মাটির নিচে ১৪০ তলা বিশাল অবকাঠামো। এর ভেতরে গড়ে উঠেছে মানুষের ‘আদিম আধুনিক’ সমাজ। এই সমাজে কম্পিউটার আছে, কিন্তু পুলিচালিত যেকোনো যন্ত্র বানানো নিষেধ বলে নেই কোনো লিফট। ভিডিও কী, তা কেউ জানে না। এখানে মানুষ বেঁচে আছে—এক সীমাবদ্ধ কাঠামোচক্রে, এর বাইরে বেরোনোর উপায় তার নেই। কারণ, বাইরের পৃথিবীটা বিষাক্ত। সেখানে শ্বাস নেওয়া যায় না, ধূ ধূ প্রান্তরে নেই কোনো জনমানুষের চিহ্ন।
এই কাঠামোটির নাম ‘সাইলো’। সাধারণত বিচ্ছিন্ন অবকাঠামো বোঝানো হয় শব্দটি দিয়ে। মাটির নিচে পরমাণু বোমার মতো স্পর্শকাতর জিনিস সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয় এ ধরনের অবকাঠামো। কিন্তু আমাদের চেনা বিশ্বে কোনো মানুষ এরকম কোথাও বাস করে না। কিন্তু গল্পের ভেতরে সেই বিষাক্ত পৃথিবীতে এই সাইলোর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।
সিরিজটি বানানো হয়েছে হিউ হাউয়ির লেখা সাইলো ত্রয়ীর ওপর। সিরিজের তিনটি বই উল, শিফট এবং ডাস্ট। বইতে যে জগৎটি গড়ে উঠেছে, তা আগ্রহী কল্পবিজ্ঞান পাঠককে তৃপ্ত করবে, মুগ্ধ করবে।
শুরুতেই আমরা জানতে পারি একটি আপ্তবাক্য—সাইলোটির ‘কার্ডিনাল রুল’, অলঙ্ঘনীয় নিয়ম—কেউ বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারবে না। কেউ যদি সেই ইচ্ছা প্রকাশ করেই ফেলে, তাকে বের করে দেওয়া হবে, কোনোভাবেই আর সাইলোতে ঠাঁই হবে না তার। আর বিশাল জানালায় মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখেছে, যে-ই বের হয়েছে, কয়েক পা এগিয়ে মুখ থুবড়ে, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেছে সে। সর্বোচ্চ তিন মিনিটের বেশি কেউ টিকতে পারেনি ওই বিষাক্ত পৃথিবীতে, সুরক্ষা স্যুট পরা থাকার পরেও।
আমরা দেখি, এই সাইলোর নিরাপত্তা বাহিনির প্রধান, যাঁর পদবী শেরিফ, তিনি বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সাইলোর একমাত্র অলঙ্ঘনীয় নিয়মটি ভেঙে ফেলেছেন। আর কোনো উপায় নেই, তাঁকে বের করে দিতেই হবে। দেওয়া হলো। তিনি খুশি হয়ে উঠলেন, তারপর হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন। মানুষটি মারা গেছেন।
কী আছে সেই সাইলোর বাইরে? কী ঘটেছে আমাদের চিরচেনা পৃথিবীটার? এরকম বহু প্রশ্ন জাগবে দর্শকের মনে। প্রশ্ন জাগবে, কেন পুলিচালিত যন্ত্র বানানো নিষেধ? কেন এই সাইলোতে আগের পৃথিবীর যেকোনো বস্তু, তা হোক শিশুদের ছবিযুক্ত বই বা সামান্য খেলনা, সব নিষিদ্ধ? এরকম হাজারো প্রশ্নের কিছু কিছু উত্তর আমরা পাই, কিন্তু আরও গভীর সব প্রশ্ন জাগতে থাকে মনে। সাইলোটি বানিয়েছিলেন যাঁরা, ফাউন্ডার, তাঁরা কারা? এই সব প্রশ্ন ছাপিয়ে সাইলোর সেই সমাজকে টিকিয়ে রাখতে নতুন শেরিফের দায়িত্ব বর্তায় জুলিয়েট নিকোলস নামে এক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের কাঁধে। ১৪০ তলা সাইলোর একদম নিম্নতম সমাজের মানুষ সে, দায়িত্ব যার সাইলোর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী জেনারেটরটির দেখভাল করা। আমরা জানতে পারি, জুলিয়েট নিকোলসের অতীতেও আছে বহু রহস্য। যে রহস্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সাইলোর ভবিষ্যৎ, অতীতের পৃথিবী এবং মানুষের সভ্যতার টিকে থাকার প্রশ্ন।
সাইলো নামের এই সিরিজটি মুক্তি পেয়েছে অ্যাপল টিভি প্লাস-এ। এখন পর্যন্ত এর দুটি সিজন মুক্তি পেয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে, আরও দুটি সিজন আসবে।
অ্যাপলের ওটিটি সিরিজটি বইয়ের স্বার্থক রূপান্তর। এতে লেখকের কল্পবাস্তবতা যে অসাধারণভাবে উঠে এসেছে, বাস্তব হয়ে ফুটেছে চোখের সামনে, যে দারুণ গতিতে এগিয়েছে কাহিনি
সিরিজটি বানানো হয়েছে হিউ হাউয়ির লেখা সাইলো ত্রয়ীর ওপর। সিরিজের তিনটি বই উল, শিফট এবং ডাস্ট। বইতে যে জগৎটি গড়ে উঠেছে, তা আগ্রহী কল্পবিজ্ঞান পাঠককে তৃপ্ত করবে, মুগ্ধ করবে। এই বইয়ে পৃথিবীর যে ভবিষ্যতের কথা বলা হয়েছে, যে শঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে, তা আজ আমাদের সামনে। এই বাস্তবতা, এই সম্ভাব্য আশঙ্কাজনক ভবিষ্যৎকে, পাঠক পড়তে পড়তে টের পাবেন, শুধু গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া বা অস্বীকার করার উপায় নেই। কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে থ্রিলার—শেরিফ, তাঁর স্ত্রী এবং আরও অনেক মানুষের মৃত্যুর পেছনের রহস্য উদ্ঘাটনের কাহিনি নিয়ে সাইলো যেভাবে এগিয়েছে, পড়তে শুরু করলে হাত থেকে নামিয়ে রাখা যাবে না।
অ্যাপলের ওটিটি সিরিজটি বইয়ের স্বার্থক রূপান্তর। এতে লেখকের কল্পবাস্তবতা যে অসাধারণভাবে উঠে এসেছে, বাস্তব হয়ে ফুটেছে চোখের সামনে, যে দারুণ গতিতে এগিয়েছে কাহিনি—সেই সঙ্গে আজকের পৃথিবীর মতোই সাইলোর সমাজে চিকিৎসা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ক্ষমতার খেলা নিয়ে দ্বন্ধ—তাতে একবার দেখলে থামা যায় না সহজে।
কল্পবিজ্ঞান এবং থ্রিলারে আগ্রহীরা সিরিজটি দেখতে পারেন। চাইলে, হাতে সময় থাকলে এবং বইয়ে আগ্রহী হলে হাতে তুলে নিতে পারেন বইগুলোও। কথা দিচ্ছি, সময়টা মন্দ কাটবে না।
