একদল রকেট বালকের অবিশ্বাস্য কাহিনি

রটেন টমেটোসে 'অক্টোবর স্কাই'

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দল এ বছর অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। সেই দলের সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তিনি অনুষ্ঠানে আসা সব শিক্ষার্থীকে অক্টোবর স্কাই নামে একটি মুভির গল্প বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এক শহরের কিশোরেরা কীভাবে রকেট তৈরিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেই গল্প শোনান তিনি। আনিসুল হকের বক্তব্যের সূত্র ধরেই নেটফ্লিক্সে খুঁজে বের করি অক্টোবর স্কাই

রকেট নিয়ে মুভি

পরিচালক জো জনস্টন পরিচালিত ১৯৯৯ সালের অনুপ্রেরণামূলক এক মুভি এই অক্টোবর স্কাই। এক কিশোর যেভাবে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে, সেই সংগ্রামের ক্লাসিক এক গল্প উঠে এসেছে এই মুভিতে। সত্যিকারের উদ্ভাবক হোমার হ্যাডলে হিক্যামের স্মৃতিকথা রকেট বয়েজ। এই আত্মজীবনীর ওপর ভিত্তি করেই মুভিটি নির্মিত হয়েছে। মুভির গল্পে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপস্থিতি আছে, তেমনি মানবিক শক্তি আর সম্পর্কের চিত্রও এতে দেখা যায়। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কয়লা খনির শহর কোলউডের এক কিশোরের গল্প নিয়ে এই মুভি। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত উপগ্রহ স্পুটনিকের উৎক্ষেপণ গোটা যুক্তরাষ্ট্রে সাড়া ফেলে। সেই সংবাদ খনিশহর পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কোলউডে পৌঁছে যায়। কিন্তু কোলউড শহরের ভাগ্য একটি খনিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।  সেখানে সবাই পড়াশোনা শেষ করে খনিতে যোগ দেয়।

আরও পড়ুন

এ যেন আরেক দীপু নম্বর টু

বাংলা চলচ্চিত্র দীপু নম্বর টু দেখেছি সম্ভবত এক যুগ আগে। সেই মুভিতে দীপু ও তার বন্ধুদের দুষ্টামি আর রহস্য সমাধানের এক দারুণ গল্প দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। অক্টোবর স্কাই কৈশোরের সেই রোমাঞ্চ আবার ফিরিয়ে এনেছিল। ১৯৫০-এর দশকে এক সন্ধ্যায় রকেট উৎক্ষেপনের খবর শুনে চাঞ্চল্য তৈরি হয় কিশোর হোমারের মনে। উপগ্রহ পাঠানোর জন্য রকেট তৈরির বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে হোমার। যদিও এই কিশোরের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।

বাবার শাসনে বেড়ে ওঠা। ছোট ভাই ভালো ফলাফল করে বলে মাঝেমধ্যে কটু কথা শুনতে হয় হোমারকে। বাবার আশা ছিল, ছেলে তার কয়লা খনিতে কাজ করবে। বাবা ও পরিবারের আর্থিক সংগতির কথা বিবেচনা করে হোমার কয়লা খনিতেই যোগ দেয়। তবু মনে পুষে রাখা রকেট তৈরির স্বপ্ন নষ্ট হয়নি তার। স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষিক মিস রাইলির অনুপ্রেরণায় হোমার ও তার বন্ধুরা রকেট তৈরিতে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে।

অনেক বার চেষ্টা করে রকেট তৈরি করে তারা। রকেট তৈরির জন্য দূরের বনের মধ্যে খোলা এক প্রান্তে বসানো হয় তাদের লঞ্চপ্যাড। রকেট তৈরির সময় সব উৎক্ষেপণেই যে সাফল্য এসেছে, বিষয়টি তেমন ছিল না।

