সরকারি অফিসার থেকে নোবেলজয়ী
সি ভি রমন কলকাতায় থাকেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক তিনি। গবেষণা করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে। মাসখানেক আগে তাঁর গবেষণাগারে আলোর বিশেষ এক বিচ্ছুরণ ধর্মের সন্ধান মিলেছে। রমনের ধারণা, পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তাঁর আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২৮ সালের ১৬ মার্চ বেঙ্গালুরু সাউথ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভায় এ নতুন আবিষ্কার নিয়ে বক্তব্য দেন তিনি। স্ত্রী লোকসুন্দরী আম্মালকে নিয়ে কলকাতা থেকে জাহাজে চেপে মাদ্রাজের উদ্দেশে রওনা হলেন রমন। এ মাদ্রাজ শহরেই ছাত্রজীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে তাঁর। রমনের বড় ভাই সি এস আইয়ার এ সময়ে মাইলাপুরের বাড়িতেই আছেন। তিনিও ছোট ভাইয়ের আবিষ্কার নিয়ে খুব উৎসাহিত।
বঙ্গোপসাগরের বুকে দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশি কেটে এগিয়ে চলেছে তাঁদের জলযান। জাহাজে প্রথম শ্রেণির যাত্রী সস্ত্রীক সি ভি রমন। সূর্য একটু একটু করে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে জাহাজের সঙ্গে সমান্তরালে লাফিয়ে চলেছে বেশ কয়েকটি ডলফিন। যাত্রীরা অনেকেই ডেকে বসে উপভোগ করছেন সে দৃশ্য। জলের দিগন্ত যেখানে আকাশে গিয়ে মিশেছে, সেদিকে তাকিয়ে আছেন রমন। সারা দিনের ক্লান্তি গায়ে মেখে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ত যাবে সূর্য। হালকা মেঘযুক্ত পশ্চিমাকাশ ইতিমধ্যেই বিচিত্র বর্ণ ধারণ করেছে। যে তত্ত্বের সাহায্যে আকাশের এ বর্ণময়তা ব্যাখ্যা করা যায়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে ‘র্যালে স্ক্যাটারিং’। সেখানে কি আরও কোনো প্রকারের বিচ্ছুরণ আছে, যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি? নিজেকেই প্রশ্ন করছিলেন রমন। প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের রহস্য উন্মোচনের তাড়নাই একজন গবেষকের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোর বিচ্ছুরণ ধর্ম নিয়ে উৎসাহী তিনি। এত দিনে সত্যিই এক নতুন বিচ্ছুরণের সন্ধান মিলেছে। কম্পটন স্ক্যাটারিং, মিয়ে স্ক্যাটারিংসহ বিভিন্ন প্রকারের আলোক বিচ্ছুরণের কথা জানা থাকলেও রমনের গবেষণাগারে যে বিচ্ছুরণের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটাকে পদার্থবিজ্ঞানের এ পর্যন্ত জানা তত্ত্বের সাহায্যে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।
ডেকে বসে আছেন সি ভি রমন। গবেষণায় নতুন আবিষ্কারের সাফল্য আজ তাঁর হাতের মুঠোয়। নিজের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলেন রমন। কলকাতার সঙ্গে তাঁদের পরিবারের সম্পর্ক অনেক দিনের। সেই ১৯০৭ সালের কথা। সি এস আইয়ার ও সি ভি রমন ওই একই বছর সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ফিন্যান্স সার্ভিসের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন রমন, যোগ দিয়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে। অন্যদিকে সি এস আইয়ার ব্রিটিশ রেলওয়ে কোম্পানির ডেপুটি অ্যাকাউন্ট জেনারেল। দুজনেরই প্রথম কর্মক্ষেত্র কলকাতা। বড় ভাই ইতিমধ্যে বিবাহিত। বউবাজার স্ট্রিটে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (আইএসিএস) বিল্ডিংয়ের খুব কাছেই স্কট লেনে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন তাঁরা। এখানে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই আইএসিএসের প্রবেশপথে মার্বেল পাথরের নামফলকটি চোখে পড়েছিল রমনের।
‘আসলে বাইরে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের নেমপ্লেট দেখেই আমি এসেছি। ঠিক কী ধরনের বিজ্ঞানচর্চা হয় এখানে?’
