পৃথিবীতে কী কখনো ইউএফও এসেছিল
১৬ মে ২০২১। ৬০ মিনিটস টক শো, সিবিএস চ্যানেল।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ফর ইন্টেলিজেন্স অফিসের সাবেক কর্মী ও যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের স্পেশাল এজেন্ট লুই এলিজোন্ডো কথা বলছেন ৬০ মিনিটসের এই পর্বের সঞ্চালক বিল হুইটেকারের সঙ্গে। ২০ বছর তিনি আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ইন্টেলিজেন্স অপারেশনগুলো পরিচালনা করেছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন সাবেক নেভি পাইলট লেফটেন্যান্ট রায়ান গ্রেভস। তাঁদের আলোচ্য বিষয় ‘ইউএফও’।
পরের মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ প্রসঙ্গে সরকারি বিবৃতি দেওয়ার কথা। গত কয়েক দিন এ প্রসঙ্গে প্রচুর কথা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়ে যাচ্ছে ঝড়। তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার জন্য ৬০ মিনিটসের আজকের পর্বে এই দুই অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বিল হুইটেকার: আপনি তাহলে আমাকে বলছেন, ইউএফও বাস্তব?
লুই এলিজোন্ডো: আমি বলছি না, বিল। ওই পর্ব আমরা পেরিয়ে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিয়েছে ইউএফও বাস্তব। আমি বলছি না, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে।
বিল হুইটেকার: কথাগুলো কেমন শোনাচ্ছে, আপনি বুঝতে পারছেন তো? পাগলাটে, উদ্ভট শোনাচ্ছে কথাগুলো।
লুই এলিজোন্ডো: আমি তো বলিনি উদ্ভট শোনাচ্ছে না। এটুকু আমিও জানি। আমি বলছি, কথাগুলো বাস্তব। ইউএফও বাস্তব। প্রশ্ন হলো, জিনিসগুলো কী? ওগুলোর উদ্দেশ্য কী? ওগুলোর ক্ষমতাই–বা কতটুকু?
৬০ মিনিটস বা এক ঘণ্টার এই পর্বে তাঁদের কথোপকথনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসলে এটিই। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিবৃতি ও আশঙ্কার মধ্যে বাস্তবতা কতটুকু? বাস্তবতা থাকলে আমাদের জন্য এর অর্থ কী?
২
আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্টস (ইউএফও)। বাংলা করলে দাঁড়ায়—শনাক্ত করা যায় না, এমন উড়ন্ত বস্তু। তবে এই বাংলা ব্যবহৃত হয় না। বিভিন্ন গুজব ও কল্পনায় ভর করে ইউএফওর বহুল ব্যবহৃত বাংলা দাঁড়িয়েছে ‘উড়ন্ত চাকতি’। কারণ, বেশির ভাগ বর্ণনায় চাকতি আকৃতির উড়ন্ত বস্তু দেখার কথা শোনা যায়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ইউএফও দেখার দাবি অনেক পুরোনো। প্রাচীন মিসর ও রোমের লিখিত ইতিহাসে এ রকম দাবি দেখা যায়। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইউএফও দেখার কথা বলে আসছেন অনেকে। বিষয়টিকে তাই একদম ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় ছিল না। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের সরকার এ নিয়ে তদন্ত করেছে।
কেউ দাবি করল, পৃথিবীতে গোলাপি রঙের হাতি আছে। বিজ্ঞানীরা পুরো পৃথিবী চষে ফেললেন, স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন কোনার গুহা বা বনাঞ্চলের সবকিছু তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না গোলাপি হাতি।
