের মধ্যেই আছে নামকরণের মাহাত্ম্য), যার পারমাণবিক ওজন ৭২.৬। আবার নতুন মৌলগুলোর রাসায়নিক চরিত্র কেমন হতে পারে, সেটিও আগেই বলেছিলেন মেন্দেলিভ। দেখা গেল, তাঁর অনুমান ঠিক ঠিক মিলে গেছে। অবশ্য তাঁর সব অনুমানই যে সত্যি হয়েছিল, তা–ও নয়। যেমন ১৯০৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে নতুন কিছু আবিষ্কার তাঁর তত্ত্বটিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। আসলে বর্তমানে চালু থাকা পর্যায় সারণি মেন্দেলেভের তিনটি মুখ্য নীতিকে অগ্রাহ্য করে। সেগুলো হচ্ছে যোজনী, পরমাণুর অবিভাজ্যতা ও নিত্যতা।

যোজনী হচ্ছে কোনো পরমাণুর রাসায়নিকভাবে আরেকটি পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হতে কয়টি বন্ধনে আবদ্ধ হবে, তার সংখ্যাকে বোঝায়। অর্থাৎ আরেকটি মৌলের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতাকে বলে যোজনী। অভিজাত বা নিষ্ক্রিয় গ্যাস যেমন হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপটন, রেডন ও জেনন গ্যাস ১৮৯০-এর দশকে রসায়নবিদ উইলিয়াম রামসে আর পদার্থবিদ লর্ড র‍্যালে আবিষ্কার করেছিলেন। এ গ্যাস অন্য কিছুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। তাই তাদের যোজনী শূন্য, যা কিনা নিষিদ্ধ। অবশ্য এখন আমরা জানি, এই কয়েকটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস কিছু রাসায়নিক যৌগ তৈরি করতে পারে। আবার ১৮৯৭ সালে পদার্থবিদ জে জে টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করে পরমাণুর অবিভাজ্যতার বিরুদ্ধে প্রমাণ হাজির করলেন। অন্য দিকে এর এক বছর আগেই পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন। অবশ্য তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিওঅ্যাকটিভি নামকরণ করেছিলেন কুরি দম্পতি ১৮৯৮ সালে। তাঁরা প্রমাণ দেখালেন, এক মৌল থেকে আরেক মৌলে রূপান্তর সম্ভব। অর্থাৎ মৌলের নিত্যতার নীতিও আর সত্য রইল না। কারণ ইউরেনিয়াম, পলোনিয়াম ও রেডিয়াম তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে অন্য মৌলে রূপান্তরিত হয়।

তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি ছিল মেন্দেলিভ তাঁর পর্যায় সারণিতে পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে মৌলগুলোকে পর্যায়ক্রমে সাজিয়েছিলেন। মৌলের পারমাণবিক ভর যত বেশি সেই মৌলের অবস্থান পর্যায় সারণিতে তত পরে। এই নিয়মে সাজাতে গিয়ে মেন্দেলিভ নিজেও কিছু সমস্যার মুখে পড়েছিলেন। তাই দুটি ক্ষেত্রে নিজের আবিষ্কৃত নিয়ম তিনি নিজেই লঙ্ঘন করেছিলেন। যেমন: টেলুরিয়ামকে তিনি আয়োডিনের আগে বসিয়েছিলেন, অথচ টেলুরিয়ামের পারমাণবিক ওজন ১২৭.৬, যেখানে আয়োডিনের পারমাণবিক ওজন ১২৬.৯। তাঁর যুক্তি ছিল, সম্ভবত এই দুটি মৌলের কিংবা অন্তত একটির পারমাণবিক ওজন নির্ণয়ে ভুল হয়েছে। তবে টেলুরিয়াম কিংবা আয়োডিনের পারমাণবিক ওজন নির্ণয়ে কোনো ভুল ছিল না। টেলুরিয়ামের পারমাণবিক ওজন আসলেই আয়োডিনের চেয়ে বেশি। এদের পারমাণবিক সংখ্যা যথাক্রমে ৫২ ও ৫৩। অবশ্য সে সময় পারমাণবিক সংখ্যা সম্পর্কে মেন্দেলেভের কোনো ধারণা ছিল না। উনিশ শতকের বেশ কিছু পর্যায় সারণিতে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ওজনের ভিত্তিতে মৌলগুলোকে একটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। এর পেছনে কোনো বিজ্ঞান ছিল না। একসময় পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা প্রবর্তিত হয়। সে জন্য পদার্থবিদ রাদারফোর্ড আর হেনরি মোসলের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা ১৯১১ থেকে ১৯১৪ সালে এ বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলেন।