দেশের প্রথম বিজ্ঞান গবেষণাগার আইএসিএস। ১৯০৪ সালে বাবা মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যুর পর আইএসিএসের হাল ধরেছিলেন তাঁর ছেলে অমৃতলাল সরকার। তিনিই প্রতিষ্ঠানের অনারারি সেক্রেটারি। মহেন্দ্রলালের স্বপ্ন ছিল, বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁর প্রতিষ্ঠান একদিন পাশ্চাত্যের সমকক্ষ হয়ে উঠবে। কিন্তু জীবদ্দশায় সেসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি তিনি। বাবার স্বপ্ন আগলে রেখে নিয়ম করে ২১০, বউবাজার স্ট্রিটের বাড়িটিতে হাজির হন অমৃতলাল। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কৌতূহলী হয়ে বউবাজার স্ট্রিটে কালটিভেশন অব সায়েন্সের দরজায় কড়া নাড়লেন রমন।
সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ ওয়ার্কশপ অ্যাসিস্ট্যান্ট আশুতোষ দে দক্ষিণ ভারতীয় এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন তাঁর অফিস ঘরে। হাতের কাগজটি রেখে চোখ তুলে তাকালেন অমৃতলাল। আগন্তুকের দিকে একটু দেখে নিয়ে আশুতোষকে বললেন, ‘কী ব্যাপার? ইনি কে?’
‘আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের কাজকর্ম নিয়ে জানতে চাইছিলেন। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলুম।’
ইলেকট্রিক বাল্বের হলদে আলোয় যুবকের মাথার সাদা পাগড়ি ও উৎসুক চোখ দুটি দেখে নিলেন অমৃতলাল। সামনের চেয়ারটির দিকে ইশারা করে আগন্তুককে বসতে বললেন। তারপর ইংরেজিতে বললেন, ‘বলুন, কী জানতে চান?’
‘আসলে বাইরে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের নেমপ্লেট দেখেই আমি এসেছি। ঠিক কী ধরনের বিজ্ঞানচর্চা হয় এখানে?’
‘তা অনেক কিছুই হয়। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলুম না।’
‘আমি মাস দুই হলো কলকাতায় এসেছি। ইন্ডিয়ান ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্টস জেনারেল পদে চাকরি করি। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিকস নিয়ে এমএ পাস করেছি। কলেজে পড়ার সময় কিছু এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেছিলেম। গত বছর নভেম্বর মাসে ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন-এ আমার একটি পেপারও ছাপা হয়েছে।’
‘লন্ডনের ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন-এ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা বেশ। কী নিয়ে কাজ করতেন?’
‘আনসিমেট্রিক্যাল ডিফ্র্যাকশন অব লাইট নিয়ে।’
‘বাহ্ বেশ তো! এবার বলুন, কী করে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘আমি এখানে গবেষণার কাজ করতে চাই স্যার।’
‘১০টা-৫টা চাকরি সামলে গবেষণা করবেন কী করে? তা ছাড়া গবেষণা বলতে বড় মুখ করে বলার মতো খুব কিছু এখনো করতে পারিনি আমরা। যদিও কিছু যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় ফান্ডের অভাব। তবে ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বোটানি ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত লেকচারের আয়োজন করা হয় এখানে।’
‘আপনি রিসার্চের জন্য অনুমতি দিলে সকাল বা সন্ধ্যায় আমি ঠিক সময় বের করে নেব।’
সেদিন সি ভি রমনের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন অমৃতলাল। গবেষণার ব্যাপারে যুবকটির আবেগ ও সদিচ্ছা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও বলেছিলেন, ‘আগে আপনার আবেদনপত্র অ্যাসোসিয়েশনে জমা দিন। আমাদের বোর্ড গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে দেখবে।’
অধ্যাপকের প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ খুব মনঃপূত না হলেও বিনয়ের সঙ্গেই মেনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণান। প্রথমেই ভেঙ্কটেশরণের পরীক্ষা–নিরীক্ষা আবারও যাচাই করার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর কাঁধে।