১৯৫২ সালে মার্কিন বিমানবাহিনী হাতে নেয়, ‘প্রজেক্ট ব্লু বুক’। উদ্দেশ্য, ইউএফও দেখার বিষয়টা আসলে কী, তা খতিয়ে দেখা। এত বড় পরিসরে ইউএফও নিয়ে কাজ খুব কমই হয়েছে। মোট ১২ হাজার ৬১৮টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেন এ প্রজেক্টের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা। বেশির ভাগ ঘটনাকেই তাঁরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাকে ভুলভাবে দেখা, বিমান ও বেলুনের মতো কৃত্রিম কিছু নিয়ে চোখের ধাঁধা ও ধাপ্পাবাজি হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু ৬ শতাংশ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেননি। কারণ, এসব ঘটনার বর্ণনা বা প্রমাণ ঠিক স্পষ্ট নয়। যথেষ্ট তথ্য ছিল না এসব নিয়ে। তবে তাঁরা নিশ্চিত হন, এসব ঘটনার সঙ্গে বহির্জাগতিক প্রাণের কোনো সম্পর্ক নেই। এ গবেষণা প্রতিবেদনের উপসংহারে তাঁরা বলেন, এ ধরনের গবেষণা চালিয়ে আসলে লাভ নেই। মার্কিন জনগণ বা বিমানবাহিনীর জন্য এগুলো কোনো হুমকি নয়। ফলে ১৯৬৯ সালে বন্ধ হয়ে যায় প্রজেক্ট ব্লু বুক। আরেকটু ছোট পরিসরে ‘প্রজেক্ট সাইন’ ও ‘প্রজেক্ট গ্রাজ’ নামের আরও কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল মার্কিন বিমানবাহিনী, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায় কিছুদিন পরই। কারণ, যেসব ঘটনা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তা যতটা না রহস্যময়, তার চেয়ে উপস্থাপিত বর্ণনা ও প্রমাণগুলো অনেক অস্পষ্ট। তথ্যের অভাবই এসব ঘটনা ব্যাখ্যা করতে না পারার মূল কারণ।
২০০৭ সালে ইউএফও নিয়ে ফরাসি সরকারের গবেষণাবিষয়ক প্রচুর নথিপত্র ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর স্পেস স্টাডিজ ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করে দেয়। ৫০ বছরে ১ হাজার ৬০০ ইউএফও দেখার ঘটনা নিয়ে এ নথিপত্রে আছে ১ লাখ পৃষ্ঠার বিবরণ, ফিল্ম ও অডিও টেপ। এর প্রায় ৪৫ শতাংশ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পেরেছে তারা। বাকিগুলোতে একই সমস্যা, যথেষ্ট তথ্যের অভাব এবং অস্পষ্ট বর্ণনা বা প্রমাণ।
এখান থেকে ইউএফও নিয়ে আমরা একটি ধারণা পাই। ইউএফও নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে মূলত এসব অস্পষ্ট বর্ণনা ও তথ্যের অভাব থেকে। মানুষ অজানাকে ভয় পায়। ইউএফও নিয়ে এত হেঁয়ালি ও ভয়ের পেছনে এটি একটি বড় কারণ।
যুক্তিবিদ্যায় ‘প্রুভিং আ নেগেটিভ’ বলে একটি বিষয় আছে, ঋণাত্মক কোনো দাবি প্রমাণ করা। অর্থাৎ কিছু নেই তা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা। এটা অসম্ভব। বার্ডেন অব প্রুফ বা প্রমাণের দায় আসলে ধনাত্মক দাবি যিনি করছেন, তাঁর। মানে, যিনি কোনো কিছু আছে বলে দাবি করছেন, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, সেটি আছে। কিন্তু সেটি যে নেই, এটা প্রমাণ করা আসলে সম্ভব নয়।
উদাহরণ দিই। ধরুন, কেউ দাবি করল, পৃথিবীতে গোলাপি রঙের হাতি আছে। বিজ্ঞানীরা পুরো পৃথিবী চষে ফেললেন, স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন কোনার গুহা বা বনাঞ্চলের সবকিছু তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না গোলাপি হাতি। তাতে কী প্রমাণ হয়? পৃথিবীতে গোলাপি হাতি নেই? নিশ্চিতভাবে কি এ কথা বলা সম্ভব? যুক্তি বলে, ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এ দাবি করা সম্ভব নয়। হতেই পারে, অনাবিষ্কৃত কোনো গহিন অরণ্যে আছে অল্প কিছু গোলাপি হাতি। কাজেই ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোনো কিছু নেই, এমন দাবি করা যায় না। তবে যৌক্তিকভাবে বলা যায়, আমাদের জানা সবটুকু জ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি বলছে, এ রকম কিছু নেই। ইউএফওর বিষয়টিও ঠিক সে রকম।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। (আসলে এখনো ঠিকই আছে।) গোলটা বেধেছে প্রথম ২০১৯ সালে। তিনটি ঘটনার ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে, যাতে মার্কিন নেভির বৈমানিকেরা ইউএফও দেখতে পেয়েছেন বলে দাবি করা হয়। পরে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্বীকার করে নেয়, ভিডিওগুলো মিথ্যা নয়। তারা নিজেরাই ভিডিও তিনটি উন্মুক্ত করে দেয় সবার জন্য। পাশাপাশি তারা ইউএফও নিয়ে একটি প্রতিবেদন কিছুদিন পর উন্মুক্ত করে দেবে বলে জানায়। ৯ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদন উন্মুক্ত করা হয়েছে ২০২১ সালের ২৫ জুন। প্রতিবেদনের নাম ‘প্রিলিমিনারি অ্যাসেসমেন্ট: আনআইডেন্টিফায়েড অ্যারিয়াল ফেনোমেনা’।
