সবার একজন হয়ে ওঠার যাত্রা

স্পেনের আলতামিরা গুহায় আঁকা বাইসনের ছবি
শ্রেষ্ঠত্ব হলো কেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টা আর সবার একজন হয়ে ওঠা হলো বিকেন্দ্রীকরণের পথ, মানবিকতার পথ।

প্রশস্ত এক রাস্তা ধরে রিকশা নিয়ে এগিয়ে গেলেও মিনিট বিশেক লাগে পৌঁছাতে। জায়গাটা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের নিকটবর্তী জেলেপাড়ার কাছে, খাঁড়ির মতো একটা জায়গা; মাঝেমধ্যে হাওয়া এসে কেমন এলোমেলো করে দেয়। সেখানে অজস্র জেলেনৌকা ভাটায় দাঁড়িয়ে থাকে আর জোয়ারে চলে যায় সমুদ্রের গভীরে, মাছ ধরতে। রাস্তার শুরুর দিকেই চট্টগ্রামে কাট্টলী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ। বিজ্ঞান বক্তৃতা (কসমিক ক্যালেন্ডার বিষয়ে) করতে হয়েছিল ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে। সময়টা ছিল বেলা ১১টায়, ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল। খোলা মাঠে রোদের মধ্যে অনুষ্ঠানটি হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া তেমন কাজে আসেনি। তবে অনুষ্ঠানটি ভীষণ প্রাণবন্ত হয়েছিল। অনেক ধরনের প্রশ্ন আমার দিকে ছুড়ে মেরেছিল তারা। বক্তৃতার পর বিকেলে আমি যখন জেলেপাড়ায় নৌকাগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের শেষ আলোর চলে যাওয়া দেখছিলাম, তখনই শিক্ষার্থীদের করা অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন আমাকে ঘিরে ধরেছিল; যেন পিথাগোরীয় সময়ের আবেগ আর ইজিয়ান সাগরের ঢেউ, লাল আভায় মোড়ানো এক পৃথিবী।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়া এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি বলছ সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে আর কথাটি বলার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের ওপর নির্যাতন চলেছে, জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছে, অথচ আজও আমরা যখন বলি সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে; তা তো এই কথাই বলে—সূর্যের চারদিকে নয়, পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে।’

আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি, অনুভব করি বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে পৃথিবীর সংস্কৃতিগুলোর ব্যর্থতা। কেননা এখনো সে রকম বাক্যবিন্যাস আমাদের অভ্যাসে আনতে পারেনি, যার অর্থ হবে, ‘সূর্যের চারদিকেই পৃথিবী ঘোরে; বুঝতে পারবে প্রতিদিন সূর্যের মুখোমুখি হই, ১২ ঘণ্টা কাটিয়ে সূর্য থেকে সরে গিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করি, ১২ ঘণ্টা পরে সূর্যের মুখোমুখি হয়ে দিনের আলোর মুখোমুখি হই।’ অথচ এটাই ছিল কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যাওয়ার অভিযাত্রা। শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা থেকে সরে গিয়ে সবার একজন হয়ে ওঠার যাত্রা।

সবার একজন হয়ে ওঠার যাত্রা মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা জগদীশচন্দ্র বসুও তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি যেন ঢেউ গুনছিলাম, নতুন করে বেরিয়ে পড়ার জন্য। সাংস্কৃতিক দর্শনের অগ্রপথিক ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এই কথাগুলোর একধরনের প্রারম্ভিক সূচনা ঘটায়। ২০০৭ সালে নালন্দার সঙ্গে সংযুক্তি আমাকে শিশুশিক্ষা নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শুনেছিলাম, নালন্দা একধরনের প্রকৃতিঘনিষ্ঠ করে শিশুদের বড় করে তুলতে চায়। বুঝেছিলাম মাঠহীন, গাছহীন কংক্রিটের মধ্যে কাটানো শৈশবকে মুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা। ভালো লেগেছিল। কিন্তু কালচারালি ইন্টিগ্রেটেড কথাটার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যদিও জীবন বিকাশের নতুন কোনো প্রচেষ্টার একটা ইঙ্গিত ওয়াহিদুল হকের কণ্ঠেও আমি শুনেছিলাম। দুর্ভাগ্য বলতে হবে, এগুলো স্পষ্ট হওয়ার আগেই তিনি প্রয়াত হন।

একটা স্কুল আসলে কী? কীভাবে এর মধ্য দিয়ে একটি শিশু তার জার্নিটা শুরু করবে? অর্থনৈতিক লাভ–ক্ষতির ঘুঁটি হিসেবে বড় না হয়ে যাতে সে মানবসাগরের তীরে পৌঁছাতে পারে?

