ধারাবাহিক
দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি – ২
মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।
অধ্যায় এক
মন্দিরের স্নিগ্ধ ছায়ায়
২. সারঙ্গপানি সান্নিধি স্ট্রিট
১৮৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সন্তান জন্মানোর তখনো দুই মাস বাকি। কুম্বকোনম শহরের উনিশ বছর বয়সী এক তরুণী রওনা দিলেন বাবার বাড়ির পথে। তরুণীর নাম কোমলতাম্মল। গন্তব্য ১৫০ মাইল উজানের শহর ইরোড। সেখানেই তিনি গর্ভের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবেন।
আমাদের দেশে যেমন প্রথম সন্তান হওয়ার সময় মেয়েরা বাবার বাড়ি যায়, সেই আমলেও এই প্রথা কড়াকড়িভাবে মানা হতো। এতটাই মানা হতো যে সরকারি কর্মকর্তারা জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখার সময় এই নানিবাড়ি যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখতেন।
ইরোড শহর তখনো খুব বড় ছিল না। জনসংখ্যা সব মিলিয়ে ১৫ হাজার। শহরটা গড়ে উঠেছিল কাবেরী আর তার এক উপনদী ভবানীর মিলনস্থলে, মাদ্রাজ থেকে প্রায় আড়াইশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।
ইরোড শব্দটার একটা গা ছমছমে মানে আছে—ভেজা খুলি। এর পেছনে আছে হিন্দু পুরাণের এক রোমহর্ষক গল্প। কথিত আছে, একবার হিন্দুদের দেবতা শিব রেগে গিয়ে ব্রহ্মার পাঁচটি মাথার একটি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন! সেই থেকেই এই নাম।
এই ইরোডেই কাবেরী নদী বেশ চওড়া। তার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় সব পাথর। নদীর কাছেই শহরের পুরোনো বাণিজ্যিক এলাকা। এই এলাকাকে সবাই দ্য ফোর্ট নামে চেনে। ঠিক সেখানেই তেপ্পুকুলাম স্ট্রিটের ওপর ছিল ছোট্ট একটা বাড়ি। ওটাই ছিল কোমলতাম্মলের বাবার বাড়ি।
এই বাড়িতেই ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, সূর্য ডোবার ঠিক পরপরই জন্ম নেন শ্রীনিবাস রামানুজন। ভারতীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনটা ছিল অগ্রহায়ণ মাসের নবম দিন। জন্মের এগারো দিন পর নিয়ম মেনে তাঁর নাম রাখা হলো। আর ঠিক এক বছর পর, শিশু রামানুজন আর তাঁর মা ফিরে এলেন কুম্বকোনমে। জীবনের পরের বিশটি বছর রামানুজন এই শহরেই কাটিয়েছেন।
এই নামের পেছনেও আছে এক মহাপুরুষের প্রভাব। ১১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রামানুজ নামে এক বৈষ্ণব সাধক ছিলেন...
তাঁর পুরো নাম রাখা হয় শ্রীনিবাস রামানুজন আয়েঙ্গার। শ্রীনিবাস ছিল তাঁর বাবার নাম। দক্ষিণ ভারতে বাবার নাম সন্তানের নামের আগে জুড়ে দেওয়াটাই নিয়ম। কিন্তু সাধারণত তা ব্যবহার করা হয় না। কাগজপত্রে বা সই করার সময় সে নাম ছোট হয়ে শুধু একটা আদ্যক্ষর ‘S’ হয়েই থেকে যায়। আর আয়েঙ্গার কোনো নাম নয়, ওটা হলো জাত বা বর্ণের পরিচয়। দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণদের একটি বিশেষ শাখা হলো এই আয়েঙ্গাররা।
অর্থাৎ শুরুরটা বাবার নাম, আর শেষেরটা জাতের। নিজের নাম বলতে রইল শুধু রামানুজন। পরে তিনি নিজেই একজন পশ্চিমা বন্ধুকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার কোনো যথাযথ পদবি বা সারনেম নেই।’ মা অবশ্য তাকে আদর করে ডাকতেন চিন্নাস্বামী। কিন্তু বাকি পৃথিবীর কাছে তিনি ছিলেন শুধুই রামানুজন।
এই নামের পেছনেও আছে এক মহাপুরুষের প্রভাব। ১১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রামানুজ নামে এক বৈষ্ণব সাধক ছিলেন। তিনি মৃতপ্রায় হিন্দুধর্মে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে সেই সাধকের জন্মও ছিল বৃহস্পতিবার এবং তাঁর সঙ্গে এই শিশুটির আরও কিছু জ্যোতিষশাস্ত্রীয় মিল ছিল।
রামানুজন (উচ্চারণ হবে রা-মা-নু-জান, দ্বিতীয় অংশে একটু জোর দিয়ে, আর শেষের অংশটা অনেকটা জাম-এর মতো শোনায়) শব্দটার একটা সুন্দর অর্থ আছে। শব্দটি এসেছে রাম এবং অনুজ থেকে। অনুজ মানে ছোট ভাই। ভারতের মহাকাব্য রামায়ণের সেই আদর্শ পুরুষ রামের ছোট ভাই লক্ষণের নাম অনুসারেই তার নাম।
* * *
রামানুজনের নিজের পরিবারই ছিল এই করুণ পরিসংখ্যানের জ্বলন্ত উদাহরণ। রামানুজনের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তাঁর মা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন
রামানুজনের মা কোমলতাম্মল কাছেরই এক মন্দিরে ভজন বা ভক্তিমূলক গান গাইতেন। গানের দল যা আয় করত, তার অর্ধেক যেত মন্দিরের তহবিলে। বাকি অর্ধেক গায়িকাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো। রামানুজনের বাবা মাসে বেতন পেতেন মাত্র কুড়ি টাকা। তাই মায়ের গানের দল থেকে আসা ওই পাঁচ বা দশ টাকা ছিল সংসারের জন্য অনেক বড় কিছু। ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক, কোমলতাম্মল কখনোই রিহার্সাল মিস করতেন না।
কিন্তু ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বরে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। টানা চার-পাঁচ দিন তিনি রিহার্সালে অনুপস্থিত। গানের দলের প্রধান খবর নিতে সোজা তার বাড়িতে হাজির হলেন। দরজার সামনে নিমপাতার স্তূপ দেখেই তিনি বুঝে গেলেন, সর্বনাশ হয়েছে! বাড়িতে নিশ্চয়ই বসন্ত রোগ হানা দিয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখলেন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নিমপাতার বিছানায় শুয়ে আছে ছোট্ট এক কালো রঙের শিশু। জ্বরের ঘোরে কাতরাচ্ছে। মা একমনে মন্ত্র জপছেন আর হলুদ মেশানো পানিতে নিমপাতা চুবিয়ে পরম মমতায় ছেলের সারা শরীরে বুলিয়ে দিচ্ছেন। দক্ষিণ ভারতের মানুষ বিশ্বাস করত, নিমপাতা আর হলুদ চুলকানি কমানোর পাশাপাশি জ্বর কমাতেও সাহায্য করে।
রামানুজন সেই বসন্ত রোগের ক্ষতচিহ্ন সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তিনি যে বেঁচে ফিরেছিলেন, সেটাই ছিল তাঁর বড় ভাগ্য। কারণ, সেই সময়ে তাঞ্জোর জেলায় বসন্ত রোগ মানেই ছিল মরণকামড়। এক বছরেই মারা যেত প্রায় চার হাজার মানুষ। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনেরও টিকা দেওয়া ছিল না। রামানুজনের বয়স যখন দশ, তখন কলেরায় মারা গিয়েছিল পনেরো হাজার মানুষ। প্রতি দশজন শিশুর মধ্যে তিন-চারজনই এক বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যেত।
রামানুজনের নিজের পরিবারই ছিল এই করুণ পরিসংখ্যানের জ্বলন্ত উদাহরণ। রামানুজনের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তাঁর মা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় সদগোপন। তিন মাস যেতে না যেতেই সে মারা গেল। রামানুজনের বয়স যখন চার, তখন তাঁর এক বোন হলো। সেও টিকল না পরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সাড়ে ছয় বছর বয়সে আরেক ভাই হলো, সেশান। সেও এক বছরের আগেই পৃথিবী ছাড়ল।
অনেক পরে, ১৮৯৮ সালে রামানুজনের দশ বছর বয়সে লক্ষ্মী নরসিংহ নামে তাঁর এক ভাই হয়। আবার রামানুজনের বয়স যখন সতেরো, তখন জন্মে আরেক ভাই। তার নাম রাখা হয় তিরুনারায়ণ। তারা দুজন বেঁচে ছিল। কিন্তু শৈশবে ভাইবোনদের এই একের পর এক মৃত্যু রামানুজনকে করে তুলেছিল বাবা-মায়ের একমাত্র চোখের মণি। তিনি বড় হয়েছিলেন একমাত্র সন্তানের মতোই, অতিরিক্ত আদর আর শাসনে।
জীবনের প্রথম তিন বছর তিনি প্রায় কথাই বলেননি। হয়তো তিনি কথা বলতে চাইতেন না বলেই বলতেন না। খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন।
রামানুজনের বয়স যখন সাত, তখন তাঁর দাদা কুষ্ঠরোগে মারা যান। এরপর রামানুজনের শরীরেও বিশ্রী চুলকানি আর ফোড়া দেখা দেয়। কিন্তু শুধু শরীর নয়, তাঁর মেজাজটাও ছিল একটু আলাদা। চাপের মুখে তিনি অদ্ভুত সব প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। তিনি ছিলেন দারুণ সংবেদনশীল, একগুঁয়ে এবং অদ্ভুত ধরনের জেদি। ইরোডে থাকার সময় তিনি মন্দিরের প্রসাদ ছাড়া আর কিছুই খেতে চাইতেন না। পরে কুম্বকোনমে এসে বাড়ির সব পিতল আর তামার বাসনকোসন এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত সাজিয়ে বসে থাকতেন। খাবার পছন্দ না হলে রাগে গড়াগড়ি করতেন মাটিতে।
জীবনের প্রথম তিন বছর তিনি প্রায় কথাই বলেননি। হয়তো তিনি কথা বলতে চাইতেন না বলেই বলতেন না। খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। মা ভয় পেয়ে তাঁকে নিয়ে গেলেন কাঞ্চিপুরমে, বাবার কাছে। সেখানে এক বয়স্ক বন্ধুর পরামর্শে তাঁর অক্ষর অভ্যাসম শুরু হলো। মেঝেতে বিছানো চালের ওপর দাদার হাত ধরে তিনি তামিল বর্ণমালা শিখতে শুরু করলেন।
শিগগিরই বোবা হওয়ার ভয় কেটে গেল। তিনি তামিল বর্ণমালার ১২টি স্বরবর্ণ, ১৮টি ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ২১৬টি যুক্তবর্ণ শিখে ফেললেন।
১৮৯২ সালের ১ অক্টোবর। বিজয়াদশমীর দিন তাঁকে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ভর্তি করানো হয় স্থানীয় পিয়াল স্কুলে। পিয়াল হলো দক্ষিণ ভারতীয় বাড়ির সামনের ছোট্ট বারান্দায় জনা ছয়েক ছাত্র নিয়ে চলা পাঠশালা।
কিন্তু পাঁচ বছরের রামানুজন শিক্ষককে পছন্দ না হওয়ায় স্কুলেই যেতে চাইলেন না। রামানুজনকে জোর করে কিছু শেখানো যেত না। স্কুল তাঁর কাছে জ্ঞানের চাবি ছিল না, ছিল শেকলের মতো।
চুপচাপ স্বভাবের রামানুজন অদ্ভুত সব প্রশ্ন করতে পছন্দ করতেন। ‘পৃথিবীর প্রথম মানুষ কে ছিল?’ কিংবা ‘মেঘ থেকে মেঘের দূরত্ব কত?’ বাবা-মা তাঁকে বাইরে খেলতে যেতে দিতেন না, তাই জানালার পাশে বসে রাস্তা দেখেই তাঁর সময় কাটত। খেলাধুলার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তখন কম স্বাস্থের মানুষ ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য, কিন্তু রামানুজন ছিলেন বেশ মোটা। তিনি মাঝে মাঝে বড়াই করে বা মজা করে বলতেন, মারামারি লাগলে তাঁর কিছু করা লাগবে না, শুধু গায়ের ওপর পড়ে গেলেই প্রতিপক্ষ শেষ!
প্রায় দুই বছর তাঁকে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে ঘোরানো হলো। ১৮৯৪ সালের মার্চে তিনি কিছুদিন এমন এক স্কুলে ছিলেন, যেখানে পড়ার মাধ্যম ছিল তেলেগু ভাষা। সেখানে শাস্তি হিসেবে তাঁকে দুই হাত ভাঁজ করে, মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে বসে থাকতে হতো। মাঝে মাঝে তিনি রাগে গজগজ করতে করতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেন। পরে দাদুর চাকরি চলে যাওয়ায় তারা কুম্বকোনমে ফিরে আসেন এবং কাঙ্গায়ন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। এরপর আবার মাদ্রাজে নানাবাড়িতে গিয়ে স্কুল পালানোর চেষ্টা করলে একজন পুলিশ দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাঁকে স্কুলে পাঠানো হতো।
এ অবস্থায় মাদ্রাজে ছয় মাস থেকে ১৮৯৫ সালের মাঝামাঝি তিনি আবার কুম্বকোনমে ফিরে আসেন।