৩
যুক্তরাষ্ট্রের ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের অফিস থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, আনআইডেন্টিফায়েড অ্যারিয়াল ফেনোমেনা (ইউএপি) বা শনাক্ত করা যায়নি, আকাশপথে ঘটা এ রকম ঘটনা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য না থাকায় এসব ঘটনা নিয়ে সত্যিকার কোনো উপসংহারে তারা আসতে পারছে না। এ রকম ১৪৪টি ঘটনার কথা তারা জানায়, এর মধ্যে ৮০টি ঘটনা একাধিক সেন্সরের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে।
সমস্যা হিসেবে তারা বলে, লোকে হাসাহাসি করবে, এই ভয়ে অনেকেই এ ধরনের ঘটনার কথা জানলেও কিছু বলতে চায় না বা রিপোর্ট করে না। মার্কিন সামরিক বাহিনীর কোনো বিমান বা যুদ্ধবাহনে যেসব সেন্সর থাকে, সেগুলো নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্যই ডিজাইন করা হয়। ফলে অপ্রত্যাশিত এসব ঘটনা নিয়ে সেন্সর থেকে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। সে জন্যই এ ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে।
এ রকম বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি। তবে এর ব্যাখ্যায় তারা বলেছে, সেনারা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে বলেই হয়তো তাদের চোখে এসব ঘটনা বেশি ধরা পড়ছে।
এ রকম ১৮টি ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে তারা, ২১টি রিপোর্ট বা প্রতিবেদন থেকে এসব ঘটনার কথা জানা গেছে। এতে ইউএফওগুলোকে বাতাসের ওপর স্থির থাকতে দেখা গেছে, বাতাসের বিপরীতে ছুটতে দেখা গেছে, হঠাৎ থেমে যেতে বা হুট করেই তীব্র গতিতে ছুটতে দেখা গেছে, কিন্তু ছোটার সময় কোনো প্রপালশন বা চালিকা শক্তি চিহ্নিত করা যায়নি।
এ ধরনের ঘটনাগুলোকে নিজেদের ও জনগণের জন্য সম্ভাব্য হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। বলা হয়েছে, এ নিয়ে আরও জানার জন্য প্রয়োজন অর্থায়ন ও গবেষণা। এসব বিষয়ের বিহিত কীভাবে করা যায়, তা ভেবে দেখা ও সেভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
৪
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পেছনে যে ভিডিওগুলো আছে, সেগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক। ভিডিও তিনটিতে দেখা যাওয়া ইউএফওগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘গিম্বল’ (Gimbal), ‘গো ফাস্ট’ (Go Fast) এবং ‘ফ্লার১’ (Flir1)। প্রথম ঘটনাটি ২০০৪ সালের নভেম্বরের। ফ্লার১ নামের সেই ইউএফওকে উড়তে দেখা গেছে সানদিয়াগোর তীরবর্তী এলাকায়। পরের ঘটনা দুটি ২০১৫ সালের ১৫ জুনের। ফ্লোরিডার উপকূলের এই ঘটনা দুটির ছবি তোলেন থিওডোর রুজভেল্ট নামের একটি নেভি ক্যারিয়ারের বৈমানিকেরা।
চলন্ত জেট বিমানের ক্যামেরা যখন কোনো বস্তুর ছবি তোলে, স্ক্রিনে সেটা দেখে মনে হয় ওই বস্তুটা ছুটছে। কিন্তু ক্যামেরাটাও যে ছুটছে, স্থির নয়, তা কিন্তু বোঝা যায় না। বাস্তবতা হলো, যে জেট বিমানটি ছবি তুলেছে, তার বেগ ছিল ৩৬৯ নট।
ফ্লার১–এর ছবি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। পরে ২০১৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমস এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২০ সালে পেন্টাগন যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ভিডিওগুলো উন্মুক্ত করে দেয়, তখন অনেকেই ভেবে নেয়, পেন্টাগন বহির্জাগতিক প্রাণের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে। আসল ঘটনা হলো, পেন্টাগন ভিডিওগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছে সবার দেখার জন্য। বোঝার জন্য, বহির্জাগতিক প্রাণের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
অবলোহিত আলোয় তোলা ফ্লার১–এর ছবি দেখে মনে হয়, ডিম্বাকৃতির (উপবৃত্তাকার) কোনো যান, যাতে ইঞ্জিন বা কোনো ধরনের চালিকা শক্তি দেখা যাচ্ছে না। খুব অস্পষ্ট একটি ছবি, ভিডিওতে দেখে মনে হচ্ছে উপবৃত্তাকার একটি দাগ। গিম্বলের ছবিটাও প্রায় একই রকমের। গো ফাস্টের ছবিটি কল্পনার সসারের মতো, অস্পষ্ট আকৃতিতে অন্তত তেমনটাই মনে হয়। অনেক দূর থেকে কোনো উত্তপ্ত বস্তুর ছবি তুললে তার উজ্জ্বলতা অবলোহিত ক্যামেরায় এমনই দেখানোর কথা।
ওই ভিডিওগুলো ইন্টারনেটে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর পেশাদার গবেষকদের পাশাপাশি এসব ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখেছেন গেম ডিজাইনার, ভিডিও ও ক্যামেরা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ভিডিওগুলো মোটেও রহস্যময় কিছু নয়। তীব্র গতিতে চলমান একটি বিমানের ক্যামেরার নড়াচড়া ও গতির কারণে ভিডিওগুলোতে একধরনের অপটিক্যাল ইল্যুশন বা দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি হয়েছে। বারবার বিভিন্ন কোণ থেকে ভিডিওর চেষ্টা করতে গিয়ে দ্রুতগতিতে চলমান বিমানের চালক এই হেঁয়ালি তৈরি করেছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরাগুলো বারবার ফোকাস হারিয়ে ফেলছে, বাঁ থেকে চলে যাচ্ছে ডান দিকে। এ ধরনের নড়াচড়া ও প্যারালাক্স প্রভাব মিলে তৈরি হয়েছে এই বিভ্রম। প্যারালাক্স দূরের কোনো বস্তুর দূরত্ব পরিমাপের বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। আপনার বাঁ চোখ বন্ধ করে ডান চোখের সামনে ডান হাতের একটি আঙুল তুলে ধরুন। তারপর বাঁ চোখ খুলে ডান চোখ বন্ধ করে আঙুলটির দিকে তাকান। দেখবেন, আঙুলটা কিছুটা ডানে সরে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এই বিভ্রম তৈরি হতে পারে তীব্র গতিশীল বিমানের ক্যামেরা বাঁ থেকে ডান দিকে সরে যাওয়ার সময়।
গো ফাস্টের ভিডিওটিতে সৃষ্ট হেঁয়ালির পেছনেও আছে প্যারালাক্স প্রভাব। আর আছে ত্রিমাত্রিক ছবিকে দ্বিমাত্রিকভাবে দেখার ফলে সৃষ্ট হেঁয়ালি। গো ফাস্ট নামের উড়ন্ত বস্তুটি দেখে মনে হয়, জিনিসটা ৬০ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ১ সেকেন্ডে ৫০ ফুট উচ্চতায় নেমে এসেছে। কিন্তু ত্রিকোণমিতি আর কিছুটা বিজ্ঞান ব্যবহার করে বোঝা যায়, বিষয়টা অন্য রকম হতে পারে।
চলন্ত জেট বিমানের ক্যামেরা যখন কোনো বস্তুর ছবি তোলে, স্ক্রিনে সেটা দেখে মনে হয় ওই বস্তুটা ছুটছে। কিন্তু ক্যামেরাটাও যে ছুটছে, স্থির নয়, তা কিন্তু বোঝা যায় না। বাস্তবতা হলো, যে জেট বিমানটি ছবি তুলেছে, তার বেগ ছিল ৩৬৯ নট। অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ৬৮৩ কিলোমিটার বেগে। আর জেট বিমানটি ছিল ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। বিমানের অবস্থান ও এই বেগ হিসাবে নিয়ে ত্রিকোণমিতির সূত্রে বসালে বোঝা যায়, যে বস্তুটির ছবি তোলা হয়েছে, তা অন্তত ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল। সে ক্ষেত্রে বস্তুটির বেগ হতে পারে সর্বোচ্চ ২৮ থেকে ১০০ নটের মতো। অর্থাৎ ঘণ্টায় বস্তুটির বেগ ছিল সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটারের মতো। সমুদ্রপৃষ্ঠ ও জেট বিমানটির মাঝামাঝি উচ্চতায় উড়ছিল বস্তুটি, সে জন্যই সৃষ্টি হয়েছে এই হেঁয়ালি। ভিডিওতে তাই মনে হচ্ছে, বস্তুটি সমুদ্রপৃষ্ঠের একবারে কাছাকাছি উড়ছে। (এই ছোট্ট লেখায় বিস্তারিত হিসাবটি আর যুক্ত করব না। আগ্রহীরা চাইলে বিস্তারিত পড়তে পারবেন তথ্যসূত্র থেকে।)
