আমরা কি পাইকে খুঁজে পাই, নাকি তৈরি করি
পাই আসলে কী? এটি কি মহাবিশ্বে আগে থেকেই রয়েছে, যাকে আমরা শুধু খুঁজে পাই? নাকি এটি কৃত্রিম, আমরাই এটি তৈরি করি? যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের হান্টার কলেজের পিউর ম্যাথমেটিকস বিভাগের প্রমা তানজিম আহমেদের কলমে পড়ুন পাইয়ের কথা, এর পেছনের মৌলিক প্রশ্ন, দর্শন ও ভাবনা।
পাইয়ের কথা প্রথম শুনি ২০১০ সালে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উৎসবের আঞ্চলিক পর্বে। সদ্য চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠা আমার জন্য পাই ছিল এক রহস্যময় বস্তু। সেই রহস্যময় বস্তু পরে হয়ে ওঠে রোজকার গণনার ধ্রুব সত্য। সেই দশ বছর বয়সে আমি জানতাম না অমূলদ সংখ্যা কী জিনিস বা পাই কী। সেই সময় পর্যন্ত আমার দৌড় ছিল ভগ্নাংশ পর্যন্ত। তখন জেনেছিলাম, পাইয়ের মান ৩.১৪১৫…. এরপর সেই মান চলতেই থাকবে। পাইয়ের শেষ কোথায়, তা আমরা আজও জানি না। সেই সময়ে কোনো এক বইয়ে পড়েছিলাম, পাইয়ের মান ২২/৭ ধরে অংক করতে। বোকা বোকা আমি ভাবলাম, তাই যদি লেখা যায়, তাহলে এরপরের অংকমান কেন বের করতে পারব না! যেই কথা, সেই কাজ; ক্যালকুলেটরে ভাগ করে দেখলাম ঘটনা কী। হিসেব কষে দেখি, অংকমান তো ফিরে ফিরে আসছে পর্যায়ক্রমে, কী ব্যাপার! (তখনো আমি অমুলদ সংখ্যা বা পুনঃপৌনিকতা কী, তা জানি না।)
ইতিহাসে পাই নিয়ে মাতামাতি
আমার সেই শৈশবের ভুল ধারণা পরের কয়েক বছরে ভেঙে যায়। আমি জানতে পারি, পাই আসলে কী। পাই নিয়ে কেন এত মাতামাতি। পাই ঠিক পপুলার পাই হয়ে ওঠার আগে ইতিহাসের পাতা অনুসারে প্রাচীন গ্রিসে বৃত্তনির্ভর ধ্রুব ধারণার একটি অংশ ছিল। বৃত্তকে প্লেটো দেখতেন এক চিরন্তন আর আদর্শ রূপ হিসেবে। তাঁর ভাষ্যে বৃত্ত বস্তুজগতের বাইরে এক অবিনশ্বর বাস্তবতায় বিদ্যমান। বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত সর্বদা একই থাকে, এই আদর্শ ধারণাকে দৃঢ় করেছিলেন প্লেটো। সেই ধারণার মাধ্যমে গণিতের চিরন্তন সত্যের দরজা খুলে যায়। অন্যদিকে দার্শনিক অ্যারিস্টটল গণিতকে দেখেছিলেন বাস্তব জগতের বিমূর্ত এক বিজ্ঞান হিসেবে। যা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না, কিন্তু যুক্তির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫০ অব্দে আর্কিমিডিস পাইয়ের মানকে সীমাবদ্ধ করেছিলেন ২২/৭ আর ২২৩/৭১–এর মধ্যে। সেই মান থেকে আদর্শ বৃত্তের সরল সৌন্দর্য আর সংখ্যাগত মানের অনন্ত জটিলতার দ্বন্দ্ব দেখা যায়। তখন পর্যন্ত একটি অনুপাত হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল পাইয়ের ধারণা। মধ্যযুগে এসে পাই ধর্ম তত্ত্বে প্রবেশ করে। দার্শনিক অগাস্টিন ও অন্য দার্শনিকেরা জ্যামিতিকে ঈশ্বরের মহাজাগতিক শৃঙ্খলার প্রতিফলন হিসেবে দেখতেন। পাইয়ের অপরিবর্তনীয় মান তাঁদের কাছে ছিল ঈশ্বরের চিন্তার মধ্যে বিদ্যমান এক শাশ্বত সংখ্যা। মানুষ সেই ঐশ্বরিক মান আংশিকভাবে জানতে পারে। সেই সময়ে পাইয়ের দশমিকের পরের মানে অসীমতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব ছিল এর স্থিতিশীলতার। একই অনুপাত সব জায়গায় থাকে বলে মনোযোগ আকর্ষণ করে এটি।
পাই যখন যুক্তির প্রতীক
১৭০৬ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ উইলিয়াম জোন্স প্রথম পাই (π—গ্রিক পাই বর্ণ) প্রতীকটি ব্যবহার করেন। আর সুইডিশ গণিতবিদ লিওনার্দো অয়লার একে জনপ্রিয় করেন তাঁর বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে। রেনেসাঁ যুগের জন্য পাই ছিল যুক্তির জয়ের প্রতীক। অনন্ত দশমিকের শৃঙ্খল ভেঙে মানুষ তাকে পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারবে, এমন প্রত্যয় ছিল তখন। এই অনন্ত, অপ্রতিধ্বনিমূলক দশমিক রূপ ক্রমশ মনে করিয়ে দেয়, মানুষের যুক্তি যত শক্তিশালীই হোক না কেন, অসীমতা সম্পূর্ণভাবে ধরা যাবে না হয়তো। ১৮৮২ সালে ফার্ডিনান্ড ভন লিন্ডেমান প্রমাণ করেন, পাই এক তুরীয় বা ট্রান্সিডেন্টাল সংখ্যা। যৌক্তিক গুণাঙ্কযুক্ত বহুপদী সমীকরণের মূল পাই হতে পারে না। প্রাচীন বৃত্তকে চতুর্ভুজ হিসেবে পরিণত করা অসম্ভব হয়ে যায় তখন থেকে। অনেক প্রশ্ন চলে আসে আমাদের সামনে।
অসীম পাইয়ের পথচলা
বর্তমান কালে কম্পিউটারের মাধ্যমে পাইয়ের কোটি কোটি ঘর পর্যন্ত মান বের করা সম্ভব হচ্ছে। মান দেখতে এলোমেলো হলেও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আসে। এই বৈপরীত্য দর্শনে নিয়তিবাদ বনাম বিশৃঙ্খলা কিংবা ফ্রি উইল বিতর্ককে নতুন মাত্রা দেয়। কঠোর নিয়ম মেনে গঠনমূলক একটা জায়গা থেকেও কীভাবে এলোমেলো ছাপ তৈরি হতে পারে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায় যদি পাই স্বাভাবিক সংখ্যা হয়। স্বাভাবিক হলে এর মানের কোনো এক পর্যায়ে আপনার জন্মতারিখ থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব লেখা, সব সুর, এমনকি ইতিহাসে প্রকাশিত সমগ্র বইয়ের তথ্য লুকিয়ে থাকতে পারে।
হোর্হে লুইস বোর্হেসের অসীম গ্রন্থাগারের ধারণার সঙ্গে বিষয়টির তুলনা করা যায়। অসীম গ্রন্থাগার এক কল্পিত গ্রন্থাগার, যা অসংখ্য ষড়ভুজ কক্ষ নিয়ে গঠিত। প্রতিটি কক্ষে সমান আকারের বই সাজানো থাকে। প্রতিটি বই একই সংখ্যক পৃষ্ঠা, লাইন ও অক্ষরে ভরা, আর ২৫টি নির্দিষ্ট চিহ্ন ব্যবহার করে লেখা। এই গ্রন্থাগারে সম্ভাব্য সব বই রয়েছে। অর্থহীন অক্ষরমালা থেকে শুরু করে আপনার জীবনী, ভবিষ্যদ্বাণী আছে সেখানে। প্রতিটি বইয়ের অসংখ্য ভিন্ন সংস্করণ থাকবে। সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক হলেও বিষয়বস্তু এলোমেলো থাকবে আর প্রায় অসীম মনে হবে।
পাইয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ সংখ্যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যদি একটি সংখ্যা সাধারণ হয়, তবে তার দশমিক অংশে যেকোনো অঙ্ক প্রায় একই পরিমাণে সমান ফ্রিকোয়েন্সিতে (অর্থাৎ নির্দিষ্ট ক্রম পরপর) উপস্থিত থাকবে। এই হিসেবে পাই যদি সাধারণ সংখ্যা হয়, তবে অসীম দশমিক ধারায় সম্ভাব্য প্রতিটি ক্রম, প্রতিটি লেখা, ছবি, বা তথ্য কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে। বাস্তব কোনো গ্রন্থাগারে সত্যিকার একটি নির্দিষ্ট বই খুঁজে পাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি পাইয়ের সংখ্যা লেজ থেকে নির্দিষ্ট কিছু উদ্ধার করা বেশ অসাধ্য কাজ! সম্ভাবনা তত্ত্ব দিয়েই ভেবে দেখতে পারেন বিষয়টি।
পাইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন
প্লেটোনিক ভাবনায় গণিতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বস্তু—যেমন পাই, মৌলিক সংখ্যা, জ্যামিতির বিভিন্ন রূপ মানুষের মস্তিষ্কের বাইরে এক বিমূর্ত বাস্তবতায় বিদ্যমান। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, পাই মহাবিশ্বে মানুষের অস্তিত্বের আগেই ছিল। মানুষের বিলুপ্তির পরও থাকবে। একে আবিষ্কার করা মানে আমরা কেবল চিরন্তন গণিতের ভান্ডার থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। অন্য দৃষ্টিতে বলা যায়, নমিনালিজম বা কনস্ট্রাক্টিভিজম অনুসারে পাই কেবল মানুষের তৈরি প্রতীকী কাঠামোর ফল (আমার নিজস্ব ভাবনাও এমন)। পাইয়ের অস্তিত্ব কেবল আমাদের সংজ্ঞা ও মাপজোখের ভেতরে। এই বিতর্ক আসলে বাস্তবতা বনাম কল্পনা বা ধারণার এক মৌলিক প্রশ্নকে ছুঁয়ে যায়। আমরা কি পাইকে খুঁজে পাই, নাকি তৈরি করি? ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো জিজ্ঞাসার সঙ্গে কি একে তুলনা করা যায়?
পাই খোঁজার সংগ্রাম
অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মধ্যে জ্যাঁ পল সাত্রে বা আলবেয়ার কামু মানুষকে এমন এক সত্তা হিসেবে দেখেছেন, যার জীবন আসলে অর্থহীন এক মহাবিশ্বে অর্থ খোঁজার সংগ্রাম। পাইয়ের অসীম মান, অপ্রতিধ্বনিমূলক দশমিক ধারা এখানে এক গভীর রূপক হয়ে ওঠে। আমরা জানি, পাইয়ের সংজ্ঞা বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত, কিন্তু পাইয়ের সব মান কখনো জানা যাবে না। জানতে পারব না আমরা। মানুষের জ্ঞানান্বেষণের প্রকৃতি তো এমনই, যার শেষ নেই। সম্পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও আমাদের সামনে থাকে কেবল আংশিক জ্ঞান। অস্তিত্ববাদের ভাবনা থেকে বলা যায়, পাই মানুষকে অহেতুক ধারণা গ্রহণ করার জন্য রূপক হিসেবে গ্রহণের সুযোগ দেয়।
পাই যখন বিস্ময়
পাই নিজেই এক বিস্ময়। পাইয়ের অসীম দশমিক ধারা প্রায় এলোমেলো বলে মনে হয়। আসলে এটি একটি নিখুঁত ও নির্ধারিত সূত্র অনুসরণ করে। একই নিয়ম ও শুরুর শর্ত দিলে কম্পিউটার সব সময় একই ক্রমে সংখ্যা বের করবে। এখানে কোনো ভাগ্য বা জাদুর চমক বা ভূমিকা নেই। শূন্য থেকে নয়, প্রতিটি সংখ্যা প্রায় সমান বার আসে। অঙ্কের জোড়া, ত্রয়ী, ও দীর্ঘক্রম আসে। প্রকৃত এলোমেলো ধারার মতো ও পুনরাবৃত্তিহীনভাবে দেখা যায়। সোভিয়েত গণিতবিদ অ্যান্ড্রে কলমোগরভের ‘কলমগোরভ জটিলতা’র ধারণা অনুযায়ী, অসীম পাই ধারা একটি ছোট অ্যালগরিদম থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ সীমিত নিয়ম থেকে অসীম তথ্য তৈরি সম্ভব। পাইয়ের মাধ্যমে তথ্যতত্ত্ব সম্পর্কে এক দার্শনিক উপলব্ধি আসে আমাদের। সীমিত কাঠামো থেকে অসীম সম্ভাবনা উন্মোচনের সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
পাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য
পাই প্রমাণ করে, কিছু সত্য আমরা সংজ্ঞার মধ্যে পুরোপুরি জানতে পারলে খুঁটিনাটি কখনো শেষ করে জানা সম্ভব নয়। বিষয়টা অনেকটা কার্ট গ্যোডেলের ‘ইনকমপ্লিটনেস উপপাদ্যে’র মতো। এই উপপাদ্য একই সঙ্গে ঈশ্বরীয় ধ্রুবক, অস্তিত্ববাদী রূপক, প্লেটোনিক আদর্শ ও তথ্যতাত্ত্বিক বিস্ময় হিসেবে পৃথিবীতে বিরাজমান। আপনি কোন দলে থেকে কীভাবে পাইকে গ্রহণ করতে চান, তা একমাত্র আপনার ওপরই নির্ভর করছে। দিনশেষে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, আবার গুরুত্বহীনও হতে পারে। গণিত নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে একটা কথা বলতেই পারি, মানবজাতি যতদিন থাকবে, পাই আমাদের জীবনে একটি বিশেষ রূপক হয়ে থাকবে। পাইয়ের মান আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয়, জ্ঞানভিত্তিক চর্চায় অসীমতা কোনো বাধা নয়। বরং চিন্তার অনন্ত পথে এটি আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। আমি-আপনি সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিচ্ছি কী না, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের। পাইয়ের মান চলবেই, আমাদের চিন্তাও চলতে থাকবে।