ইউরোপ ও আফ্রিকার মাঝখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটার জলপথ, সেতু নেই কেন
ইউরোপ থেকে আফ্রিকা, অথবা উল্টোভাবে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ। মাঝখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটার জলপথ। আরেকটু খুলে যদি বলি: ইউরোপের শেষ মাথায় স্পেন, আর আফ্রিকার শুরুতে মরক্কো। মাঝখানে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জিব্রাল্টার প্রণালী।
‘জিব্রাল্টার’ নামটি আরবি নাম জাবাল-আল তারিক (جبل طارق) থেকে এসেছে। কথাটার অর্থ ‘তারিকের পাহাড়’। হযরত তারিক ইবনে জিয়াদ ৭১১ সালে আফ্রিকা থেকে এই জিব্রাল্টার প্রণালী পাড়ি দিয়েই স্পেনে পৌঁছেছিলেন। এই জলপথে এসে মিলে গেছে সুবিশাল আটলান্টিক মহাসাগর (বাংলায় যাকে বলে অতলান্তিক) এবং ভূমধ্যসাগর। মাঝখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটার, অথচ এই জায়গায় এতদিনেও কোনো ব্রিজ বানানো হয়নি। বিষয়টা অদ্ভুত না?
কতটা অদ্ভুত, সেটা বুঝতে এই জিব্রাল্টার প্রণালী কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা খুলে বলা প্রয়োজন। এই প্রণালী পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত জলপথ। প্রতিদিন শত শত জাহাজ এই প্রণালী দিয়ে যাতায়াত করে। গড়ে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ জাহাজ আসা-যাওয়া করে এই পথে। বহু পণ্য পরিবহনে এটি কাজে লাগে। এক ক্রুড অয়েলের (এ থেকেই তৈরি হয় জ্বালানি তেল) হিসাব শুনলেই বুঝবেন বিষয়টা। প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল পরিবহণ করা হয় এ পথ ধরে। এসবের পেছনের কারণটা খুব সোজা। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার এটাই একমাত্র প্রাকৃতিক পথ। এই প্রণালী যদি না থাকত, তবে ইউরোপের দেশগুলোকে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে পণ্য আনা-নেওয়া করতে হতো। এতে সময় এবং খরচ—দুটোই বেড়ে যেত অনেক।
যেহেতু আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগর এখানে একসঙ্গে মিশেছে, তাই পানির নিচে প্রচণ্ড শক্তিশালী স্রোত তৈরি হয়। একদিকে আটলান্টিকের ঠান্ডা পানি ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করে, আবার ভূমধ্যসাগরের উষ্ণ পানি বেরিয়ে যায় আটলান্টিকের দিকে।
এবারে চিন্তা করুন, এখানে একটা সেতু আছে। জ্যাম না থাকলে মাত্র ৩০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যেত এটুকু পথ। ঠিক ধরেছেন, এ পথে ৩০ মিনিটে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ কিংবা ইউরোপ থেকে আফ্রিকায় যাতায়াত করা যেত। এত গুরুত্বপূর্ণ, স্বল্প দূরত্বের একটা জায়গায় আজও কোনো কোনো সেতু বানানো হয়নি। কেন?
কারণটা হয়তো আপনিও অনুমান করতে পারছেন। এই জায়গায় সেতু বানানো প্রায় অসম্ভব। এর পেছনে কয়েকটা বড় বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। প্রথম কারণ, পানির গভীরতা। এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জিব্রাল্টার প্রণালীর গভীরতা স্থানভেদে প্রায় ৩০০ থেকে ৯০০ মিটার (প্রায় ৩ হাজার ফুট)। একটা সেতুর জন্য মজবুত পিলার বা খুঁটি বানাতে হলে সেগুলোকে সমুদ্রের তলদেশে, মাটির অনেক গভীরে স্থাপন করতে হয়। এত গভীরে পিলার স্থাপন করা বর্তমান প্রযুক্তিতে অত্যন্ত কঠিন এবং ব্যয়বহুল।
দ্বিতীয় কারণ, এ জায়গার ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি। জিব্রাল্টার প্রণালী এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দুটি বিশাল টেকটোনিক প্লেট—ইউরেশিয়ান প্লেট এবং আফ্রিকান প্লেট—একসঙ্গে মিশেছে। এই দুটি প্লেট পরস্পরকে ধাক্কা দিচ্ছে নিয়মিতই। ফলে এলাকাটি ভূমিকম্পপ্রবণ। অর্থাৎ, এখানে সেতু নির্মাণ করলে সামান্য ভূমিকম্পেই তা ভেঙে পড়ার বড় ঝুঁকি থাকবে।
হুবার এ অঞ্চলে সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা বাতিল করতে হয়েছে। প্রথম ১৯৭৯ সালে স্পেন ও মরোক্কো এই জলপথে সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে যৌথ কমিটি গঠন করে।
তৃতীয় কারণ, প্রচণ্ড স্রোত এবং বাতাস। যেহেতু আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগর এখানে একসঙ্গে মিশেছে, তাই পানির নিচে প্রচণ্ড শক্তিশালী স্রোত তৈরি হয়। একদিকে আটলান্টিকের ঠান্ডা পানি ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করে, আবার ভূমধ্যসাগরের উষ্ণ পানি বেরিয়ে যায় আটলান্টিকের দিকে। এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতের কারণে সেতুর পিলারগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। শুধু উষ্ণ ও শীতল পানিই নয়, বিপরীতমুখী বায়ুস্রোতও বয়ে যাচ্ছে এখানে নিরবধি। এর একটির নাম লেভান্তে (Levante)। উষ্ণ, শুষ্ক এই বায়ু পূর্বের ভূমধ্যসাগরের দিক থেকে আসে। আর পশ্চিমে অতলান্তিকের দিক থেকে আসে পোনিয়েন্তে নামে শীতল, আর্দ্র বাতাস। এই দুই বিপরীতমুখী প্রবল বাতাসের স্রোত সেতুর কাঠামোকে নিয়মিতই চ্যালেঞ্জ জানাবে, বুঝতেই তো পারছেন।
এই সব মিলে, বহুবার এ অঞ্চলে সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা বাতিল করতে হয়েছে। প্রথম ১৯৭৯ সালে স্পেন ও মরোক্কো এই জলপথে সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে যৌথ কমিটি গঠন করে। এর সূত্র ধরে পরে হাতে নেওয়া হয় ইউরোমেড ট্রানজিট প্রজেক্ট। এগুলো শেষপর্যন্ত আশার মুখ দেখেনি। বর্তমানে দুই দেশ এখানে পানির নিচ দিয়ে টানেল বানানোর পরিকল্পনা করছে। সেটাও কতটা সফল হবে, তা এখনই বলার উপায় নেই।
এবারে একটা মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি। আমাদের পদ্মা নদীর সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১,৫৭১ ফুট (৪৭৯ মিটার) এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট (২৯৫ মিটার) পর্যন্ত। অবশ্যই এটি নদী, প্রচণ্ড সামুদ্রিক স্রোত, বিশেষ করে বিপরীতমুখী জলস্রোত এবং বায়ুস্রোত এখানে নেই। তবু এই নদীর বুকে সেতু নির্মাণ যে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তা বলা বাহুল্য। আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা এরকম চমৎকার একটা কাজ করেছেন, যা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।