অসলো, মে ২০০৮। সে বছর নরওয়ের রাজা হ্যারল্ড গণিতবিদ জন থম্পসন ও জ্যাকুস টিটসকে গণিতের রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানজনক স্বীকৃতি—অ্যাবেল পুরস্কার দেন। সে বছরের পুরস্কারের মধ্যে একধরনের মজার প্রতিসাম্য ছিল। যে প্রকল্পের জন্য তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়, সেটি শুরু করেছিলেন উনিশ শতকের নরওয়েজিয়ান গণিতবিদ নীলস অ্যাবেল। তাঁর নামানুসারেই এই অ্যাবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আর সেই সাড়া জাগানো প্রকল্প শেষ করার জন্যই ২০০৮-এর এই পুরস্কারটি দেওয়া হয় গণিতবিদ দুজনকে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গণিতবিদেরা মূলত প্রতিসাম্যের সংজ্ঞা জানতে চেয়েছিলেন।
প্রতিসাম্য বিষয়টি আসলে কী? অনেকেই আয়নায় মানুষের মুখের ডান-বাম প্রতিসাম্যের কথা বলবেন। মানুষের মুখের চেয়ে তুষারকণার প্রতিসাম্য আরও বেশি। ভাবছেন, প্রতিসাম্য আবার বেশি-কম হয় নাকি? মানুষের মুখের বাঁ দিক আর ডান দিক একই রকম, ফলে আয়নায় দেখার সময় বাঁ দিক ডান হয়ে গেলেও দেখতে একই রকম লাগে। কিন্তু মানুষের মুখ যদি আমরা উল্টে দিই, তাহলে কিন্তু দেখতে আর আগের মতো লাগবে না। তবে একটি তুষারকণাকে উল্টে দিলেও সেটি দেখতে মনে হবে আগের মতোই। শুধু তাই নয়, প্রতিবার ৬০ ডিগ্রি ঘোরানোর পরও তুষারকণাটি দেখতে আগের মতোই লাগবে। অর্থাৎ মানুষের মুখের চেয়ে তুষারকণার প্রতিসাম্য আরও বেশি। তুষারকণা বা কোনো বস্তুর চেয়ে সাধারণ কোনো জ্যামিতিক আকৃতির মধ্যে আরও বেশি প্রতিসাম্য থাকা সম্ভব। একটি বৃত্তকে আমরা যে কোণেই ঘোরাই না কেন, দেখতে আগের মতো লাগবে। তাই বলা যায়, প্রতিসাম্য হলো এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যেখানে কোনো পরিবর্তন করা হলেও পরিবর্তনের পর কোনোভাবে সেটি আবার ফিরে আসে আগের অবস্থায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আরও অনেক ধরনের প্রতিসাম্য থাকা সম্ভব?