রকেট নিয়ে যত পাগলামি

হোমারের সব কিছুই যেন ছিল রকেট তৈরির উন্মাদনা। তখন বিজ্ঞানী ওয়ার্নার ভন ব্রাউন রকেট দুনিয়ার আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে পছন্দ করত হোমার। তাঁর একটি ছবিও ছিল এই কিশোরের কাছে। পুরো মুভিতে হোমারের বন্ধুদের দারুণ উপস্থিতি দেখা যায়। তার এক বন্ধু গণিতে আগ্রহী কোয়েন্টিন উইলসন। আরও দুই বন্ধু রয় লি কুক ও শেরম্যান ওডেল মহাকাশ প্রকৌশলে আগ্রহী। খনির মেশিন শপ ম্যানেজার আইকে বাইকভস্কি তাদের রকেট তৈরি করতে সহায়তা করেন। অনেক বার চেষ্টা করে রকেট তৈরি করে তারা। রকেট তৈরির জন্য দূরের বনের মধ্যে খোলা এক প্রান্তে বসানো হয় তাদের লঞ্চপ্যাড। রকেট তৈরির সময় সব উৎক্ষেপণেই যে সাফল্য এসেছে, বিষয়টি তেমন ছিল না। বরং রকেট উৎক্ষেপনের জন্য হোমার ও তার বন্ধুদের গ্রেপ্তার পর্যন্ত করে পুলিশ। কিন্তু হাল ছাড়ে না হোমার ও তার বন্ধুরা। দিনের পর দিন চেষ্টা করে যায়। শতচেষ্টা কিংবা বুদ্ধি কাজে লাগানোর পরেও কেন জানি রকেট ঠিক মত উড়তে পারছিল না। এক সময় খনির কাজে বিরক্ত হয়ে হোমার তার বাবাকে বলে আবার হাই স্কুলে ফিরে আসে।

আরও পড়ুন

শিক্ষকের এক উপহারে বদলে গেল সব

ঘটনার পরিক্রমায় ক্লাস শিক্ষক মিস রাইলি হোমারকে প্রিন্সিপালস অব গাইডেড মিসাইল ডিজাইন নামে একটি বই পড়তে দেন। সেই বই পড়ে হোমার রকেটের গতিপথ গণনা করতে শেখে। বইয়ের অংক কষে হোমার ও তার বন্ধু কোয়েন্টিন পরীক্ষার সময় তাদের হারিয়ে যাওয়া রকেট খুঁজে বের করে। নিজেদের স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় রকেট প্রদর্শন করে আলোচনায় আসে তারা। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় জিতে ইন্ডিয়ানাপলিসে জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে যায়। যাওয়ার জন্য বাস ভাড়ার অভাবে শুধু হোমার একাই চলে যায় বিজ্ঞান মেলায়।

জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় হোমারের এ রকেট সমাদৃত হয় বটে, তবে পদে পদে আসতে থাকে বাধা। সেই বাধা কাটানো, ওয়ার্নার ভন ব্রাউনের দেখা পাওয়া থেকে শুরু করে নাসার অংশ হয়ে ওঠা—এ এক দারুণ অনুপ্রেরণার গল্প।

হোমারের সব কিছুই যেন ছিল রকেট তৈরির উন্মাদনা। তখন বিজ্ঞানী ওয়ার্নার ভন ব্রাউন রকেট দুনিয়ার আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে পছন্দ করত হোমার। তাঁর একটি ছবিও ছিল এই কিশোরের কাছে।

ছোট শহরের বড় নায়ক

হোমার হ্যাডলি হিকাম জুনিয়র নাসার প্রকৌশলী হিসেবে প্রথম জাপানি মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথা রকেট বয়েজ থেকেই নির্মিত হয়েছে অক্টোবর স্কাই মুভিটি। এই বই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বইবিক্রির তালিকায় সেরা স্থান অর্জন করে।

এককথায়,দারুণ একটা সিনেমা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে আগ্রহী যে কেউ এই টানটান মুভিটি দেখতে পারেন।

জীবন অনেক সময় অনেকভাবে আমাদের পরাজিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু নতুন কিছু করার আগ্রহ আর নিজের ওপর বিশ্বাস রাখলে সাফল্য আসবেই। উদ্ভাবন আর মনের জোর থাকলে হোমারের মত যে কেউ বদলে দিতে পারে রকেটের গতিবেগ। বদলে দিতে পারে পৃথিবীটাকেও।

আর সেই মানুষটা হতে পারেন আপনিও।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন