কল্পনা করুন, আপনি কারও জীবন ফিরিয়ে দিলেন, নিজের হাতে তিলে তিলে গড়ে তুললেন সবকিছু। কিন্তু যে মুহূর্তে সে চোখ মেলল, তার দিকে তাকিয়ে আপনি নিজেই ভয়ে শিউরে উঠলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলেন প্রচণ্ড ঘৃণায়। যে সৃষ্টি তার স্রষ্টার কাছে একটু ভালোবাসা চাইল, বিনিময়ে পেল শুধু ধিক্কার আর অবহেলা। সেই সৃষ্টি যদি কালক্রমে দানব হয়ে ওঠে, তবে দোষটা কার? যে তাকে বানিয়েছে তার, নাকি সেই কুৎসিত শরীরটার?
মেরি শেলির কালজয়ী উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ বা ‘দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ আমরা অনেকেই পড়েছি। গত ২০০ বছরে এই গল্প নিয়ে শত শত মুভি হয়েছে। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে মেক্সিকান পরিচালক গিলের্মো দেল তোরো পর্দায় যে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নিয়ে এলেন, তা আমাদের চেনা সেই হরর গল্পের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। এটি শুধু ভয়ংকর এক দানবের গল্প নয়, এটি বিজ্ঞানের অহংকার আর মানবিকতার এক করুণ ট্র্যাজেডি।
নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি দেখার পর আপনি হয়তো রাতে ঘুমাতে পারবেন না। ভয়ে নয়, এক অদ্ভুত বিষাদে।
গল্পের প্রেক্ষাপট সেই উনিশ শতকের ইউরোপ। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞানী। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাধারণ বিজ্ঞানের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। সে চায় মৃত্যুকে জয় করতে। সে বিশ্বাস করে, বিজ্ঞান দিয়ে মৃত কোষে আবার প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব।
কবরস্থান থেকে চুরি করা লাশ, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর জোড়াতালি দেওয়া শরীর—এই দিয়েই ভিক্টর তার ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে এক বিশালদেহী মানবাকৃতি। এক ঝড়ের রাতে বিদ্যুতের ঝলকানিতে সেই মৃতদেহে প্রাণ ফিরে আসে। কিন্তু জেগে ওঠার পর ভিক্টর আবিষ্কার করে, সে মানুষ বানাতে গিয়ে এক বিভীষিকা তৈরি করেছে। ভয়ে সে তার সৃষ্টিকে ফেলে পালিয়ে যায়।
একজনরে
মুভির নাম: ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
পরিচালক: গিলারমো দেল তোরো
ধরন: ভৌতিক, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার, নাটক
প্রকাশকাল: ২০২৫
ব্যাপ্তি: ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৫
২০২৫ সালে এসে মেক্সিকান পরিচালক গিলের্মো দেল তোরো পর্দায় যে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নিয়ে এলেন, তা আমাদের চেনা সেই হরর গল্পের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে।
আর এখান থেকেই শুরু হয় আসল গল্প। সেই নামহীন সৃষ্টি একা একা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করে। সে কথা বলতে শেখে, ভাবতে শেখে, এমনকি ভালোবাসতেও চায়। কিন্তু তার বীভৎস চেহারা দেখে সমাজ তাকে দানব বলে তাড়িয়ে দেয়। প্রত্যাখ্যানের আগুনে পুড়ে সেই অবুঝ সৃষ্টি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে এক প্রতিহিংসাপরায়ণ দানব। সে তার স্রষ্টাকে খুঁজে বের করার শপথ নেয়।
গিলের্মো দেল তোরো বরাবরই দানবদের ভালোবাসেন। তার দ্য শেপ অফ ওয়াটার বা হেলবয় যারা দেখেছেন, তাঁরা জানেন তিনি দানবকে ঘৃণার চোখে দেখেন না। এই মুভিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মুভির ভিজ্যুয়াল বা দৃশ্যগুলো এক কথায় অনবদ্য। কুয়াশাচ্ছন্ন লন্ডন, বরফে ঢাকা পাহাড়, আর ভিক্টরের সেই অন্ধকার ল্যাবরেটরিকে এক হাড়হিম করা পরিবেশ তৈরি করেছেন তিনি। এখানে ভিএফএক্স বা কম্পিউটার গ্রাফিক্সের চেয়ে প্র্যাকটিক্যাল ইফেক্টস বা মেকআপের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। জ্যাকব এলর্দির মেকআপ এতই নিখুঁত যে, তার চামড়ার সেলাইগুলো দেখলে আপনার গা গুলিয়ে উঠবে। আবার তার চোখের দিকে তাকালে মায়া হবে।
ভিক্টোরের সেই নামহীন সৃষ্টি একা একা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করে। সে কথা বলতে শেখে, ভাবতে শেখে, এমনকি ভালোবাসতেও চায়।
দর্শকদের জন্য এই সিনেমাটি এক বড় প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কি আসলেই একজন ভিশনারি, নাকি একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন পাগল বিজ্ঞানী?
ভিক্টর বিজ্ঞানের শক্তি ব্যবহার করে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, প্রাণ সৃষ্টি করলেই দায়িত্ব শেষ। কিন্তু বিজ্ঞান যে শুধু আবিষ্কার নয়, সেই আবিষ্কারের ফলাফলের দায়ভার নেওয়াটাও যে বিজ্ঞানেরই অংশ, ভিক্টর তা ভুলে গিয়েছিলেন।
বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমরা আজ যে কাজ করছি, তার নৈতিকতা নিয়েও এই মুভি আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। আমরা যদি এমন কিছু তৈরি করি, যা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী, এবং পরে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি বা তাকে ছুড়ে ফেলি, তবে তার পরিণতি কী হতে পারে?
মুভিতে প্রাণভোমরা হলো এর কাস্টিং। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন চরিত্রে অস্কার আইজ্যাক দুর্দান্ত। তার চোখেমুখে একই সঙ্গে পাগলামি, অহংকার আর শেষের দিকে অনুশোচনার ছাপ স্পষ্ট। তিনি এমনভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন যে, আপনি তাকে ঘৃণা করবেন, আবার তার অসহায়ত্ব দেখে কষ্টও পাবেন।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন জ্যাকব এলর্ডি। ৭ ফুটের এই বিশালদেহী অভিনেতাকে দানব চরিত্রে চেনার উপায় নেই। তার সংলাপ খুব কম, কিন্তু গোঙানি আর চোখের ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীতে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে জন্ম নেওয়া কতটা যন্ত্রণার। তার হাঁটাচলায় একধরনের জড়তা ছিল, যেন সদ্য মৃতদেহ থেকে জেগে ওঠা কোনো শিশু হাঁটতে শিখছে।
মুভিতে প্রাণভোমরা হলো এর কাস্টিং। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন চরিত্রে অস্কার আইজ্যাক দুর্দান্ত। তার চোখেমুখে একই সঙ্গে পাগলামি, অহংকার আর শেষের দিকে অনুশোচনার ছাপ স্পষ্ট।
আপনি যদি সস্তা ভূতের ভয় পেতে চান, তবে এই মুভি আপনার জন্য নয়। কিন্তু আপনি যদি এমন এক সায়েন্স ফিকশন বা হরর ড্রামা দেখতে চান, যা আপনার মস্তিষ্কে ধাক্কা দেবে, তবে এই মুভি দেখতে পারেন।
এখানে নায়ক কে আর খলনায়ক কে—তা বোঝা দায়। স্রষ্টা ভিক্টর, নাকি তার সৃষ্টি? মুভিটি দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে, আসল দানব কি ওই কুৎসিত শরীরটা, নাকি মানুষের ভেতরের নিষ্ঠুরতা?
মুভির প্রতিটি ফ্রেম যেন একেকটি পেইন্টিং। আলো-ছায়ার খেলা এবং আবহ সঙ্গীত আপনাকে গল্পের ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে।
‘আমি ভালোবাসা চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাকে ঘৃণা করতে শেখালে’—দানবের এই হাহাকার আপনাকে কাঁদাবে।
গিলের্মো দেল তোরোর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন শুধু একটি হরর মুভি নয়, এটি একাকিত্বের এক মহাকাব্য। এটি আমাদের দেখায়, ভালোবাসা না পেলে একটি নিষ্পাপ শিশুও কীভাবে দানবে পরিণত হতে পারে!