এখন আসল প্রশ্ন, গো ফাস্ট বস্তুটা আসলে কী? উত্তর, এই বেগ ও অবস্থান এবং সম্ভাব্য আকৃতি দেখে মনে হয়, জিনিসটি একটি বেলুন হতে পারে। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কি বলা যায়? না। যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকায় তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের জানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান ব্যবহার করে অনেক বিশ্লেষকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং ভিডিওগুলো নিয়ে প্রচুর কাটাছেঁড়ার পর প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বেলুনই হওয়ার কথা। তবে বেলুন যদি না–ও হয়, জিনিসটা যে বহির্জাগতিক কোনো প্রযুক্তি নয়, তা মোটামুটি নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়।
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের অভাবে আমরা অনেক ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না। দৃষ্টিবিভ্রম বা মানবিক তাড়না ও অজানার ভয় আমাদের মনে বিচিত্র কল্পনার সৃষ্টি করে। একটি ঘটনাকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাখ্যা করা না গেলেও অবাস্তব বা অসম্ভব কিছু ভেবে নেওয়ার আগে তা নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সব ব্যাখ্যাকে বাতিল করে দিতে হবে। তারপর জিনিসটাকে নতুন কিছু বলে ধরে নেওয়া যাবে, তার আগে নয়।
বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ইউএফও নিয়ে এমন কোনো ঘটনা পাননি, যা নতুন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। তবে অনেক ঘটনা এখনো শতভাগ নিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি তথ্য ও উপাত্তের অভাবে। সেই ঘটনাগুলোকেই বলা হয় ইউএপি বা আনআইডেন্টিফায়েড অ্যারিয়াল ফেনোমেনা। অর্থাৎ ঘটনাগুলো রহস্যময় কিছু নয়, বরং এগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নেই আমাদের কাছে। তবে ‘ইউএপি’ বা ‘ইউএফও’ শব্দগুলো আমাদের মস্তিষ্কে যে বহির্জাগতিক প্রাণের চিত্র তুলে ধরে, তার সঙ্গে এসব ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত আমাদের জানা বিজ্ঞান তা-ই বলে।
৫
এখন পর্যন্ত ইউএফও দেখার যেসব ঘটনা নিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে, তার প্রতিটিতেই কিছু নির্দিষ্ট বিষয় বা ব্যাখ্যা দেখা গেছে। সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে কিছুটা বলি।
এক. আবহাওয়া ও গবেষণা বেলুন। রাতের আকাশে, অন্ধকারে এ ধরনের বেলুন দেখতে অদ্ভুত লাগতে পারে কারও চোখে। বিশেষ করে চলন্ত উড়োযান থেকে ছবি তুললে তৈরি হতে পারে হেঁয়ালি। ১৯৪৭ সালে নিউ মেক্সিকোর রসওয়েলে এলিয়েন নভোযান বিধ্বস্ত হওয়ার এক গুজব শোনা যায়। পরে জানা যায়, ওটা ছিল প্রজেক্ট মোগুলের একটি অনিয়ন্ত্রিত বেলুন।
দুই. রাডারের প্রতিধ্বনি। দূরের পাহাড়-পর্বতে রাডারের তরঙ্গ বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। রাডার মনিটরে এসব প্রতিধ্বনিকে দেখায় আঁকাবাঁকা।
ঠিক এ রকম কিছু সম্ভাবনা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ৯ পৃষ্ঠার রিপোর্টটিতেও। বিভিন্ন ঘটনাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছে তারা। এক. বিভিন্ন ধরনের পাখি, বেলুন বা মজা করে ওড়ানো ড্রোন ইত্যাদি। দুই. বায়ুমণ্ডলের কোনো প্রাকৃতিক অস্বাভাবিক ঘটনা।
তিন. বিভিন্ন ধরনের বিমান। একাধিক ইউএফওর গুজবে দেখা গেছে, জিনিসটা আসলে ছিল মার্কিন সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো দেশের সামরিক বাহিনীর গোপন কোনো প্রজেক্টের উন্নত মানের বিমান। প্রজেক্টগুলো গোপন রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের গুজব ও দৃষ্টিবিভ্রমের কথা ছড়িয়ে দিয়েছে সে দেশের সামরিক বাহিনী।
চার. ইচ্ছাকৃত গুজব ছড়ানো। এ ধরনের অনেক গুজব আছে। একটি মজার উদাহরণ পাওয়া যায় মিচিও কাকুর ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল বইতে। বিখ্যাত পরিচালক জর্জ অরসন ওয়ালেস মার্কিন দর্শকদের সঙ্গে মজা করার জন্য এইচ জি ওয়েলসের ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ড গল্পের পটভূমি বেছে নেন একবার। গল্পের মতো করে সিবিএস ন্যাশনাল রেডিওতে অন্য একটি অনুষ্ঠানের মাঝখানে সংক্ষেপে ঘোষণা প্রচার করতে থাকেন তিনি, মঙ্গলবাসীরা পৃথিবী আক্রমণ করেছে! ডেথ রে ছুড়ছে তারা! লাখো মার্কিন ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে সেই এলাকা ছেড়ে। পরের দিনের সংবাদপত্রে জানা যায়, অনেক প্রত্যক্ষদর্শী নাকি বিষাক্ত ঝাঁজালো গ্যাসের গন্ধ পেয়েছে, অদ্ভুত ধরনের আলোর ঝলক দেখেছে দূর থেকে! প্রত্যক্ষদর্শীদের এমন দাবির বিষয়টা ইউএফও গুজবের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।
এ ছাড়া শুক্র গ্রহকে দূর থেকে দেখে অনুসরণ করছে বলে মনে হওয়া, উল্কাপাত বা বজ্রপাত ও বায়ুমণ্ডলে অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে দেখলে বিভ্রান্ত হতে পারে মানুষ। আবার অনেক জলাভূমি এলাকায় তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সেখানকার গ্যাস মাটি থেকে ওপরে উঠে ভাসতে দেখা যায়। সামান্য জ্বলজ্বলে এসব গ্যাস অনেক সময় ছোট ছোট গ্যাস প্যাকেটে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দূর থেকে এ রকম কিছু দেখলে বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।
ঠিক এ রকম কিছু সম্ভাবনা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ৯ পৃষ্ঠার রিপোর্টটিতেও। বিভিন্ন ঘটনাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছে তারা। এক. বিভিন্ন ধরনের পাখি, বেলুন বা মজা করে ওড়ানো ড্রোন ইত্যাদি। দুই. বায়ুমণ্ডলের কোনো প্রাকৃতিক অস্বাভাবিক ঘটনা। তিন. সামরিক বাহিনীর গোপন বিভিন্ন বিমান ও এই ধরনের প্রযুক্তি। ক্ল্যাসিফায়েড বা গোপনীয় বলে যেগুলোর কথা সামরিক বাহিনীরও অনেকে জানেন না। চার. চীন, রাশিয়া ও উন্নত বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি। আর পাঁচ. এমন কিছু ঘটনা, যা তথ্য-উপাত্তের অভাবে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি। মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য অন্য দেশের কোনো প্রযুক্তি শনাক্ত করতে না পারাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ইউএপি বা তথ্যের অভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি এ ধরনের ঘটনা, এত উদ্বেগের মূল কারণ আসলে সেটিই।
অর্থাৎ তথ্যের অভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, এমন অনেক ঘটনা বা ইউএপির বিষয়টি মিথ্যা না। তবে এসব ঘটনাকে বাড়তি রং চড়িয়ে বহির্জাগতিক প্রাণ বা ভিনগ্রহের ভয়ংকর কোনো প্রযুক্তি বলে আখ্যা দেওয়ার কারণ নেই।