একটা বিষয় আমার কাছে সব সময় পরিষ্কার ছিল, শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা জাহির করার জায়গাগুলো থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে না শিক্ষা, না সমাজ মানবিক হয়ে উঠবে। শ্রেষ্ঠত্ব হলো কেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টা আর সবার একজন হয়ে ওঠা হলো বিকেন্দ্রীকরণের পথ, মানবিকতার পথ। মস্তিষ্কের গভীরে এই কেন্দ্রীকরণের বিষয়টি প্রোথিত। এই অংশের অসংগতিগুলোকে দূর করতে না পারলে যে–ই ক্ষমতার শীর্ষে যাক, যে–ই রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান হোক, তাতে কিছু আসে-যাবে না। প্রচলিত একটা প্রবাদ তো আছেই, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। তখনই লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাকে যুক্ত করার তাত্পর্য আরও স্পষ্ট হতে থাকে।

এর অর্থ হচ্ছে, অতীতে মানুষের যে জীবনযাপন, যার কারণে আমরা এত দূর এসেছি, তা সংগঠিতভাবে শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা। তা–ই হচ্ছে কালচারালি ইন্টিগ্রেশন বা সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্তকরণ বা জোড়াহীন এক পথ। মস্তিষ্কের অসংগতিগুলোকে দূর করার একটা উপায়ও। তাই আইনস্টাইনও ১০০ বছর আগে বলে গেছেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে সর্বাধিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে ব্যবহার করার চেয়ে স্কুলকে তরুণদের মধ্যে সেসব গুণ ও দক্ষতা গড়ে তোলার প্রতি জোর দিতে হবে। কেননা সহনশীলতা, নমনীয়তা নিয়ে মানবিক বোধ জাগ্রত করতে না পারলে নানা অঘটন ঘটিয়ে আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি। যেমন জঙ্গিবাদ, জীবাণু অস্ত্র, সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

মানুষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে ভুলে যাওয়া। মানবজাতির অর্জনই হচ্ছে এই ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতিধারণের সংগ্রাম। সে যত বেশি পেছনের ঘটনাবলি মনে রাখতে পারবে, তার চলার পথ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি তত বেশি সহনশীল ও প্রশস্ত হবে, ভবিষ্যৎ সে নির্মাণ করতে পারবে তত বেশি আপন আলয়ে। মানবিক জীবনের বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করবে সেই সব স্মৃতিধারণ। তা ছাড়া প্রতিটি শিশু ভবিষ্যতের মানুষ। আজকের যে বাস্তবতা, তা ভবিষ্যতে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেটা আমাদের শিক্ষায় গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। প্রতিটি শিশুর চারপাশের পরিবেশ ও ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

আরও পড়ুন
স্পেনের আলতামিরা গুহায় আঁকা বাইসনের ছবি

২০০৯ সাল। নিঝুম দ্বীপের গামছা খাল। এই খাল দিয়ে প্রতিদিন আমরা দুজন পার হতাম। আর আট বছরের এক শিশু নৌকার হাল ধরত। সে গান গাইত, ‘আমি নিঝুম দ্বীপের মাঝি’। তার উদাত্ত কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত। যেন নিঝুম দ্বীপ কাঁপত। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি বড় হয়ে কী হবে। সে স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমি মাঝি হব।’ যেন মাঝি হওয়ার মধ্য দিয়েই সে নিজেকে উন্মোচন করতে চায়, জগৎকে জানতে চায়। আমাদের শিক্ষিত সমাজেও কেউ নাবিক হতে চায়, কেউ চিকিৎসক হতে চায়, কেউ প্রকৌশলী হতে চায়; কেউ বিজ্ঞানী হতে চায়। নিঝুম দ্বীপের সেই শিশুকে, কেন সে মাঝি হবে জিজ্ঞাসা করলে হেসেছিল। আমি বুঝেছিলাম, প্রতিটি শিশুর একটা পারিবারিক পরম্পরা থাকে, পরম্পরা থাকে ঐতিহ্যের। তার চারপাশটা ঘিরে সে চিন্তার নানা পরিবর্তন ও বিকাশ সাধিত হয়। তার ভিত্তিতে এই চাওয়া। অতএব একটি শিশুকে স্কুলে ভর্তি করার সময় কেস হিস্ট্রিটা ঠিকমতো নিতে পারলে পরিবার ও স্কুলের মধ্যে ইন্টেগ্রিটি বা অবিচ্ছেদ্যতা তৈরি হবে। এটা স্কুলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর সঙ্গে আমাদের সমাজে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, এমনকি নাবিক হওয়ার ব্যাপারে যে লাভ-ক্ষতির হিসাব কাজ করে, তার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ও রকম মিথস্ক্রিয়া থেকে যদি এ রকম হওয়ার ইচ্ছা জাগে, তা মানবিক ও মহৎ। তাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

সংগীত ও শিল্পকলা আবশ্যকীয় বিষয়। সংগীত ও শিল্পকলাকে বিশেষ বিষয় হিসেবে না দেখে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একই তালে মিলিয়ে দিতে হবে। এগুলো একীভূতভাবে সংযুক্ত করতে পারলেই শিক্ষা মানবিক হয়ে উঠবে। কেননা সভ্যতার বিকাশে শ্রমের উদ্দীপনায় ছন্দ ও শব্দের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, অস্তিত্বের সংকটে চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। পারফর্মিং বা বিনোদনের জায়গা থেকে নয়; বরং অস্তিত্বের প্রয়োজন ও বিকাশের জায়গা থেকে সংগীত ও শিল্পকলাকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এক্সট্রা কারিকুলাম বা বিশেষ বিষয় হিসেবে নয়। আরও ১০টি বিষয়ের মতো এর অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে। কেননা এ বিষয়গুলো মানবজাতির আদি বিকাশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, সভ্যতার বিকাশেই তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গুহাচিত্র তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন। ধরুন, ৩০–৩২ হাজার বছর আগে মানুষ ছবি আঁকা শুরু করল। কেন? শিকার করার অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করার জন্য বা কীভাবে ভবিষ্যতে শিকার করবে; এমনও হতে পারে, অবসর সময়ে গভীর ভাবনার বিমূর্তকে রূপায়ণের প্রচেষ্টা থেকে। তিনটার কোনটা আগে এসেছিল, বলা মুশকিল। তবে আমরা বলতে পারি, অস্তিত্বের প্রয়োজন থেকেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। তদ্রূপ সংগীত ও শারীরিক ছন্দের ঐকতানের প্রণোদনা জোগানো শুরু হয়েছিল ৩৬–৪০ হাজার বছর আগে। সভ্যতার অস্থিরতার ক্ষেত্রে একটা বড় কারণ হচ্ছে মানুষের জীবনযাপন থেকে সংগীত ও শিল্পকলার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

মানুষ যদি শৈশব থেকে এই প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়গুলো বুঝতে ও শুনতে শুরু করে, তাহলে এটা অন্য রকম তাত্পর্য নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াবে। আবেগ–অনুভূতিগুলো গভীর তাত্পর্যময় ছন্দে স্পন্দিত হবে।

প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল

প্রতিটি শিশুকে যন্ত্র থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তারপরও বাস্তবতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না। অতএব যন্ত্র সম্পর্কে ভালো-মন্দ দিকগুলো তাকে অবগত করাতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, যখন সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের চেয়ে প্রাযুক্তিক উল্লম্ফন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন বিজ্ঞানকে বোঝার চেয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়ে যায়। সেটাই সৃষ্টি করে প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল। তার মধ্যে সেই পরিপক্বতা অর্জিত হয় না, যা দিয়ে পরিমিতভাবে একটা আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। আমরা তার নানা রকম উদাহরণ দেখতে পাই। অনেকটা কৈশোরের বয়ঃসন্ধিকালের মতো, কৈশোরে শিশুরা শারীরিকভাবে নতুন এমন কিছু অনুভব করে, যার সঠিক নির্দেশনা বা পরিপক্বতা ছাড়া মারাত্মক ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অ্যান্ড্রয়েড বা স্মার্টফোন ও কম্পিউটার আমাদের সুস্থ ও অসুস্থ ব্যবহারের খাড়া গিরিচূড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে পরিমাণ কাজ করেছি, আমরা নিজেদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও উন্মোচন প্রক্রিয়া নিয়ে সেই পরিমাণ কি ভেবেছি? প্রথম দিকে স্টিফেন হকিংয়ের সমর্থক হলেও পরে তিনি বলেছেন, এই উন্নতির তিনি বিরোধী নন, তবে দ্বিধান্বিত; হয়তো এটা মানুষের সেরা উদ্ভাবন, নয়তো সবচেয়ে খারাপ।

অনেকে বলে থাকেন, এটা তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞানের যুগ হলে কি মনুষ্য নির্মিত জলবায়ু বিপর্যয় হতো? বিজ্ঞানের যুগ হলে কি মাঠহীন ভবিষ্যতের প্রজন্ম বড় হতো, বিজ্ঞানের যুগ হলে কি ক্যানসার ও ডায়াবেটিসের প্রণোদনা জোগানো খাবারগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হতো বা এর ওপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে উঠতাম? এটা হলো বিজ্ঞানের সুবিধা লাভের যুগ। কীভাবে বিজ্ঞানকে না বুঝে ভোগের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তার যুগ। আরও প্রবলভাবে আত্মধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার যুগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের লাভের মেশিন বানানোর পরিকল্পনার যুগ।

