রেজাউর রহমানের চলে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়…

রেজাউর রহমান

পরবর্তী প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা এবং বিজ্ঞানশিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে কাজ করেছেন ড. রেজাউর রহমান। তিনি সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা, বৈজ্ঞানিক, গবেষক, বিজ্ঞান ও সাহিত্যসেবী ছিলেন। গত ২৬ অক্টোবর, ৮১ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন।

১৯৪৪ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন রেজাউর রহমান। শিক্ষাগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে ‘চেকো স্লোভাক একাডেমি, প্রাগ’-এ কীটতত্ত্বে পিএইচডি লাভ করেন ১৯৭৯ সালে। কর্মজীবনে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে গবেষক ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় ৩৫ বছর কাজ করেছেন। খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

রেজাউর রহমান স্যার শুধুই গবেষক ছিলেন না, ছিলেন একাধারে বিজ্ঞান লেখক ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান-সাহিত্যিক। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন শিক্ষণ ও পরামর্শদানে; তরুণ গবেষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং তাঁদের মেন্টরশিপ করতেও উৎসাহী ছিলেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া গল্প ও পর্যবেক্ষণকে লেখায় তুলে আনা ছিল তাঁর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।

আমার সঙ্গে তাঁর বয়সের ব্যবধান প্রায় দুই যুগের। তবুও এক ধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর সঙ্গে। প্রায়ই আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন প্রোগ্রামে যেতাম। পথে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য—এমনকি তাঁর বাসার বারান্দার ছোট্ট, কিন্তু সৃজনশীল বাগানের গল্প করে আমাদের সময় কাটত। দেশ নিয়ে প্রচুর আশাবাদী ছিলেন, কিন্তু খুবই হতাশ ছিলেন দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে। তাঁর বিভিন্ন আলোচনায় সরকারের করণীয় গঠনমূলক পরামর্শ উঠে আসত।

আরও পড়ুন

বই লিখেছেন প্রায় ৫০টিরও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান-বিষয়ক গ্রন্থ, পাঠ্যপুস্তক, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও বিজ্ঞান-উপন্যাসধর্মী রচনা। জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য উপকারী। কীটপতঙ্গ, মহাবিশ্ব ও জীবনের সম্পর্ক, বিজ্ঞান ও সমাজ নিয়ে তিনি চিন্তা করেছেন। সমাজে বৈজ্ঞানিক চিন্তার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন বিভিন্ন লেখনীতে। নিজের বিজ্ঞান-সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক লেখালেখিকে উৎসাহিত করতেন। রেজাউর রহমানের সাহিত্যকর্ম, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও সাহিত্যিক দক্ষতার একটি অনন্য সংমিশ্রণ, যা বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিজ্ঞানবিষয়ে পাঠকের আগ্রহ তৈরি করতে তিনি জটিল বিজ্ঞাকে গল্প-উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন। এমনকি মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে তুলে ধরেছেন গবেষক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। সৃজনশীল ও রোমান্টিক গল্প-উপন্যাসের নামকরণেও ছোঁয়া রেখেছেন প্রকৃতি-পরিবেশ ও বিজ্ঞানের।

বিজ্ঞানচিন্তার একটা অনুষ্ঠানে কথা বলছেন রেজাউর রহমান

মানবিক ব্যক্তি ছিলেন তিনি। উচ্চ শিক্ষাগ্রহণে এবং পরে কর্মজীবনে তাঁর দুই মেয়ে নীলাঞ্জনা রহমান ও মঞ্জুলিকা রহমান দেশের বাইরে থাকলেও তাঁর পরিবারে সদস্য সংখ্যার কমতি ছিল না। গ্রামের কোনো এক দুঃস্থ পরিবারে তিন মেয়েকে স্কুল-কলেজ, এমনকি স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করানোসহ অন্যান্য সকল দায়িত্ব নিয়ে তাঁর নিজগৃহে পরিবারের সদস্যদের মতো করে রেখেছেন বছরের পর বছর। সাংসারিক জীবনে স্ত্রী হালিমা রহমানের (দেশের স্বনামধন্য ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাক্তন শিক্ষিকা) সঙ্গে তাঁর পারস্পরিক সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত গভীর। লেখালেখি, আলোচনা ও সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন এবং সেটা ঘনিষ্ঠজনদেরও বলতেন। অনেক মানবিক কাজে সহায়তা করতেন, কিন্তু কাউকে জাহির করে প্রচার করতেন না। অন্যকে উৎসাহিত করতেন অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে। যেসব সংস্থার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, সেখানকার সবস্তরের কর্মচারীদের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠত। তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন। এমনকি অনেকের ফোন নম্বরও সংগ্রহে রাখতেন (আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তাদেরকে প্রয়োজনে সহযোগিতাও হয়তো করেছেন, কিন্তু তিনি কখনো বলেননি)।

আরও পড়ুন

নারীশিক্ষায়, সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে, রক্ষণশীল চিন্তা-চেতনার ঘোর বিরোধী ছিলেন। শিক্ষার্থীবিষয়ক যে কোনো কর্মকান্ডে নারী শিক্ষার্থীরা কতটা অংশগ্রহণ করছে, কোন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করছে, সেসব খুব খেয়াল রাখতেন। পরামর্শ দিতেন তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ও করণীয় সম্পর্কে। কোনো প্রতিযোগিতায় নারী শিক্ষার্থীরা কৃতকার্য হলে তাদের ব্যাপক প্রশংসা ও উৎসাহিত করতেন তিনি।

নিজ পড়ার ঘরে রেজাউর রহমান

তাঁর সুযোগ ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুকূল্য নেওয়ার। বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাবও পেয়েছেন, কিন্তু বাকি জীবনে কোনো কালিমা লাগাতে চাননি তিনি। মনে পড়ে, একদিন একটি বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান শেষে চায়ের টেবিলে তখনকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাঁকে অনুরোধ করলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে। তিনি এও বললেন যে সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিনের বাইরেও অনেকে যুক্ত হয়েছেন, অথচ আণবিক শক্তি কমিশনে (বর্তমানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন) সারাজীবন কাজ করেও তিনি কেন আগ্রহী হচ্ছেন না। মন্ত্রী মহোদয় অনুরোধ করলেন তাঁর বায়োডেটা পাঠাতে। ফেরার পথে আমি তাঁকে যুক্ত হবেন কিনা জিজ্ঞেস করলে সরাসরি নাকচ করে দিলেন। কারণ হিসেবে বললেন, বিতর্কিত বা রাজনৈতিক প্রভাবে তিনি কোনো কিছুতে সম্পৃক্ত হতে চান না।

বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের (বিএফএফ)  ট্রাস্টি এবং একাধারে ৬ বছর ট্রেজারার ছিলেন তিনি। নিঃস্বার্থভাবে সংস্থার জন্য সময় এবং মেধা দিয়েছেন। সুস্থ থাকলে কখনো কোনো মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকেননি। সময় মেনে চলতেন ঠিক ঠিক। ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার উপদেষ্টা পরিষদে। বিজ্ঞানবিষয়ক যে কোনো কার্যক্রমে আমন্ত্রণ পেলেই উপস্থিত থেকেছেন। এমনকি মাঝেমধ্যে শুধু দর্শক-শ্রোতা হিসেবেও উৎসাহ যুগিয়েছেন তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে।

আরও পড়ুন
নিজের গবেষণার কথা বলছেন রেজাউর রহমান

রেজাউর রহমানের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে, নিভৃত। ছিলেন নিরহংকার। ছোট-বড় সবার সঙ্গে আচরণ ছিল অত্যন্ত আময়িক, বন্ধুভাবাপন্ন। অসমবয়সী লেখক, সংগঠক, বিজ্ঞানকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতেন প্রাণ খুলে। রাস্তার পাশে টি-স্টলে বেঞ্চে বসে চায়ের আড্ডা দিতে তাঁর কোনো দ্বিধা বা জড়তা ছিল না। তাঁরই ছোটভাই মতিউর রহমান দেশের বরেণ্য দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক। অথচ নিজ থেকে এ পরিচয় দিতেন না কখনো। পর পর অনেক বছর তিনি আমাকে নিয়ে একুশের বইমেলায় যেতেন। ঠিক দুপুরের পরপর যখন মানুষের আনাগোনা কম থাকত, ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টলে যেতেন, অন্য লেখকদের বই দেখতেন, কিনতেন। তারপর একসময় তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে এমন প্রকাশনায় যেতেন। প্রকাশক উপস্থিত থাকলে দেখা করে কুশল বিনিময় করে চলে আসতেন। লেখক হিসেবে উপস্থাপন করার বা তাঁর বইয়ের প্রচারণা করার কোনো উৎসাহ দেখাতেন না। কখনো কখনো প্রকাশকের কাছ থেকে তাঁর নতুন প্রকাশিত ৩/৪টি বই নিতেন, একটি দিতেন আমাকে (এ আনন্দ ও সম্মান আমার জীবনে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে)। গত বছর বাংলা একাডেমির পুরস্কার পেলে শুভেচ্ছা জানাতে তাঁর বাসায় গেলাম আমার এক সহকর্মী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি কেক। স্যার ও ভাবীকে বললাম, আসেন কেকটা কাটি। স্যার যেন লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। বললেন, আমি মনের খেয়ালে লিখে গিয়েছি। কোনোদিন পুরস্কার পাবো তা আশা করিনি। একাডেমির কারও সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগও নেই। এটা নিয়ে হৈ চৈ করার কিছু নেই। এমনই সাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি।

একাধারে শিক্ষক, গবেষক ও বিজ্ঞান লেখক হিসেবে তাঁর অবদান দেশের বিজ্ঞান সম্প্রসারণের সামাজিক আন্দোলনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছিল। তাই তাঁর চলে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং দেশের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও শিক্ষার অগ্রগতিতে এক গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাঁর আত্মা চির-শান্তিতে থাকুক।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ), ঢাকা

আরও পড়ুন