তার কিছু আগে রাদারফোর্ড পারমাণবিক নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্র এবং নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক চার্জবাহী প্রোটনও আবিষ্কার করেছিলেন। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করেই ঋণাত্মক চার্জবাহী ইলেকট্রনগুলো অবিরাম ঘুরছে, অনেকটা সৌরজগতের মতো। সে সময় অ্যান্টোনিও ভন ডেন ব্রোয়েক নামের এক অর্থনীতিবিদ ও শখের পদার্থবিদ মোসলেকে একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেটি ছিল: কোনো মৌলের নম্বর আসলে তার নিউক্লিয়ার চার্জের ওপর নির্ভর করে দেওয়া উচিত। অর্থাৎ সোজা কথায়, মৌলটির প্রোটনসংখ্যা অনুযায়ী দেওয়া উচিত। এ কথা শুনে, মোসলে বেশ কিছু মৌলের বৈশিষ্ট্যবাহী এক্স–রে বর্ণালি রেখার তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাপ করে দেখলেন। এতে তিনি প্রমাণ দেখালেন, এসব তরঙ্গদৈর্ঘ্য মৌলের পারমাণবিক সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল।

তাই মৌলের এই সংখ্যাটিই আসলে পারমাণবিক সংখ্যা, পারমাণবিক ওজন নয়। আধুনিক পর্যায় সারণির অধিকাংশই এই সংখ্যার ক্রম অনুসারে সাজানো থাকে। এটিও পর্যায় সারণিতে পারমাণবিক ওজনের মতোই এবং তার সমান্তরালে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। তাই পর্যায় সারণিতে পারমাণবিক ওজন থাকা সত্ত্বেও পরমাণবিক সংখ্যার মাধ্যমে মৌলের চরিত্র বুঝতে অনেকাংশে সাহায্য করে। কারণ পারমাণবিক ওজন নির্ধারণ করা হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যার ওপর। পর্যায় সারণিতে যখন প্রোটনসংখ্যা বাড়তে থাকে একই সঙ্গে তার সাধারণ নিয়মে তার নিউট্রন সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কাজেই সাধারণভাবে পারমাণবিক সংখ্যা ও ওজন বাড়ার বিষয়টি পরস্পরের সঙ্গে জড়িত।

বলা হয়ে থাকে, পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে কোনো মৌলের রাসায়নিক আচরণ পুরোপুরি আন্দাজ করা সম্ভব নয়। কারণ পর্যায় সারণিতে ক্ষার ধাতু পটাশিয়াম ও সোডিয়াম পরস্পরের প্রতিবেশী হলেও একই পরিস্থিতিতে দুটি মৌল ভিন্ন ধরনের আচরণ করে। যেমন: এদের মধ্যে পটাশিয়াম বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু সোডিয়াম পারে না। এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মত, পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোর মধ্যে খুব সামান্য পার্থক্য দেখা গেলেও তারা পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেকটা রেলপথের সুইচ পয়েন্টের মতো। রসায়নের জট পাকানো ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর আবিষ্কার সম্পর্কে সম্ভবত এটিই যথার্থ উপসংহার।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: দ্য স্ট্রাকচার অব দ্য পিরিওডিক টেবিল/অ্যান্ড্রু রবিনসন