আমাদের কাছে প্রতিসাম্যের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ থম্পসন এবং ফ্রান্সের কলেজ দে ফ্রান্সের গণিতবিদ টিটস আমাদের এমন একটি চূড়ান্ত ধারণা দিয়েছেন। একে আমরা ‘প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণি’ বলতে পারি। প্রতিসাম্যের ক্ষেত্রে এই ধারণা রসায়নের পর্যায় সারণির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বস্তুর জটিল গাণিতিক প্রতিসাম্য বোঝার একটি উপায় বের হয়েছে।
গাণিতিক প্রতিসাম্য গণিতবিদদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা বস্তুর বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা ওই বস্তুর আকৃতির প্রতিসাম্য থেকে বলা যায়। একটি স্ফটিক কত রকম হতে পারে, তা জানার জন্য রসায়নবিদের মূল চাবিকাঠি হলো প্রতিসাম্য। এ থেকে রসায়নবিদেরা কোনো স্ফটিকের অজানা গঠন সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। জীববিজ্ঞানীদের কাছেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি ভাইরাসের কাজ করার পদ্ধতি কেমন হবে, তা ভাইরাসটির প্রতিসাম্য থেকে বোঝা সম্ভব। এমনকি বড় বড় পাটিকেল কলাইডারে পদার্থবিজ্ঞানীরা যেসব কণা আবিষ্কার করেছেন, প্রতিসাম্য না জানলে তাদের চরিত্র বোঝা কঠিন। এমনকি মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে তথ্য সংরক্ষণের পেছনেও এর ভূমিকা আছে।
প্রতিসাম্যের ধারণা সেই প্রাচীন সভ্যতাগুলোকেও সম্মোহিত করে রেখেছিল। কিন্তু উনিশ শতক পর্যন্ত আমরা এর গাণিতিক রূপ বোঝার মতো ভাষা তৈরি করতে পারিনি। এই ভাষা আমাদের প্রতিসাম্যকে আলাদা করে শিখতে এবং এর গাঠনিক উপাদানগুলো আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে।
পদার্থের অণুকে যেমন পরমাণুর মতো ছোট কণায় ভেঙে ফেলা যায়, আবার ৩, ৫, ৭-এর মতো কিছু অবিভাজ্য মৌলিক সংখ্যা দিয়ে যেমন যেকোনো সংখ্যা তৈরি করা যায়, তেমনি অ্যাবেলের সময়কার গণিতবিদেরা আবিষ্কার করেন, কোনো প্রতিসম বস্তুকেও কিছু অবিভাজ্য প্রতিসম আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায়। তাঁরা এর নাম দেন ‘সাধারণ গ্রুপ’। এগুলোকে তুলনামূলকভাবে বলা যায় ‘প্রতিসাম্যের পরমাণু’।
অ্যাবেলের সমসাময়িক গণিতবিদেরা আবিষ্কার করেন, কিছু সাধারণ গ্রুপের পেছনে কাজ করছে কিছু মৌলিক সংখ্যা। বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা একটি ১৫ বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ নিই। এর ভেতরে থাকা একটি পঞ্চভুজ ও একটি ত্রিভুজের প্রতিসাম্য থেকেই আমরা এর প্রতিসাম্যতা তৈরি করতে পারব। এটি কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য চিন্তা করুন, আমরা এই বহুভুজটিকে পূর্ণ ঘূর্ণনের ১৫ ভাগের ১ ভাগ ঘোরাব। এতে বহুভুজটি ফিরে পাবে আগের আকৃতি। এই কাজটি এবার আমরা একটু ভিন্নভাবে করব। এর জন্য আমাদের প্রথমে বহুভুজটিকে পূর্ণ ঘূর্ণনের ৫ ভাগের ২ ভাগ ঘোরাতে হবে এবং তারপর এর উল্টো দিকে ৩ ভাগের ১ ভাগ ঘোরাতে হবে। দুবারই কিন্তু একই ফল পাওয়া যাবে, কারণ ১/১৫ = ২/৫ - ১/৩। এই বহুভুজটির ভেতর লুকিয়ে থাকা একটি ত্রিভুজ ও পঞ্চভুজের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে।
আসলে দ্বিমাত্রিক ও নিয়মিত আকৃতির যেকোনো বহুভুজের প্রতিসাম্যকে কতগুলো মৌলিক বাহুবিশিষ্ট আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায়। যেহেতু ১০৫ = ৫×৩×৭, তাই ১০৫ বাহুবিশিষ্ট কোনো বহুভুজের প্রতিসমতা একটি ত্রিভুজ, পঞ্চভুজ ও সপ্তভুজ দিয়ে তৈরি করা যাবে। থম্পসন প্রয়াত গণিতবিদ ওয়াল্টার ফেইটের সঙ্গে যৌথভাবে প্রমাণ করেন, আরও অসংখ্য বস্তুর প্রতিসাম্যকে মৌলিক সংখ্যার বাহুবিশিষ্ট আকৃতি থেকে তৈরি করা যায়। এই প্রমাণটি সাধারণ দ্বিমাত্রিক বহুভুজ ছাড়াও বহু ধরনের আকৃতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। গঠন যতই জটিল হোক না কেন, শুধু প্রতিসাম্যের সংখ্যা জানতে পারলেই এর হিসাব করা যাবে। তত্ত্বটি প্রতিসাম্যের জগৎকে বোঝার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।পাশাপাশি এ তত্ত্ব দেখতেও ছিল বিশাল—লিখতে লেগেছিল ২৫৫ পাতা। এটি ছিল সেই সময় পর্যন্ত প্রকাশিত সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই বিশাল উপপাদ্যটি ‘বেজোড় ক্রমতত্ত্ব’ নামে পরিচিত।
এই মৌলিক সংখ্যার বাহুবিশিষ্ট বহুভুজগুলো হলো গণিতবিদদের প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণির প্রথম উপাদান। কঠিন একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে উনিশ শতকের গণিতবিদেরা সম্পূর্ণ অজানা গঠনের কিছু জ্যামিতিক আকৃতির কথা জানতে পারেন। কোনো সমীকরণের মধ্যে x2, x3, x4 জাতীয় রাশি থাকলে তা সমাধান করার সূত্রগুলো ওই সময়ের গণিতবিদেরা জানতেন। কিন্তু x5 + 6x + 3 = 0-এর মতো সমীকরণ, অর্থাৎ x-এর ঘাত যদি ৫ হয়, মানে পঞ্চঘাতী সমীকরণ সমাধান করার কোনো উপায় তাঁরা জানতেন না।
ওই সময় অ্যাবেল সমস্যাটি নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন। তিনি আবিষ্কার করলেন, এই ফর্মুলার আসলে কোনো সমাধানই নেই! কেন এমনটি ঘটে, সেটা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন ফরাসি তরুণ গণিতবিদ এভারিস্ত গ্যালোয়া।তিনি ধারণা দিলেন, প্রতিটি সমীকরণের পেছনে একটি প্রতিসম বস্তু কাজ করছে! সমীকরণের পেছনে যে প্রতিসাম্য কাজ করছে, তার প্রথম ধারণা পাওয়া যায় x2 = 4-এর মতো দ্বিঘাত সমীকরণ থেকে। আমরা সবাই জানি, এই সমীকরণের দুটি সমাধান, x = 2 ও x = -2। এই সমাধান দুটি একে অন্যের দর্পণ প্রতিবিম্ব। একটি ত্রিঘাতী সমীকরণের তিনটি সমাধান—একটি ধনাত্মক, একটি ঋণাত্মক আর অন্যটি কাল্পনিক সংখ্যা। এই সমীকরণগুলো একটি ত্রিভুজের প্রতিসাম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। চতুর্ঘাতী সমীকরণের সমাধান হয় মোট চারটি, আর এগুলো একটি টেট্রাহ্যাড্রন বা চতুস্তলকের প্রতিসাম্যের সঙ্গে যুক্ত। চারটি সমবাহু ত্রিভুজকে জুড়ে দিলে আমরা যে ত্রিমাত্রিক কাঠামো পাই, সেটাই টেট্রাহ্যাড্রন।
গ্যালোয়া দেখতে পেলেন, কোনো সমীকরণের পেছনে ঠিক যে জ্যামিতিক বস্তুর প্রতিসাম্য কাজ করছে, সেই বস্তুটিকে যদি মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট কতগুলো আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে সেই সমীকরণের সমাধান থাকবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে বুঝতে হবে, এর কোনো প্রতিসাম্য নেই। সমীকরণের সমাধানের সঙ্গে প্রতিসাম্যের এই অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ থেকেই প্রথম বোঝা গিয়েছিল, প্রতিসাম্য এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, যার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে প্রতিসাম্যের কোনো মিলই নেই!
