গণিতভীতি কেন হয়, দূর করার উপায় কী

আমাকে দিয়ে অঙ্ক হবে না, অঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না কিংবা অঙ্ক দেখলে মাথা ঘোরে—কথাগুলো কি পরিচিত মনে হচ্ছে?  পরীক্ষার আগে বা বাসায় অঙ্ক করার সময় অনেক শিশুই গণিতভীতিতে ভোগে। মনোবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে বলেন ‘ম্যাথোফোবিয়া’। বাংলায় একে বলি গণিতভীতি। অনেক অভিভাবক সন্তানের এই ভয়কে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার অজুহাত বলে মনে করেন। কিন্তু গবেষণা বলছে, গণিতভীতি একটি বাস্তব সমস্যা এবং এর পেছনে নির্দিষ্ট কিছু কারণও রয়েছে। একটু সচেতন হলে এই ভীতি দূর করা যায়।

গণিতভীতি কীভাবে দূর করবেন, তা জানার আগে জানতে হবে শিশুরা কেন গণিতকে ভয় পায়? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। যেমন, অনেক সময় বড়রা শিশুদের সামনে গণিত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এত শিশুদের মনে অজান্তেই গণিত নিয়ে ভয় ঢুকে যায়। বাবা-মায়ের গণিতভীতি থাকলে তা সন্তানের মধ্যেও যেতে পারে। পাশাপাশি গণিত একটি ধারণানির্ভর বিষয়। একে যদি বাস্তব জীবনের সঙ্গে না মিলিয়ে শুধু সূত্র মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়, তবে শিশুরা তার অর্থ খুঁজে পায় না। ফলে বিষয়টি তাদের কাছে নীরস ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্লাসে অঙ্কে ভুল করলে শিক্ষকের বকা বা বন্ধুদের সামনে অপমানিত হওয়ার ভয়েও শিশুদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তাছাড়া, সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা হলো, গণিতে ভালো হতে গেলে জন্মগত প্রতিভা বা বিশেষ মেধার প্রয়োজন। ফলে, কোনো শিশু যদি গণিতে একটু পিছিয়ে পড়ে, তবে সে নিজেকে মেধাহীন ভাবতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গণিত করাই ছেড়ে দেয়। সে বিশ্বাস করতে শুরু করে, চেষ্টা করেও কোনো লাভ হবে না। আবার অনেক সময় গণিতের বেসিক ভালোভাবে না জানার কারণে পরের অধ্যায়গুলো বুঝতে পারে না। তাই শুরু থেকে গণিতের বেসিক ভালোভাবে শেখা উচিৎ।

আরও পড়ুন
শিশুকে বোঝান, গণিত শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজেই এর ব্যবহার রয়েছে।

এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে। সন্তানের গণিতভীতি দূর করতে আপনি কী করবেন? বেশ কিছু কাজ করতে পারেন। সেগুলো এখানে আলোচনা করছি।

১. প্রথমে নিজের মনোভাব বদলান

আপনার নিজের যদি গণিত নিয়ে কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তা সন্তানের সামনে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকুন। গণিতকে কঠিন সাবজেক্ট হিসেবে উপস্থাপন না করে, এটিকে মজার ধাঁধা বা রহস্য সমাধানের খেলা হিসেবে তুলে ধরুন। আপনার ইতিবাচক মনোভাব সন্তানের আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। যেমন বলতে পারেন, ‘আসো, এই অঙ্কটা আমরা একসঙ্গে সমাধান করার চেষ্টা করি।’ এতে আপনার সন্তান গণিতের প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

২. গণিতকে জীবনের অংশ করে তুলুন

শিশুকে বোঝান, গণিত শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজেই এর ব্যবহার রয়েছে। যেমন, কেক বানানোর সময় বা শরবত তৈরির সময় বিভিন্ন উপকরণের পরিমাপ শিশুকে শেখান। আধা চামচ লবণ বা এক চামচ চিনিও যে গণিত, তা শিশুদের বোঝাতে হবে। দোকানে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম হিসাব করা, মোট কত খরচ হলো বা কত টাকা ফেরত পাওয়া যাবে, সেই হিসাবও সন্তানকে দিয়ে করাতে পারেন। ক্রিকেট বা ফুটবলের খেলার সময় কত রান হলো, বা কয়টা গোল হলো, তা দিয়েও হিসাব বোঝাতে পারেন। এমনকি কোথাও ঘুরতে গেলে কত সময় লাগবে, গাড়ির গতি কত, বা বাসা থেকে ভ্রমণে যাওয়া জায়গার দূরত্ব কত, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। এতে গণিতভীতি কমবে।

গণিত শব্দ শুনেই অনেকে অমূলক ভয় পায়

৩. খেলার ছলে গণিত শেখান

শিশুদের শেখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো খেলা। গণিত শেখার জন্য বিভিন্ন দাবা বা লুডুর মতো বোর্ড গেম, পাজল, সুডোকু বা বিল্ডিং ব্লকস ব্যবহার করুন। বর্তমানে স্মার্টফোনেও গণিত শেখার অনেক মজার অ্যাপস পাওয়া যায়। খেলার ছলে সেগুলো দিয়েই শিশুকে গণিতের বিভিন্ন ধারণার সঙ্গে পরিচিত করাতে পারেন।

৪. চেষ্টা করলে প্রশংসা করুন

আপনার সন্তান একটি অঙ্ক ভুল করতেই পারে। উত্তর ভুল হয়েছে বলে তাকে বকা না দিয়ে, সে যে চেষ্টা করেছে, তার প্রশংসা করুন। তাকে বলুন, ‘বাহ্! তুমি তো অনেক চেষ্টা করেছ। চলো, ভুলটা খোঁজার চেষ্টা করি।’ মনে রাখবেন, ভুল করা শেখারই একটি অংশ।

আরও পড়ুন
গণিতের অনেক ধারণা শিশুদের জন্য বোঝা কঠিন। তাই যতটা সম্ভব ছবি এঁকে, বিভিন্ন রঙিন বস্তু ব্যবহার করে বা গল্প বলে গণিতের ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করুন।

৫. চাপমুক্ত পরিবেশ তৈরি করুন

বাড়িতে গণিত চর্চার সময় কোনো তাড়াহুড়ো করবেন না। শিশুকে তার নিজের গতিতে শিখতে দিন। সময় বেঁধে দিয়ে অনুশীলন করালে তা পরীক্ষার হলের মতোই আতঙ্ক তৈরি করতে পারে। বরং তার সঙ্গে বসুন, গল্প করার ছলে গণিতের ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনা করুন।

৬. গল্প ও ছবির সাহায্য নিন

গণিতের অনেক ধারণা শিশুদের জন্য বোঝা কঠিন। তাই যতটা সম্ভব ছবি এঁকে, বিভিন্ন রঙিন বস্তু ব্যবহার করে বা গল্প বলে গণিতের ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করুন। যেমন, ভগ্নাংশ বোঝানোর জন্য একটি আপেল বা রুটিকে সমান কয়েক ভাগে ভাগ করে দেখাতে পারেন।

৭. শিক্ষকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন

আপনার সন্তানের স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলুন। তার সার্বিক অবস্থা, কোন কোন বিষয়ে সে দুর্বলতা অনুভব করছে, এবং স্কুলের পরিবেশ তার জন্য ভীতিকর কি না—এসব জানুন। শিক্ষক ও অভিভাবকের মিলিত প্রচেষ্টা শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে দেয়।

তবে এসব চেষ্টা করার পরেও যদি আপনার সন্তানের গণিতভীতি না কাটে, এবং এই ভীতি যদি তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, তবে একজন শিক্ষাবিষয়ক মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নিতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার লক্ষ্য সন্তানকে একজন গণিতবিদ বানানো নয়, বরং তার ভেতর থেকে গণিতের অযৌক্তিক ভয় দূর করে তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলা। প্রতিটি শিশুর শেখার ধরণ আলাদা। ধৈর্য, ভালোবাসা এবং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পাশে থাকলে আপনার সন্তান শুধু গণিতের ভয়কেই জয় করবে না, জীবনের যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস পাবে।

 

সূত্র:

১. স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ এডুকেশন

২. ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ

৩. হেলথলাইন

৪. অক্সফোর্ড লার্নিং

আরও পড়ুন