সূর্য শক্তি পায় কোথা থেকে

সূর্য নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আদিকাল থেকে। কিন্তু ১৯ শতকের আগ পর্যন্ত কেউই জানত না, সূর্যে শক্তি তৈরি হয় কীভাবে। অনেক দিন ধরে খোদ বিজ্ঞানীদের কাছেও রহস্যময় ছিল ব্যাপারটা। পরমাণুর গভীরে উঁকি দিয়ে অতিপারমাণবিক কণা সম্পর্কে জানার পর অবশেষে বোঝা সম্ভব হয় এর পেছনের কার্যকারণ।

শুরু করি পুরোনো কথা দিয়েই। মহাবিশ্বে লাখো-কোটি নক্ষত্র থাকলেও ৪৫০ কোটি বছর বয়সী পুরোনো সূর্যই আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবী থেকে যার গড় দূরত্ব ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার। আলোর বেগে চললে এই দূরত্ব পেরোতে লাগে প্রায় সাড়ে ৮ মিনিট। এত দূরে থেকেও মহাকর্ষ বলে পৃথিবীসহ আরও ৭টি গ্রহকে নিজের শাসনে বেঁধে রেখেছে সূর্য। নক্ষত্রটি না থাকলে কী হতে পারত, সেটা ভাবাও মুশকিল। সূর্য না থাকলে আমাদের সৌরজগতে কোনো আলো থাকত না, উষ্ণতা থাকত না, সেই সঙ্গে পৃথিবীতে থাকত না প্রাণের বিন্দুমাত্র কোনো স্পন্দনও। এ নক্ষত্র থেকে আসা আলো আর তাপের কারণেই পৃথিবীতে জীবন টিকে আছে।

হিসাবে করে দেখা গেছে, ১ সেকেন্ডের ১৫ লাখ ভাগের ১ ভাগ সময়ে সূর্য যে পরিমাণ শক্তি, তাপ ও আলো উৎপাদন করে, তা দিয়ে বর্তমান বিশ্বের সব মানুষ পুরো এক বছর ব্যবহার করেও শেষ করতে পারবে না। সূর্যের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৫ হাজার ৮০০ কেলভিন। আর কেন্দ্রের তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন কেলভিন (১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস)। এর ছিটেফোঁটা মাত্র পৃথিবীতে পাই আমরা। পুরোটা পেলে কী হতে পারত সেই ভয়ংকর কল্পনা না করাই ভাল। প্রশ্ন হলো, সূর্যে এত শক্তি, আলো বা তাপের উৎস কী?

এ প্রশ্নটা নিয়ে আজকেই প্রথম নয়, অনেক আগে থেকে ভেবেছে মানুষ। মানবজাতির চিন্তাভাবনার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর উত্তরেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যেমন অনেক অনেক আগে একসময় ভাবা হতো, সূর্যের পেটের ভেতর বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুত আছে। সেগুলো পুড়ে পুড়ে তাপ আর আলো তৈরি হয়। এরকম ভাবনার পেছনে কয়লাচালিত ইঞ্জিনের যে প্রভাব ছিল, তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

কয়লার জ্বালানি ব্যবহার করে বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবনের পর উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে বিজ্ঞানীরা তাপসম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হন। ফরাসি প্রকৌশলী নিকোলা লিওনার্দো স্যাদি কার্নো এবং এমিল ক্ল্যাপিরন বাষ্পীয় ইঞ্জিন নিয়ে বেশ কিছুদিন গবেষণা করেছিলেন। এ থেকে তাঁরা তাপের সঙ্গে ইঞ্জিনের শক্তির একটা সম্পর্ক খুঁজে পান। এভাবেই একসময় জন্ম নেয় পদার্থবিজ্ঞানের নতুন একটি শাখা, থার্মোডাইনামিকস বা তাপগতিবিদ্যা। ১৮৪০ সালের দিকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস প্রেসকট জুল এক পরীক্ষা চালান। ব্যবসায়িক কারণে পদার্থবিদ্যার দিকে ঝুঁকেছিলেন বিজ্ঞানী জেমস জুল। তাঁর তত্ত্বমতে, যেকোনো শক্তির উৎস সসীম হতে বাধ্য, কিন্তু সূর্যকে দেখে মনে হতো তার জ্বালানি বোধ হয় অফুরন্ত। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই সূর্যে কোনো অনিঃশেষ শক্তির উৎস আছে ভেবে সেকালে ভীষণ অবাক হন বিজ্ঞানীরা।

দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এবং গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ পিয়েরে সাইমন ল্যাপ্লাস মনে করতেন, বিপুল পরিমাণ গ্যাস ঘনীভূত হয়ে সূর্যের জন্ম হয়েছে। তত্ত্বটি এখনো সত্য বলেই মনে করা হয়। তাদের তত্ত্বের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিজ্ঞানী হেলমনজও। তিনি ১৮৫৪ সালে জানান, বিপুল ঘনীভূত গ্যাসের কারণে সূর্যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়। তবে ১৮৯০-এর দশকে এসে ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম থমসন (যিনি লর্ড কেলভিন নামে পরিচিত) এ মতের বিরোধিতা করেন। কেলভিন বেশ খেটেখুটে সূর্যের বয়স হিসেব করেছিলেন। এরপর তিনি দাবি করেন, সূর্যের বয়স ৪০ মিলিয়ন বছরের বেশি কোনোভাবেই হতে পারে না। কিন্তু বেশ কজন ভূতাত্ত্বিক ও জীববিজ্ঞানী তা মানতে পারলেন না তাঁর কথা। তাঁদের একজন ছিলেন বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন। তাঁর হিসাবে খোদ পৃথিবীর বয়সই এর চেয়ে বেশি হওয়ার কথা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে বিজ্ঞানীদের হাতে আরও তথ্যপ্রমাণ এল। তাতে দেখা গেল, পৃথিবীর বয়স ১ বিলিয়ন বছরের চেয়ে বেশি। তাহলে পৃথিবী কি সূর্যের চেয়ে বুড়ো হতে পারে? মানে, মায়ের চেয়ে পুত্রের বয়স কী বেশি হয়?

একটা সম্ভাব্য সমাধান হাতে নিয়ে দৃশ্যপটে এলেন মার্কিন ভূতত্ত্ববিদ থমাস চ্যাম্বারলিন। সেটা ১৮৯৯ সালের কথা। ফরাসি পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেলের গবেষণার কারণে তত দিনে রহস্যময় তেজস্ক্রিয় শক্তি সম্পর্কে মানুষ বুঝতে শুরু করেছে। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনের অস্তিত্বও আবিষ্কার করে ফেলেছেন জে জে টমসন। পরমাণুর একটি মডেলও প্রস্তাব করেছেন তিনি। সেটা প্লুম-পুডিং মডেল নামে পরিচিত, মানে পুডিংয়ের ওপর কিসমিস মডেল। যাইহোক, চ্যাম্বারলিন বললেন, সূর্যের ভেতর এমন কোনো শক্তির উৎস থাকতে পারে, যা হয়ত আমাদের অজানা। সেই শক্তি পারমাণবিক কিংবা অতিপারমাণবিক কিছুও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। কিন্তু লর্ড কেলভিন তা এককথায় নাকচ করে দেন। অবশ্য ১৯০৩ সালের দিকে ফরাসি পদার্থবিদ পিয়েরে আর মেরি কুরি দম্পতির রেডিয়াম নিয়ে গবেষণা চ্যাম্বারলিনের মতের পক্ষে রায় দিল। তাই এ বিষয়ে কেলভিনের নাক সিটকানিটা পাত্তা দিলেন না তেমন কেউ।

হিসাবে দেখা গেছে, ১ সেকেন্ডের ১৫ লাখ ভাগের ১ ভাগ সময়ে সূর্য যে পরিমাণ শক্তি, তাপ ও আলো উৎপাদন করে, তা দিয়ে বর্তমান বিশ্বের সব মানুষ পুরো এক বছর ব্যবহার করেও শেষ করতে পারবে না

রেডিয়াম আর ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থ তখনো পদার্থবিদদের কাছে বেশ রহস্যময়। অদ্ভুত কোনো তাপীয় উৎসের কারণে পদার্থগুলো গরম হয়ে থাকে। নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং ব্রিটিশ পদার্থবিদ ফ্রেডরিক সোডির যৌথ গবেষণায় বোঝা সম্ভব হলো, তেজস্ক্রিয়তাই আসলে এ তাপের কারণ। তাঁরা বললেন, এভাবে বড় পরমাণু বিভাজিত হয়ে বা ভেঙে ছোট ছোট পরমাণু গঠিত হয়। আর নতুন গঠিত পরমাণুগুলোর মোট ভর আসল পরমাণুর চেয়ে কম হয়। তাহলে বাকি ভরটা কোথায় যায়? তাঁরা বললেন, আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 অনুযায়ী, এই ভর বিপুল পরিমাণ শক্তিতে পরিণত হয়। কাজেই পৃথিবীর কেন্দ্রে পারমাণবিক ফিশন বা বিভাজন প্রক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হতে পারে মত দিলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে এক ধাপ এগিয়ে এই্ বিজ্ঞানীদ্বয় অনুমান করলেন, সূর্যের তাপের উৎসের পেছনেও এই প্রক্রিয়া হতে পারে। এতে অবশেষে সমাধান পাওয়া গেছে ভেবে অনেকেই ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে ওঠেন এমন অবস্থা। কিন্তু তাঁদের মুখের হাসি বেশি দিন টিকল না।

কারণ, সূর্যের তাপের উৎস নিয়ে যখন বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই সব বাদানুবাদ চলছে, তখন জ্যোতির্বিদেরা সূর্যে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাসের মজুত দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখলেন, সূর্য হলো হাইড্রোজেন গ্যাসের বিশাল একটা বলের মতো। এর সঙ্গে অল্প পরিমাণে থাকে হিলিয়াম, অক্সিজেন আর কার্বনসহ আরও কিছু মৌল। অনেকের হয়তো জানা আছে, হিলিয়াম মৌলটি প্রথম পৃথিবীতে নয়, সূর্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। সে কারণেই সূর্যের গ্রিক প্রতিশব্দ হেলিয়স থেকে মৌলটির নাম হয়েছে হিলিয়াম। সে যা–ই হোক, সূর্যে ইউরেনিয়াম কিংবা রেডিয়ামের মতো কোনো তেজস্ক্রিয় মৌলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল বটে। কিন্তু তার পরিমাণ এতই অল্প যে তা দিয়ে বিশাল আকৃতির সূর্যের এত বিপুল তাপ উৎপন্ন হওয়ার কথা নয়। তাহলে? আবার নড়েচড়ে বসে আরেক দফা মাথা ঘামাতে লাগলেন বিজ্ঞানীরা।

১৯১৫ সালের দিকে মার্কিন রসায়নবিদ নতুন একটা কথা বললেন। একদিন তাঁর মাথায় প্রশ্ন এল, পরমাণুর নিউক্লিয়াস যদি ভেঙে দুই টুকরো হতে পারে, তাহলে ছোট দুটি পরমাণু কি ফিউজ বা একত্র হয়ে বড় কোনো পরমাণু গঠন করতে পারে? বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি বললেন, হাইড্রোজেন পরমাণুরা ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম পরমাণু গঠন করে। আর E=mc2 সূত্র মেনে এই প্রক্রিয়াতেও ফিশনের মতোই বিপুল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই তত্ত্ব তখনো প্রমাণিত নয়। তার পেছনে কিছু কারণও ছিল।

আরও পড়ুন
কানাডার সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরিতে ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব

যেমন তখনো নিউট্রন কণা আবিষ্কৃত হয়নি। আর নিউট্রন কণা ছাড়া হাইড্রোজেনের চেয়ে বড় কোনো মৌল কীভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে পারে, তা তখনো অজানা ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটিমাত্র প্রোটন থাকে। কিন্তু হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস থাকে দুটি প্রোটন। আর প্রোটন যেহেতু ধনাত্মক চার্জধর্মী, তাহলে নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন কীভাবে টিকে থাকে? ওদের তো পরস্পরকে বিকর্ষণ করার কথা। ১৯২০ সালের দিকে নতুন একটি কণার কথা স্বাধীনভাবে অনুমান করলেন দুজন বিজ্ঞানী। এদের একজন ছিলেন রাদারফোর্ড। পরমাণু কেন্দ্রের নতুন এই কণার নাম দেওয়া হলো নিউট্রন, যা নিউট্রাল বা চার্জনিরপেক্ষ বলেই এমন নাম। এর প্রায় এক যুগ পর, মানে ১৯৩২ সালে সত্যি সত্যিই এ রকম একটি কণা আবিষ্কার করলেন জেমস চ্যাডউইক। এই আবিষ্কার সূর্যের তাপের উৎস সংক্রান্ত সমস্যার মোড় ঘুরিয়ে দিল।

১৯৩৯ সালে জার্মান পদার্থবিদ হ্যান্স বেথে করলেন আরেক চমকপ্রদ কাজ। নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় সূর্যের ভেতর হাইড্রোজেন থেকে কীভাবে হিলিয়াম মৌল তৈরি হয়, তা ব্যাখ্যা করলেন তিনি। সূর্যের মতো কম ভরের নক্ষত্রগুলোর জন্য প্রোটন-প্রোটন মেকানিজমের প্রস্তাব করলেন বেথে। তিনি বললেন, সূর্যের কেন্দ্রে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটনগুলো (হাইড্রোজেন নিউক্লিও) পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়বে। কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের প্রভাবের কারণে প্রোটনগুলো পরস্পরের প্রতি ইলেকট্রস্ট্যাটিক বিকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারবে। এভাবে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিও বা প্রোটন পরস্পরের সঙ্গে একত্র হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করবে, যার মধ্যে থাকবে দুটি প্রোটন। তবে এটি টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু বেথে হিসাব করে দেখলেন, কেন্দ্রের দুটো প্রোটনের মধ্যে একটি যদি নিউট্রনে রূপান্তরিত হয় এবং তার মধ্যে যদি দুটি প্রোটন এবং দুটি নিউট্রন থাকে, তাহলে সেটি স্থিতিশীল হয়ে টিকে থাকবে। আর যে হাইড্রোজেন নিউক্লিওগুলো মিলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠিত হলো, তাদের মোট ভরের চেয়ে এই হিলিয়ামের ভর কম হবে। এই বাকি ভরটাই পরিণত হবে বিপুল শক্তিতে।

তবে তখন পর্যন্ত এটি শুধু একটি তত্ত্ব। নক্ষত্রে বা সূর্যে সত্যিই এমন কোন কাণ্ড ঘটে কি না, তার কোনো বাস্তব প্রমাণ বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে এর সত্যতা কি প্রমাণ করা সম্ভব? আঁতিপাঁতি করে তারই খোঁজ চলতে লাগল বিজ্ঞানজগতে।

সূর্যে যে বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদিত হয়, তাকে বলে প্রোটন-প্রোটন চেইন বিক্রিয়া। এ বিক্রিয়ার প্রধান জ্বালানি হাইড্রোজেন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সূর্যের ভেতরে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে দুটো প্রোটন একত্র হয়ে দুটো ডিউটেরন তৈরি করে

এমন সময় দৃশ্যপটে আবির্ভাব হলো নতুন একটি কণা। নাম তার নিউট্রিনো। নামটি দিয়েছিলেন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। ‘ছোট নিউট্রন’ বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি। সেই শব্দই পরে জনপ্রিয় হয়। তবে কণাটির কথা প্রথম বলেছিলেন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি, ১৯৩০ সালে। তিনি এক অজানা ভরহীন কণার কথা বললেন, যা বেটা পার্টিকেলের সঙ্গে নিঃসৃত হয়। ১৯৫৫ সালে সত্যি সত্যিই অজানা সেই কণা আবিষ্কৃত হলো। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, এই কণা বলতে গেলে কারও সঙ্গেই মিথস্ক্রিয়া করে না। শুধু তা–ই নয়, এই রহস্যময় কণাটি বেটা ক্ষয় নামের বিশেষ একধরনের তেজস্ক্রিয়তা থেকে শক্তি বহন করে নিয়ে যায়। এই বিক্রিয়ায় একটা পারমাণবিক নিউক্লিয়াসে একটা নিউট্রন রূপান্তরিত হয় প্রোটনে এবং একটা বেটা কণা নিঃসরণ করে। শিগগিরই কয়েক ধরনের বেটা ক্ষয়ের প্রমাণ পাওয়া গেল। একধরনের বেটা ক্ষয়ে প্রোটন নিউট্রনেও রূপান্তরিত হয়। ঠিক হ্যান্স বেথে যেমনটি সূর্যে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বলেছিলেন।

তাহলে এই বিশেষ ধরনের নিউট্রিনোর অস্তিত্ব যদি প্রমাণ করা যায়, আর তার উৎস সূর্য যদি প্রমাণ করা যায়, তাহলেই প্রমাণিত হবে হ্যান্স বেথের তত্ত্ব। সেই সঙ্গে জানা যাবে, সূর্যে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। তাই নিউট্রিনো শিকার করতে জাল ফেলার কথা ভাবলেন একদল বিজ্ঞানী। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, খোদ নিউট্রিনো কণা নিজেই। আগেই বলেছি, কণাটি বলতে গেলে কারও সঙ্গেই বিক্রিয়া করে না। তাই তাকে শনাক্ত করাও বিজ্ঞানীদের জন্য কঠিনতম কাজ। তাতে কি আর কৌতূহলী বিজ্ঞানীদের দমানো যায়! তাঁরাও বসে থাকলেন না। অনেক গবেষণার পর দেখা গেল, বিশেষ ধরনের এক জাল বা ডিটেক্টর দিয়ে নিউট্রিনো শনাক্ত করা সম্ভব। সে জন্য কানাডার অন্টারিওর সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরিতে মাটির নিচে বসানো হলো বিশাল আকৃতির এক ডিটেক্টর। সেখানে বল আকৃতির কনটেইনারে এক হাজার টন ভারী পানি (ডিউটেরিয়াম) ভর্তি করা হলো। এ ছাড়া কনটেইনারের চারপাশে রাখা হলো ৯ হাজার ৫০০টি ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব।

কিন্তু এসব আয়োজনের কারণ কী? আসলে নিউট্রিনো কণা ডিউটেরিয়াম নিউক্লিওর সঙ্গে বিক্রিয়া করে ইলেকট্রন তৈরি করে। প্রতিটি সংঘর্ষে একটি নিউট্রিনো একটি ডিউটেরিয়ামে (যার মধ্যে একটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন থাকে) আঘাত করে একটি ইলেকট্রন বের করে দেয়। এই ইলেকট্রন আলোর চেয়েও বেশি গতিতে ডিউটেরিয়ামের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। আর এটি করতে গিয়ে যে ঘটনাটি ঘটে, তাকে বলা হয় চেরনকভ বিকিরণ। এতে আলোর শঙ্কু তৈরি হয়, যা বিমান থেকে উৎপন্ন সনিক বুম শোনার মতো। ডিটেক্টরে থাকা ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবগুলো আলোক শঙ্কুগুলো এবং তাদের সজ্জা শনাক্ত করতে পারে। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা এই ডিটেক্টরে এ ধরনের কিছু শনাক্ত হলে বোঝা যায় নিউট্রিনোগুলোর উৎস সূর্য। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হলো হ্যান্স বেথের তত্ত্বও সঠিক। ২০০১ সালে সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরিতে তিন ধরনের নিউট্রিনো শনাক্ত করার মাধ্যমে সেটি প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, এখান থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, নিউট্রিনোর ভরও আছে।