পঞ্চঘাতী সমীকরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গ্যালোয়া দেখলেন, এর সমাধানের মূলে রয়েছে একটি ডোডেকাহ্যাড্রন বা দ্বাদশতলকের প্রতিসাম্য। ১২টি পঞ্চভুজকে জুড়ে দিলে যে ত্রিমাত্রিক কাঠামো পাওয়া যায়, সেটাকে দ্বাদশতলক বলা হয়। একটি দ্বাদশতলককে যেহেতু কয়েকটি মৌলিক বাহুবিশিষ্ট আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায় না, তাই পঞ্চঘাতী সমীকরণের কোনো সমাধানও নেই। একটি দ্বাদশতলককে মোট ৬০ভাবে ঘোরানো সম্ভব; এসব ক্ষেত্রে ঘোরানোর পরও একে ঠিক আগের মতো দেখা যাবে। অর্থাৎ দ্বাদশতলকের ৬০টি ঘূর্ণন প্রতিসাম্য আছে। ৬০ সংখ্যাটিকে অনেকভাবে ভাগ করা যায়, কিন্তু ১০৫-কে যেমন ৩, ৫ ও ৭-এর মতো তিনটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল হিসেবে দেখাতে পেরেছিলাম, ৬০-কে সেভাবে ভাঙা যায় না।
পঞ্চঘাতী সমীকরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গ্যালোয়া দেখলেন, এর সমাধানের মূলে রয়েছে একটি ডোডেকাহ্যাড্রন বা দ্বাদশতলকের প্রতিসাম্য। ১২টি পঞ্চভুজকে জুড়ে দিলে যে ত্রিমাত্রিক কাঠামো পাওয়া যায়, সেটাকে দ্বাদশতলক বলা হয়।
দ্বাদশতলকের সঙ্গে ত্রিভুজ ও সপ্তভুজের মতো মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট আকৃতির মিল পাওয়ার পর গণিতবিদেরা এমন আর কী কী পাওয়া যায়, সেটা খুঁজে বের করতে শুরু করলেন। কিন্তু এবার তাঁরা একটু ভিন্ন পথে চেষ্টা করলেন। দেখা গেল, বস্তুর ঘূর্ণন বা প্রতিফলনের সঙ্গে তাস শাফল করার একটা অদ্ভুত মিল আছে। একটি চতুস্তলকের সাহায্যেই আমরা ব্যাপারটা ভালোমতো বুঝতে পারব। চতুস্তলকটিকে যদি এর ত্রিভুজ তলের ওপর রাখা হয়, তবে এটাকে ১২ ভাবে ঘোরানো সম্ভব। এবং প্রতিবার চতুস্তলকটি ঘোরানো হলেও একে আবার আগের মতো দেখা যাবে। অর্থাৎ এর ১২টি ঘূর্ণন প্রতিসাম্য রয়েছে। পাশাপাশি এর ১২টি প্রতিফলন প্রতিসাম্য রয়েছে।
এবার আমরা যদি চতুস্তলকের প্রতিটি তলের ওপর একটি করে ইস্কাপনের টেক্কা, রাজা, রানি ও গোলাম সেঁটে দিই এবং এরপর এটাকে ঘোরাই, তাহলে এই ঘোরানো আর চারটি কার্ড শাফল করা দেখতে একই মনে হবে। এভাবে চার কার্ডের শাফল করলে এটি ২৪ সমাবেশের যেকোনো একটি রূপ নিতে পারে। আর চতুস্তলকের মোট প্রতিসাম্য আছে ১২ + ১২ = ২৪। ফলে দুটোর ফল একই রকম হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি একটা দ্বাদশতলক ৬০টি প্রতিসাম্য ও ৫টি কার্ডের শাফল করার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