আরও পড়ুন
কসমিক ক্যালেন্ডার এমন একটি শেখার হাতিয়ার, যেখানে মহাবিশ্ব, জীবনের উদ্ভব, লিঙ্গের উদ্ভব এবং মানুষের উদ্ভব ও এর বিকাশের এমন আনুপাতিক চিত্র দেওয়া আছে, যা মনে রাখার জন্য সুবিধাজনক

৪০ হাজার প্রজন্মের উত্তরাধিকার সে

মনে রাখতে হবে, একটা শিশু শুধু পরিবার থেকে আসেনি, মা-বাবা থেকেও শুধু আসেনি। সে আসলে ৪০ হাজার প্রজন্মের সুদূর উত্তরাধিকার। এটা বোঝার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর উদ্ভব, গ্যালাক্সির উদ্ভব ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এটার মধ্য দিয়ে সে বুঝতে পারবে, অপরাধপ্রবণতা কেন তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে সবকিছু কুক্ষিগত করার প্রবণতার কারণ কী? মানুষ কেন ছলে–বলে–কৌশলে সবকিছু নষ্ট করে ফেলতে চায়। আসলে সমাজের বিকাশে যে গভীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা আসলে বিবর্তনের দীর্ঘ যাত্রায় সৃষ্ট। মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা। এগুলো শুধরানো স্কুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেটাই শিক্ষা, প্রশিক্ষণ নয়। স্কুলিংয়ের কাজ হলো মানবজাতির যা অর্জন, তা যতটা সম্ভব পদ্ধতিগতভাবে শেখানো আর তার আলোয় ভবিষ্যতের পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করা। তা পারলেই পেশাগত কাজের জন্য বনিয়াদি স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণই তাকে সমাজের কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারবে। সমাজে মানবিক মানুষ হিসেবে তার পেশা সম্পাদন করতে পারবে।

অথচ আমরা শিক্ষণ-প্রশিক্ষণকে এক করে ফেলেছি, শেখাচ্ছি শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। এ জন্য আমি মনে করি, কসমিক ক্যালেন্ডার বা মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জির ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কেননা কসমিক ক্যালেন্ডার এমন একটি শেখার হাতিয়ার, যেখানে মহাবিশ্ব, জীবনের উদ্ভব, লিঙ্গের উদ্ভব এবং মানুষের উদ্ভব ও এর বিকাশের এমন আনুপাতিক চিত্র দেওয়া আছে, যা মনে রাখার জন্য সুবিধাজনক।

শিশু বয়সে এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে যেতে পারলে মানবিক সমাজ তৈরির পথ প্রশস্ত হবে। মানুষ অনিশ্চয়তা থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পারবে। শিক্ষায় প্রথম থেকেই একটা শিশুকে শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যদের থেকে বেশি মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার বীজ বপন করা হয়। তার থেকে রক্ষা করতে পারবে পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সুষম মানবিক সমাজ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করবে।

এসব কাজ রাষ্ট্রীয়ভাবে হতে পারলে অনেক সমস্যাই হয়তো কমে যেত। কিন্তু সে রকম আশা এ সময়ের বাস্তবতায় খুবই কম। তবে যেসব স্কুল শিশুদের বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে গড়ে তুলতে চায়, তাদের সব সময় একটা সেল থাকতে হবে, যার কাজ হবে স্থানীয় অঞ্চলগুলোর (প্রতিটি দেশে পরীক্ষা নামের) সনাতন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদান। তাহলে তা শিক্ষার্থীদের যাত্রাপথ সুগম রাখবে, না হলে অকালে ঝরে যাওয়ায় আরও জটিলতার সৃষ্টি হবে।

জ্যাকব ব্রনোওস্কি (দ্য অ্যাসসেন্ট অব ম্যান, ১৯৭৩) উইলিয়াম ব্লেকের একটি কথাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন: জ্ঞান সত্যের আলগা পাতাওয়ালা নোটবুক নয়, জ্ঞান হচ্ছে প্রাথমিকভাবে নৈতিক জীবদের এমন এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যেখানে পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ ও দক্ষতা নিয়ে একজন মানুষ তার ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা, বৌদ্ধিক প্রতিশ্রুতি ও সংবেদনশীল মনকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করে, যা মানুষটিকে এগিয়ে নিতে উত্সাহিত করে।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত