মানুষ আর আগের মতো বই পড়ে না কেন
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জরিপ অনলাইনের দুনিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে। বিশ্বের ১০২টি দেশে চালানো এই জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বই পড়ে সবচেয়ে বেশি। আর তালিকার একদম তলানির দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। জরিপ মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ গড়ে দিনে ১ ঘণ্টা এবং বছরে প্রায় ১৭টি বই পড়ে। জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সর্বোচ্চ বই পড়লেও তা অতীতের তুলনায় যথেষ্ট কম। এই জরিপ আরও জানায়, মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের বই পড়ার প্রবণতা কমেছে।
এই জরিপে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গত এক বছরে একটিও বই পড়েননি। আরও খারাপ খবর হলো, মিলিনিয়াল, জেন-জি ও জেন-আলফা বা তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ কম পড়ছে। তারা বয়স্কদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম বই পড়ে।
মানুষ কেন আগের মতো পড়ছে না? আর কীভাবে এই প্রবণতাকে পাল্টানো যায়? এই লেখায় এই দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। এখানে রয়েছে মানুষের বই না পড়ার পেছনের ৫টি কারণ ও কার্যকর সমাধান।
১. সময়ের অভাব
মানুষ যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি ব্যস্ত। কারণটা অনেকটা অর্থনৈতিক। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই এমন যে সময়ের সঙ্গে ধনীরা আরও বেশি ধনী হচ্ছেন, আর দরিদ্ররা হচ্ছেন আরও দরিদ্র। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের কেবল টিকে থাকার জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তবে পড়ার সময় বের করা মূলত দুই ধাপের বিষয়। দিনের সূচিতে পড়ার জন্য সময় বের করা এবং পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করা।
পড়া একটি আনন্দদায়ক ব্যাপার। আমরা চাইলে আনন্দের জন্য সব সময় বের করতে পারি। আপনি বইয়ের পাশাপাশি ই-বুক পড়তে পারেন। যাতায়াত বা অন্য কাজের সময় অডিও বুক শুনতে পারেন। অনেকে আবার অডিও বুক শোনাকে পড়া হিসেবে ধরতেই চান না। যদি অডিও বুক বাদ দেওয়া হয়, তাহলে গত বছরে কোনো বই না পড়া মানুষের হার ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়ে যায়।
যদিও অডিও বুক ঠিক বই পড়ার মতো নয়, তবে এটিও বেশ কাজের। নতুন কিছু শেখায়, মনোযোগ ধরে রাখে, কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে শেখায় এবং শব্দভান্ডার বাড়ায়।
যদি অডিও বুক বাদ দেওয়া হয়, তাহলে গত বছরে কোনো বই না পড়া মানুষের হার ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়ে যায়।
২. বইয়ের দাম
যেহেতু দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বই কেনার জন্য তাদের বাজেট নেই। তবে আজকের দিনে এটি খুব বড় সমস্যা নয়। কেননা, লাইব্রেরিতে গিয়ে ফ্রি বই পড়া যায়। ধার করে বই পড়া যায়। কম দামে কিনতে পাওয়া যায় পুরোনো বই। কিন্ডলসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনেক কম দামে ই-বুক কিনতে পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালের আগে প্রকাশিত সব বই এখন পাবলিক ডোমেইনে আছে। তার মানে এগুলো বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়।
৩. কী পড়বেন, বুঝতে পারছেন না
অনেক সম্ভাব্য পাঠকের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা। বেশির ভাগ মানুষ পড়েন দুই কারণে—আনন্দ বা বিনোদনের জন্য ও ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য। আপনি যদি বুঝতে না পারেন কী পড়বেন, তাহলে এখান থেকেই শুরু করুন। এমন বই পড়ুন, যা আপনাকে আনন্দ দেয় বা আপনার জীবন উন্নত করবে। কী বই পড়বেন, কেন পড়বেন—এই বিষয়ক অনেক ইনফ্লুয়েন্সারও পেয়ে যাবেন অনলাইনের দুনিয়ায়। লাইব্রেরি বা বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ানোও একটা ভালো কৌশল। আমাজন বা গুডরিডস ঢুঁ মারলেও সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। একবার ক্লিক করলে আপনি আরও অনেক প্রস্তাবনা ও রিভিউ দেখতে পাবেন। আরেকটা বিকল্প হলো বুক ক্লাব। সেখানে নিজের বই বেছে নিতে হয় না; বরং বই নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বইটা পড়ার আগ্রহ বাড়ে।
কিন্ডলসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনেক কম দামে ই-বুক কিনতে পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালের আগে প্রকাশিত সব বই এখন পাবলিক ডোমেইনে আছে।
৪. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফোমো ও অ্যাটেনশন স্প্যান
ফোনোগ্রাফ, রেডিও, টিভি—বহু যুগ ধরে পড়াকে প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। তবে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের অ্যাটেনশন স্প্যান বা মনোযোগের সময়সীমা কমানোর বিষয়টিকে একেবারে আলাদা মাত্রায় নিয়ে গেছে। ফলাফল? এখন ১০ সেকেন্ডের রিলসে আসক্ত প্রজন্মের পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বই পড়া চ্যালেঞ্জের বিষয়ই বটে! ধীরলয়ের জীবনযাপন থেকে মানুষ এখন যোজন যোজন দূরে। অনেকেই নিজের পরিস্থিতি বোঝেন। একটা পাহাড় খুঁজে স্মার্টফোনটা ছুঁড়ে ফেলে পাহাড়ের ওপর বসে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামা দেখতে চান। কিন্তু পারেন না। আপনি কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা রিলসের আসক্তি কমাবেন, সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।
৫. লক্ষ্য নিয়ে না পড়া বা পড়ার অভ্যাস না করা
কিছু অর্জন করতে হলে সেটিকে জীবনে অগ্রাধিকার দিতে হয়। প্রতি নববর্ষে ঠিক করুন, সেই বছর কমপক্ষে ১০টি বই পড়বেন। হয়তো তার বেশিও হতে পারে। আসলে সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো পড়াকে লক্ষ্য হিসেবে ধরা। যখনই আপনি একটা লক্ষ্য নিয়ে আগাবেন, তখন সেটার জন্য আপনাকে সময় বের করতেই হবে। সময়ের সঙ্গে সেটি অভ্যাসে পরিণত হতে বাধ্য। সবার আগে মনস্থির করুন, আপনি ১টি বই পড়ে শেষ করবেন! এখান থেকে শুরু হোক তবে...