শতভাগ খাঁটি বলে কি কিছু আছে
রাজিন সাহেব মধ্যবিত্ত মানুষ। খুব বেশি দরিদ্র নন। তাঁকে ধনী বলাও চলে। গৃহস্থ-চাষী মানুষ। এবার ২০ বিঘা জমিতে সিম চাষ করেছিলেন অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে। বাম্পার ফলন হয়েছে তাঁর। দামও পেয়েছেন বেশ ভালো। সব মিলিয়ে লাখ পঁচিশেক টাকা লাভ হয়েছে।
খরচ আর সংসার চালানোর জন্য পাঁচ লাখ রেখে বাকিটা জমা রাখতে চান। কিন্তু টাকা জমা করলে খুব বেশি লাভ নেই। ফিক্সড ডিপোজিটে যে পরিমাণ লাভ আসে, তার চেয়েও বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হয়। ১০ বছর পর হয়তো ৮ লাখ টাকা ১১ লাখে দাঁড়াবে। কিন্তু এখন যে জিনিসের দাম ৮ টাকা, সেটা হয়তো দশ বছর পর ১৪–১৫ টাকা হয়ে যাবে। সুতরাং, টাকা রাখা লস। তাই তিনি সেই পুরোনো পদ্ধতিই কাজে লাগাতে চান। টাকার বদলে সোনা কিনে ব্যাংকের লকারে রাখতে চান।
সোনার মূল্যস্ফীতি অন্য যেকোনো পণ্যের চেয়ে বেশি। আজ আট লাখ টাকার সোনা কিনে রাখলে ১০ বছর পর তার দাম ১৬–২০ লাখও হয়ে যেতে পারে। এ জন্য কিনতে হবে কাঁচা খাঁটি সোনা, যাতে বিন্দুমাত্র ভেজাল না থাকে। কিন্তু খাঁটি সোনা পাওয়া সহজ না। পাক্কা জহুরি ছাড়া সোনা দেখে চিনবে না কেউ।
নব কর্মকার রাজিন সাহেবের বন্ধু। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন যশোরে। শহরের কাপুড়িয়া পট্টিতে জুয়েলার্সের দোকান গোটা দশেক। এর মধ্যে কয়েকটি দোকানে কাঁচা সোনা বিক্রি হয়। এক দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খাঁটি সোনা আছে কিনা।
ফিক্সড ডিপোজিটে যে পরিমাণ লাভ আসে, তার চেয়েও বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হয়। ১০ বছর পর হয়তো ৮ লাখ টাকা ১১ লাখে দাঁড়াবে।
দোকানি জানায় আছে। রাজিন সাহেব খুশি হলেন। একেবারে প্রথম দোকানেই পেয়ে যাবেন, এতটা আশা করেননি। ২৪ ক্যারেট সোনা বিশুদ্ধ হয়, তা জানেন রাজিন সাহেব। ২৪ ক্যারেট সোনার বেশ কয়েকটা বার বের করলেন দোকানি। নব কর্মকার নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, একেবারে আসল জিনিস।
কিন্তু রাজিন সাহেব বড্ড খুঁতখুঁতে মানুষ। সোনার বারটা ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলেন। খোদাই করে ওজন লেখা রয়েছে। খোদাই করা আছে প্রস্তুতকারক কোম্পানির নামও। কিন্তু আরও খুঁজছিলেন রাজিন সাহেব। পেলেন না। তখন যে বাক্সের ভেতর বারটা রাখা ছিল, সেটা ভালো করে দেখলেন। তাতে লেখা ৯৯ শতাংশ খাঁটি সোনা।
রাজিন সাহেব বললেন, ‘এটা তো খাঁটি সোনা নয়।’
দোকানি বললেন, ‘কী বলেন ভাই, এটা তো চব্বিশ ক্যারেট সোনা! ৯৯ শতাংশ খাঁটি।’
‘ভাই, থামুন। একটু ভাবুন, ৯৯ শতাংশ খাঁটি বলে কিছু হয় না। বিশুদ্ধ বা খাঁটি মানেই সেটা ১০০ ভাগ হতে হবে। ৯৯ ভাগ খাঁটি মানে এতে ১ ভাগ ভেজাল আছে। ভেজাল মানে ভেজাল। সে ১ ভাগ হোক আর ৮০ ভাগ হোক। যেকোনো বিশুদ্ধ জিনিসে খুব সামান্য পরিমাণ অন্য জিনিস মেশালেই সেটা আর খাঁটি থাকে না। আমার বিশুদ্ধ সোনা চাই, ভেজাল চাই না।’
দোকানি বললেন, ‘কী বলেন ভাই, এটা তো চব্বিশ ক্যারেট সোনা! ৯৯ শতাংশ খাঁটি।’
দোকানি অবাক হলেন, এমন কথা তো কেউ বলেনি। লোকটার কথায় যুক্তি আছে। খাঁটি জিনিসের আবার পার্সেন্টেজ কী? ১০০ ভাগ খাঁটি কথারও আলাদা করে কোনো অর্থ বোঝায় না। একটুখানি ভেজাল মানেই তো ভেজাল।
কিন্তু দোকানি পড়লেন মহা ফাঁপরে। কোনো বারের গায়ে ১০০ শতাংশ খাঁটি সোনা লেখা নেই। কোনোটা ৯৯ শতাংশ, আবার কোনোটা ৯৯.৫ শতাংশ।
রাজিন সাহেব সেই দোকান ছেড়ে আরও একটা দোকানে গেলেন। কিন্তু কোথাও শতভাগ খাঁটি সোনা লেখা বার পাওয়া গেল না।
নব কর্মকার তখন মুখ খুললেন, ‘শতভাগ গোল্ড পাবি না কোথাও। তোর বোধহয় আর সোনা কেনা হলো না!’
রাজিন সাহেবের চোখেমুখে হতাশা। তিনি বললেন, ‘এটা অন্যায়। কথার মারপ্যাঁচে কোম্পানিগুলো মানুষ ঠকায়।’
নব কর্মকার বললেন, ‘তুই আসলে যুক্তির ধার ধারিস না। নিজের যুক্তিকেই শতভাগ ঠিক মনে করিস।’
‘ভুল বললি,’ রাজিন সাহেব জবাবে বললেন, ‘তুই যদি যুক্তির গভীরতা বোঝার চেষ্টা না করিস, আমার যুক্তিকে কুযুক্তিই মনে হবে। ব্যাপারটা কিন্তু দোকানি বুঝেছে। তাই তর্ক করেনি।’
রাজিন সাহেবের চোখেমুখে হতাশা। তিনি বললেন, ‘এটা অন্যায়। কথার মারপ্যাঁচে কোম্পানিগুলো মানুষ ঠকায়।’
‘কিন্তু, একটু উল্টো দিক থেকেও ভেবে দেখ,’ নব কর্মকার বললেন, ‘ধর, ৯৯ ভাগ যে সোনা, তা তো খাঁটি। মাত্র ১ ভাগের জন্য এটা ভেজাল বলা কি ঠিক হচ্ছে?’
‘৯৯ শতাংশ খাঁটি তখনই, যখন তুই ১ ভাগ ভেজালটা সরিয়ে ফেলবি। তার আগ পর্যন্ত কিছুতেই খাঁটি সোনা বলা যাবে না। ৯৯.৯৯ শতাংশ হলেও না। খাঁটি মানেই শতভাগ সোনা।’
‘একটু আগে তুই বললি, শতভাগ খাঁটি কথাটাই ঠিক নয়!’
‘এখনো বলছি, শতভাগ খাঁটি কথাটাই ভুল। এটাকে আমরা ঠিক মনে করি বলে, ৯৯ শতাংশ খাঁটি কথাটাও ঠিক মনে হয়। আর খেয়াল করে দেখ, আমি শতভাগ খাঁটি বলিনি, বলেছি শতভাগ সোনা।’
‘তার মানে খাঁটির আগে ১০০ ভাগ লাগালেই কথাটা ভুল হয়ে যায়?’
‘ভুল বটে, তবে ভুলের চেয়ে প্যারাডক্স বলাই ভালো। কারণ ১০০ শতাংশ খাঁটি লিখলে ৯৯ শতাংশ খাঁটিকেই বৈধতা দেওয়া হয়। সেটা আবার খাঁটিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।’