এই শাফল পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, ত্রিমাত্রিক কাঠামোর সংখ্যা সীমিত হলেও আমরা কার্ডের সংখ্যা বাড়িয়ে আরও অনেক অজানা গঠনের প্রতিসাম্য বানাতে পারি। গণিতবিদেরা কার্ড শাফল করার পদ্ধতি জানার পর দেখা গেল, ডোডেকাহ্যাড্রনই একমাত্র আলাদা বৈশিষ্ট্যের বস্তু নয়, বরং এর মতো আরও অসংখ্য বস্তু রয়েছে। মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট গ্রুপগুলোর মতো প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণিতে এরাও নতুন ধরনের গ্রুপ হিসেবে যোগ হলো। এদের আমরা শাফল গ্রুপ বলেও ডাকতে পারি।
প্রতিসাম্য ও উচ্চমাত্রার জগত
এ পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। কিন্তু আরও বেশি আশ্চর্যের জিনিস বেরিয়ে আসবে, যখন আমরা তিন মাত্রার চেয়েও উচ্চমাত্রার আকৃতি সম্পর্কে বুঝতে পারব এবং হাইপারস্পেসে প্রবেশ করব। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর মতো মৌলিক কণাদের আচরণ ব্যাখ্যা করার মূল চাবিকাঠি হলো এই উচ্চমাত্রার আকৃতিগুলোর প্রতিসাম্য। অর্থাৎ কোয়ান্টাম মেকানিকসের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মূলেও রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রতিসাম্য। পদার্থবিজ্ঞানে আমরা যে ভরবেগ বা শক্তির সংরক্ষণশীলতা সূত্রের কথা জেনেছি, তার সঙ্গেও প্রতিসাম্যের যোগাযোগ আছে। ১৯১৫ সালে গণিতবিদ এমি নোয়েদার নামে একজন জার্মান গণিতবিদ আবিষ্কার করেন, পদার্থবিজ্ঞানের যেসব সংরক্ষণশীলতা সূত্র আছে, সেগুলোর মূলেও রয়েছে প্রতিসাম্য।
বুঝতেই পারছেন, এবার আমাদের একটু উচ্চমাত্রার বস্তুর প্রতিসাম্য নিয়ে আলোচনা করা উচিত। রেনে দেকার্ত আবিষ্কৃত স্থানাঙ্ক পদ্ধতির কারণে গণিতবিদরা হাইপারস্পেসের বিভিন্ন বস্তু নিয়ে কাজ করতে পারেন। এই স্থানাঙ্ক পদ্ধতির সাহায্যে জ্যামিতিকে কিছু সংখ্যায় পরিণত করে ফেলা যায়।
একটি মানচিত্রের মধ্যে থাকা যেকোনো বিন্দুকে আমরা মাত্র দুটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। অর্থাৎ একটি মানচিত্র আমরা সহজেই সংখ্যায় রূপান্তর করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি বর্গক্ষেত্রকে তার চারটি কোণের স্থানাঙ্ক দিয়ে বর্ণনা করা যায়: (০,০), (১,০), (০,১), (১,১)। এতে একটি নতুন স্থানাঙ্ক যোগ করার অর্থ হলো, আপনি একটি নতুন মাত্রা যোগ করছেন। অর্থাৎ আমরা এখন একটি ঘনকের আটটি কোণের স্থানাঙ্ককেও (০,০,০), (০,০,১) এভাবে নির্দিষ্ট করে দিতে পারব।
আচ্ছা, তাহলে একটি চারমাত্রিক ঘনকের ক্ষেত্রে কী হবে? যদিও এবার ছবি দিয়ে আর কাজ চলবে না, তবে সংখ্যা কিন্তু ঠিকই কাজে লাগবে। চারমাত্রিক ঘনকের কোনো ছবি কল্পনা করতে না পারলেও আপনি কিন্তু এর স্থানাঙ্ক ঠিকই লিখে ফেলতে পারবেন। আর এই বিষয়টিই আমাদের এই বস্তুর জ্যামিতি ও প্রতিসাম্য সম্পর্কে জানার উপায় বলে দেবে। চারমাত্রিক ঘনক সবার কাছে ‘টেসারেক্ট’ নামে পরিচিত। এতে মোট ১৬টি কোণ, ৩২টি প্রান্ত আর ২৪টি বর্গাকৃতির মুখ থাকে। আটটি ত্রিমাত্রিক ঘনকের সাহায্যে এটি তৈরি করা যায়।
গণিতবিদরা দেখলেন, এই প্রতিসাম্যগুলো অন্য একটি পরিবারের প্রতিসাম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই পরিবারের প্রতিসাম্যগুলোকে বলা হয় ‘লাই’ গ্রুপ। নরওয়ের গনিতবিদ সোফাস লাইয়ের নামে গ্রুপটির নামকরণ করা হয়েছে। লাই গ্রুপের নতুন ১৬টি পরিবারের একটির পেছনে রয়েছে এই টেজারেক্টের প্রতিসাম্যগুলো। আর এটিই লাই গ্রুপের অজানা বিষয়গুলো উন্মোচন করেছে। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেলজিয়াম-বংশদ্ভুত গণিতবিদ টিটস অ্যাবেল পুরস্কার পান। টিটস উচ্চমাত্রায় যে জ্যামিতিক বিন্যাস তৈরি করেন, তা এই গ্রুপের প্রতিসাম্যগুলো বুঝতে সাহায্য করে।
প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণিতে যোগ করার মতো আরও কিছু গ্রুপ রয়েছে। তবে এগুলো আবার লাই গ্রুপ, শাফল গ্রুপ বা মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট বহুভুজের মতো ভালো আচরণ করে না। উনিশ শতকের শেষ দিকে এমিলি ম্যাথু নামে এক ফরাসি গণিতবিদ এমন পাঁচটি অবিভাজ্য প্রতিসাম্য আবিস্কার করেন, যেগুলোর সঙ্গে ওপরের কোনো গ্রুপেরই মিল নেই। আরও বড় সমস্যা হলো, এরা নিজেরা মিলেও কোনো ধরনের গ্রুপ তৈরি করে না! এদের দেখে মনে হচ্ছে, অবিভাজ্য প্রতিসাম্যের জগতে এরা যেন অনেকটা এতিম। গণিতবিদরা তাই এদের নাম দিলেন, ‘বিক্ষিপ্ত গ্রুপ’। এখন প্রশ্ন হলো, প্রতিসাম্যের জগতে এই পাঁচটিই কি একমাত্র ব্যতিক্রম? নাকি এমন আরও বিক্ষিপ্ত গ্রুপ থাকতে পারে?
লাই গ্রুপের নতুন ১৬টি পরিবারের একটির পেছনে রয়েছে এই টেজারেক্টের প্রতিসাম্যগুলো। আর এটিই লাই গ্রুপের অজানা বিষয়গুলো উন্মোচন করেছে। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেলজিয়াম-বংশদ্ভুত গণিতবিদ টিটস অ্যাবেল পুরস্কার পান।
১৯৬৫ সালে থম্পসন ক্রোয়েশিয়ান গণিতবিদ ইজভোনিমির জ্যাঙ্কোর কাছ থেকে একটি চিঠি পান। জ্যাঙ্কো তাতে দাবি করেন, তিনি ষষ্ট একটি বিক্ষিপ্ত গ্রুপ আবিস্কার করেছেন। থম্পসন অবশ্য প্রথমে এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জ্যাঙ্কোর প্রস্তাবটি বিশ্লেষণ করার পর তিনি বুঝতে পারলেন, ক্রোয়েশিয়ান এই গণিতবিদ সম্ভবত কিছু একটা খুঁজে পেয়েছেন।
জ্যাঙ্কোর আবিস্কারের ফলে প্রতিসাম্যের ইতিহাসে এক পাগলাটে যুগের শুরু হয়, যেখানে গণিতবিদরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অদ্ভুত সব অবিভাজ্য বিক্ষিপ্ত গ্রুপ আবিষ্কার করতে থাকেন, যেগুলোর সঙ্গে আগের কোনো প্রজন্মেরই মিল নেই। সেরকম একটি বিক্ষিপ্ত প্রতিসাম্য গ্রুপে কতগুলো প্রতিসাম্য থাকতে পারে, তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য যে সূত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে অনেকগুলোই ছিল থম্পসনের আবিষ্কৃত।
মজার বিষয় হলো, মৌলিক কণা আবিষ্কার ও বিক্ষিপ্ত গ্রুপগুলোর জন্মকে প্রায়ই একইভাবে দেখা হয়। মৌলিক কণাদের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভেতর যে প্রতিসাম্য লুকিয়ে রয়েছে, তা উন্মোচন করার পর বিজ্ঞানীরা চার্ম কোয়ার্কের মতো বিভিন্ন কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। এই ভবিষ্যদ্বাণীর বেশ কবছর পর এসব কণার অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। তেমনিভাবে থম্পসনের সূত্র ব্যবহার করে গণিতবিদরা এমনসব গঠন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যেগুলো তাঁরা আগে কখনো তৈরি করেননি।
জ্যাঙ্কোর আবিস্কারের ফলে প্রতিসাম্যের ইতিহাসে এক পাগলাটে যুগের শুরু হয়, যেখানে গণিতবিদরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অদ্ভুত সব অবিভাজ্য বিক্ষিপ্ত গ্রুপ আবিষ্কার করতে থাকেন, যেগুলোর সঙ্গে আগের কোনো প্রজন্মেরই মিল নেই।
থমসন ও টিটসের নাম এই বিক্ষিপ্ত গ্রুপগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যে সময়টায় এ ধরনের গঠন প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কার হচ্ছিল, তার চরম মুহূর্তে বার্নড ফিশার নামে এক জার্মান গণিতবিদ এমন একটি বস্তুর কথা বলেন, যা কেবল ১৯৬৮৮৩ মাত্রার স্থান থেকেই দেখা সম্ভব। এই বস্তুটির প্রতিসাম্যের সংখ্যা এমনকি সূর্যে যতগুলো পরমাণু আছে, তার চেয়েও বেশি। এটি গণিতবিদদের কাছে ‘দৈত্য’ নামে পরিচিত। এটিই আমাদের জানা সবচেয়ে বড় বিক্ষিপ্ত গ্রুপ। বাস্তব জগতের সঙ্গে এর কোনো ধরনের মিল খুঁজে না পেয়ে বহুদিন একে নিয়ম-শৃঙ্খলাহীন খামখেয়ালী বলেই ভাবা হতো। অবশেষে আমরা বুঝতে শুরু করেছি, এই দৈত্যটির প্রতিসাম্য সম্ভবত স্ট্রিং থিওরির কিছু গভীর ধারণাকে আরও শক্তিশালী করছে। এই স্ট্রিং থিওরি হলো আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিকসকে একীভূত করার জন্য বর্তমানের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব।
গণিতবিদদের ধারণা, এই দৈত্যটিই সম্ভবত শেষ। প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণিতে যোগ করার মতো আর কোনো অবিভাজ্য প্রতিসাম্য সম্ভবত নেই। অনেকেই মনে করেন, আমরা প্রতিসাম্যের যে পর্যায় সারণিটি তৈরি করেছি, গণিতের ক্ষেত্রে তা বড় অর্জনগুলো মধ্যে একটি। থম্পসন ও টিটসের মতো গণিতবিদদের কাজের ফলে আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি, এই সারণিটি পূর্ণ হয়েছে। আর এটাই গাণিতিক প্রমাণের শক্তি। এই প্রতিসাম্যের পরমাণুগুলো দিয়ে আমরা কী ধরনের জিনিস তৈরি করব, সেটা নির্ভর করবে পরবর্তী প্রজন্মের গণিতবিদদের ওপর।