আরও পড়ুন

এখন আমরা জানি, সূর্যে যে বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদিত হয়, তাকে বলে প্রোটন-প্রোটন চেইন বিক্রিয়া। এ বিক্রিয়ার প্রধান জ্বালানি হাইড্রোজেন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সূর্যের ভেতরে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে দুটো প্রোটন একত্র হয়ে দুটো ডিউটেরন তৈরি করে। এরপর প্রতিটি ডিউটেরন আরেক প্রোটনের সঙ্গে একত্র হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম-৩। দুটো হিলিয়াম-৩ আবার এরপর একত্র হয়ে তৈরি করে বেরিলিয়াম-৬। কিন্তু এটি টিকে থাকতে পারে না। তাই ভেঙে আবারও দুটি প্রোটন এবং হিলিয়াম-৪-এ পরিণত হয়। এ নিউক্লিয়াস ফিউশনের কারণে সূর্যে এই বিপুল তাপ, আলো এবং শক্তি তৈরি হচ্ছে।

হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি সেকেন্ড ৬০০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হচ্ছে হিলিয়ামে। এ প্রক্রিয়ায় আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী, সেকেন্ডে ৪ মিলিয়ন টন ভর রূপান্তরিত হচ্ছে শক্তিতে। আর তার ফলে তৈরি হচ্ছে অকল্পনীয় পরিমাণ তাপ, শক্তি আর আলো। এভাবে প্রতি সেকেন্ডে ৩.৮৪৬×১০২৬ ওয়াট শক্তি তৈরি হচ্ছে সেখানে। বলে রাখা ভালো, সূর্যের কেন্দ্রে তৈরি হওয়া এই শক্তি বা আলো বাইরে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার বছর। তবে সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৮ মিনিট। তাই আজকে সূর্য থেকে যে আলো ও তাপ পাচ্ছি, তা কত পুরোনো তা একবার ভেবে কারও কারও ভ্রু কুঁচকে উঠতে পারে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এভাবে চলতে থাকলে সূর্যে হাইড্রোজেন জ্বালানি কি কখনো শেষ হবে না? হ্যাঁ, হবে। বিজ্ঞানীদের হিসাবে, সূর্যে এ মুহূর্তে হাইড্রোজেন জ্বালানি আছে তার মোট ভরের প্রায় ৭৫ ভাগ। যার পরিমাণ প্রায় ৬০০ মিলিয়ন টন। চুলচেরা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর বা ৪৫০ কোটি বছর বয়সী সূর্যে যতটুকু হাইড্রোজেন আছে, তা দিয়ে আরও ৪৫০ কোটি বছর অনায়াসে চলে যাবে। তারপর জ্বালানি ফুরিয়ে এখনকার চেয়ে ১০০ গুণ বড় হয়ে বিশাল লাল দানবে পরিণত হবে আমাদের চিরচেনা সূর্য। তখন বুধ আর শুক্র গ্রহকে গিলে খেয়ে পৃথিবীর ঘাড়ের ওপর ফেলতে থাকবে চরম গনগনে নিশ্বাস। পৃথিবীর অবস্থা তখন কেমন ভয়াবহ হবে, তা বর্ণনা না করাই ভালো। লাল দানবই শেষ কথা নয়, এরপর সূর্য আবার চুপসে গিয়ে প্রথমে শ্বেতবামন তারপর কৃষ্ণবামনে পরিণত হবে। এভাবেই একদিন তছনছ হবে গোটা সৌরপরিবার। তবে আগেই বলেছি, সেটি ঘটতে সময় লাগবে আরও অন্তত ৪৫০ কোটি বছর। তাই আপাতত দুশ্চিন্তা করে ঘুম নষ্ট না করাই ভালো।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিবিসি ফোকাস, উইকিপিডিয়া, স্পেসডটকম