অবশ্য নিজের শর্তে গবেষণার অনুমতি মিলেছিল অচিরেই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই রমন চলে যেতেন গবেষণাগারে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরেই অফিস। তারপর আবার অ্যাসোসিয়েশনের ল্যাবরেটরি। গবেষণার সুবিধার্থে দিন কয়েকের মধ্যেই বাসা পরিবর্তন করে তিনি চলে এলেন ১১৫/১সি প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে। এবার সময়ে-অসময়ে বসতবাড়ির পেছনের দরজা দিয়েই কাজের প্রয়োজনে অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণাগারে যাতায়াত করতে পারতেন।
স্যার আশুতোষ মুখার্জির আমন্ত্রণে একসময় ভারত সরকারের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন সি ভি রমন। স্বামীর বেতন অর্ধেক হয়ে গেলেও স্ত্রী কোনো আপত্তি করেননি; বরং বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষটি এত দিনে নিজের পেশা ও ভালোবাসাকে এক করে নিতে পেরেছেন, এই ভেবে তাঁর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন লোকসুন্দরী। এর পর থেকে ধীরে ধীরে রমনকে ঘিরেই সাফল্যের সিঁড়িতে উঠতে শুরু করেছে আইএসিএসের গবেষণা। নামকরা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক গবেষণা প্রবন্ধ। অমৃতলাল সরকার, আশুতোষ মুখার্জি, আশুতোষ দে প্রমুখ কলকাতার বিশিষ্টজনেরা তাঁর আজীবনের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। একসময় রমনের আহ্বানে এস ভেঙ্কটেশরণ সি মাধবন, এস ভগবন্তম, কে এস কৃষ্ণান, এ এস গণেশন; এ রকম বেশ কয়েকজন দক্ষিণ ভারতীয় তরুণ গবেষকও এসে যোগ দেন অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণাগারে।
গত এক মাস অমানুষিক পরিশ্রম ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কেটেছে। অবশেষে কৃষ্ণানের চেষ্টাতেই এসেছে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। সঠিক সময়ে কৃষ্ণানকে দায়িত্ব না দিলে এ সাফল্য আসতে হয়তো আরও সময় গড়িয়ে যেত। অথচ দুই-তিন বছর ধরে কৃষ্ণানকে তাত্ত্বিক গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। দিন-তারিখের হিসাব মোটামুটি নির্ভুলভাবেই স্মরণে থাকে রমনের। জানুয়ারি মাসেই তাঁর ছাত্র ভেঙ্কটেশরণ লক্ষ করেছিলেন গ্লিসারিনের ক্ষেত্রে দুর্বল ও পোলারাইজড ফ্লুরোসেন্স দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের দুর্বল ফ্লুরোসেন্সের সন্ধান ঠিক পাঁচ বছর আগে পেয়েছিলেন তাঁর আরেক ছাত্র কে আর রমানাথন। কিন্তু রমনের কেবলই মনে হচ্ছিল, এ শুধু নিছক ফ্লুরোসেন্স নয়, অন্য কিছু। র্যালে–আইনস্টাইন-স্মলুচোস্কি বর্ণিত আণবিক বিচ্ছুরণের বাইরেও অন্য ধরনের বিচ্ছুরণ রয়েছে, যার তীব্রতা সনাতন বিকিরণের ১ শতাংশের মতো এবং যে বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আপতিত আলোকরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে আলাদা। অথচ একই ধরনের পোলারাইজেশন অ্যান্থ্রাসিন বাষ্পের ফ্লুরোসেন্সে দেখতে পাননি ভেঙ্কটেশরণ। এ পর্যবেক্ষণে হতাশ হয়েছিলেন রমন। বুঝেছিলেন যথেষ্ট পরিমাণে তাত্ত্বিক জ্ঞান আছে এমন একজনকে এ গবেষণায় দরকার। তারপর হঠাৎই কৃষ্ণানকে এক্সপেরিমেন্টে নিয়ে আসার কথা মাথায় এসেছিল তাঁর। ১৯২৮ সাল, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন বিকেলের দিকে কৃষ্ণানের ঘরে আসেন রমন। টেবিলে রাখা কাগজপত্রের স্তুপের পাশে নিবিষ্ট চিত্তে লেখালেখি করছিলেন কৃষ্ণান। অধ্যাপককে দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘গুড ইভিনিং প্রফেসর।’
‘ভেরি গুড ইভিনিং কৃষ্ণান। কাজকর্ম কেমন চলছে?’
‘চলছে স্যার।’
‘তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম।’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অধ্যাপকের দিকে তাকান কৃষ্ণান। চেয়ারটা টেনে টেবিলের উল্টো দিকে বসেন অধ্যাপক। তারপর ছাত্রের লেখালেখি ও গাণিতিক হিসাব–নিকাশের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলেন, ‘শেষ দুই-তিন বছর তুমি যে থিয়োরিটিক্যাল কাজ করছ, সেখান থেকে সরিয়ে তোমাকে এক্সপেরিমেন্টেশনে নিয়ে আসতে চাই।’
‘কেন প্রফেসর? আমার কাজ তো ভালোই চলছে।’
‘তা জানি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছে, এমন কারও যদি সত্যিকার এক্সপেরিমেন্টেশনের ধারণা ও অভিজ্ঞতা কখনো না থাকে, তবে ব্যাপারটি একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয়। দেশের প্রথম শ্রেণির গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছ তুমি। তাই আমার মতে এবার তোমার হাতে–কলমে কিছু গবেষণার কাজ করা উচিত।’
অধ্যাপকের প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ খুব মনঃপূত না হলেও বিনয়ের সঙ্গেই মেনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণান। প্রথমেই ভেঙ্কটেশরণের পরীক্ষা–নিরীক্ষা আবারও যাচাই করার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর কাঁধে। তরল পদার্থের নমুনায় যে দুর্বল পোলারাইজেশন লক্ষ করা গিয়েছিল, আলোক পদার্থবিদ্যার সম্যক জ্ঞান অনুযায়ী এ পর্যবেক্ষণের কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা নেই। নতুন কিছু পর্যবেক্ষণের আশায় এবার ছাত্রের সঙ্গে রমন নিজেও সরাসরি গবেষণায় হাত লাগালেন। বিভিন্ন জৈব তরলে দৃশ্যমান আলোকরশ্মি চালনা করে দুর্বল পোলারাইজড ফ্লুরোসেন্সের সন্ধান পেলেন ওঁরা। কৃষ্ণান আরও লক্ষ করলেন, জৈব অণুদের সমসারকাতা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পোলারাইজড ফ্লুরোসেন্স ধর্ম দুর্বল হতে থাকে। যন্ত্রে চোখ লাগিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোক বিচ্ছুরণ পর্যবেক্ষণ করেন কৃষ্ণান। একসময় মাথা ধরে যায়, চোখ লাল হয়ে ব্যথা করতে থাকে। কিন্তু অধ্যাপকের উৎসাহের অন্ত নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর কাজ সেরেই তিনি ছুটে আসেন গবেষণাগারে। এমনকি সারা দিনের কাজ শেষে কৃষ্ণান রাতের খাবার খেতে বেরিয়ে গেলেও গবেষণাগারেই কাজ করে চলেন রমন। কী ব্যাখ্যা হতে পারে নতুন এ পর্যবেক্ষণের। শুধু ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া সব সময় গবেষণার ভাবনা চলতে থাকে তাঁর।
কেবল বিকেলে অ্যাসোসিয়েশনে গেলাম। প্রফেসর সেখানেই ছিলেন। আমরা ইনসিডেন্ট আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখলাম।
সেদিন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮। গবেষণার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে রাত নয়টার দিকে খাবার খেতে বসেছেন কৃষ্ণান ও ভেঙ্কটেশরণ। এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কয়েক মুহূর্ত পরেই কৃষ্ণা আইয়েঙ্গার… কৃষ্ণা আইয়েঙ্গার… কৃষ্ণা আইয়েঙ্গার বলে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। চমকে ওঠেন কৃষ্ণান। প্রফেসরের গলা না! এত রাতে প্রফেসর রমন ডাকছেন! খারাপ কিছু হলো না তো! দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন কৃষ্ণান। স্ট্রিট লাইটের আলোয় দেখলেন, এই শীতের রাতে উৎকণ্ঠিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকেই চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। কৃষ্ণান জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে প্রফেসর?’
‘আজ সকালে আমরা যা কিছু দেখালাম সেটা অবশ্যই ক্র্যামার-হাইজেনবার্গ এফেক্ট।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যে কয়েক দিন ধরে তুমিও যা দেখেছ, সেটাও ক্র্যামার-হাইজেনবার্গ এফেক্ট।’
‘সরি প্রফেসর, এই দুর্বল ফ্লুরোসেন্স যে আদতে ক্র্যামার-হাইজেনবার্গ এফেক্ট এটা আমার একবারও মাথায় আসেনি, অথচ এই এফেক্ট নিয়ে আমরা কত কথা বলেছি!’
‘শোনো, গবেষণা করতে হলে ২৪ ঘণ্টা মাথায় বিজ্ঞানের ভাবনা চলা উচিত। যাহোক, এখন থেকে পেপার লেখার সময় এ বিচ্ছুরণকে আমরা বরং ‘মডিফায়েড স্ক্যাটারিং’ বলে অভিহিত করব।’
‘ঠিক আছে প্রফেসর। তার মানে এ পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের নতুন কোনো তত্ত্বের কথা ভবতে হবে, ক্লাসিক্যাল ফ্লুরোসেন্স দিয়ে হবে না।’
‘একদম তাই। আমরা একটা সাংঘাতিক কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছি, বুঝলে?’
চুপ করে থাকেন কৃষ্ণান। এতক্ষণে ভেঙ্কটেশরণও তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। অধ্যাপককে এখনো অস্থির বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলতে থাকেন, ‘দেখলে না, অর্গানিক মলিকুলার অ্যানাইসোট্রপি (জৈব আণবিক অসমসারকাতা) বৃদ্ধির সঙ্গে এ মডিফায়েড স্ক্যাটারিং কেমন দুর্বল (ক্ষীণ) হতে থাকে! অর্থাৎ আণবিক গঠনের সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। তুমি আগামীকাল আরও কিছু ভ্যাপার (বাষ্প) নিয়ে এই মডিফায়েড স্ক্যাটারিং স্টাডি করবে। …’
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর চলে যান অধ্যাপক। গবেষণাগারে সাফল্যের উত্তেজনার আঁচ এসে পড়ে কৃষ্ণানদের মেসবাড়িতেও।
এ পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯২৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত জার্নাল নেচার-এ তড়িঘড়ি করে একটি নোট পাঠিয়ে দেন অধ্যাপক মহাশয়। এদিকে বিভিন্ন জৈব পদার্থের বাষ্প নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছেই। নিয়ম করে চলছে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ। প্রফেসরের উত্তেজনা দেখে কাজে বাড়তি উৎসাহ পান কৃষ্ণান।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮। পারিবারিক কিছু ধর্মীয় আচার-আচরণের জন্য গবেষণাগারে যাননি কৃষ্ণান। নিষ্ঠাবান তামিল ব্রাহ্মণ তিনি। যাবতীয় পূজাপাঠ ও আচার মন দিয়ে পালন করেন। বিশেষ করে ফুল–মালা সহযোগে উচ্চ স্বরে মন্ত্রপাঠ তাঁর মনে যেন বাড়তি প্রশান্তি আনে। সংস্কৃত স্তোত্রের প্রতিটি শব্দের অর্থ ও দার্শনিক তাৎপর্য যথাযথ অনুধাবন করতে পারেন তিনি। কিন্তু আজ সবকিছু অন্যরকম। কিছুতেই এসব করতে ইচ্ছে করছে না। তাঁর মন পড়ে আছে অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণাগারে। কেবলই মনে হচ্ছে, গবেষণাগারে ইতিমধ্যেই আবার নতুন কোনো পর্যবেক্ষণের সন্ধান পেলেন কি প্রফেসর? প্রফেসরের নির্দেশমতো ২৪ ঘণ্টার গবেষক হওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। ফলে আজকাল কৃষ্ণানের মন সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে গবেষণার কাজকর্ম ও ফলাফল।
পরদিন দুপুরের পর গবেষণাগারে পৌঁছে তিনি দেখলেন, রমন আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ডাইরেক্ট ভিশন স্পেকট্রোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে মডিফায়েড স্ক্যাটারিংয়ের পথ নিরীক্ষণ করছিলেন অধ্যাপক। এবার কৃষ্ণান নিজেও সহযোগিতা শুরু করলেন। হঠাৎ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন রমন। নতুন কিছুর সন্ধান পেলেই অধ্যাপক ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে ওঠেন। শশব্যস্ত হয়ে কৃষ্ণান জানতে চাইলেন, ‘ইজ দেয়ার এনিথিং নিউ প্রফেসর?’
‘ইয়েস, অফকোর্স! দেয়ার ইজ আ নিউ প্যাচ অব কালার ইন দ্য স্পেকট্রোস্কোপ, অ্যান্ড দ্যাট দেয়ার ওয়াজ আ ডেফিনিট গ্যাপ বিটুইন দ্য স্পেকট্রাম ডিউ টু ইনসিডেন্ট লাইট।’ (হ্যাঁ, অবশ্যই! বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্রে নতুন একধরনের রঙের বর্ণালি দেখা যাচ্ছে। আর ইনসিডেন্ট আলো—প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উৎস থেকে কোনো বস্তুর ওপর পড়া আলোর—জন্য বর্ণালির মধ্যে একটা ফাঁকাও দেখা যাচ্ছে।)
‘আমি একবার দেখব প্রফেসর?’
‘অবশ্যই।’
যন্ত্রে চোখ লাগিয়ে কৃষ্ণান বলতে থাকেন, ‘এটাই তাহলে মডিফায়েড স্ক্যাটারিং?’
‘হ্যাঁ। এক্ষুনি এর ছবি তোলার ব্যবস্থা করো।’
হিলগার বেবি স্পেট্রোগ্রাফ ব্যবহার করে ফটোগ্রাফিক প্লেটে নতুন বিচ্ছুরণের ছবি তোলা হলো। আজকের এ ঐতিহাসিক ঘটনাও প্রতিদিনের মতো নিজের ডায়েরির পাতায় ইংরেজিতে লিখে রাখলেন কৃষ্ণান, যার বাংলা এমন—
২৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার
কেবল বিকেলে অ্যাসোসিয়েশনে গেলাম। প্রফেসর সেখানেই ছিলেন। আমরা ইনসিডেন্ট আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখলাম। সাধারণত যে নীলচে-বেগুনি ফিল্টার ব্যবহার হয়, ইউরেনিয়াম কাচের সঙ্গে মিলিয়ে সেটাই ব্যবহার করলাম আবার। কিন্তু দেখা গেল, দুটির মিলিত ব্যবহারে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরিত হয়েছে, তার পরিসীমা শুধু নীলচে-বেগুনি ফিল্টারের মধ্য দিয়ে বিকিরিত আলোর চেয়ে অনেক ছোট। এ বর্ণালি একটি ডিরেক্ট ভিশন স্পেকট্রোস্কপে পর্যবেক্ষণ করে দারুণ অবাক হলাম আমরা। দেখতে পেলাম, বর্ণালিতে ইনসিডেন্ট আলোর জন্য তৈরি হওয়া স্ক্যাটারিং আর মডিফায়েড স্ক্যাটারিংয়ের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা। দুটি বিচ্ছুরণ আসলে আলাদা! (অর্থাৎ আমরা মডিফায়েড স্ক্যাটারিং শনাক্ত করতে পেরেছি।)
সাফল্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসে ১৯৩০ সালে। ওই বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘোষণা হয়েছিল নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে, ভারতে তখন ১৪ নভেম্বর ভোরবেলা।
৩১ মার্চ ১৯২৮ সালে বিখ্যাত নেচার জার্নালে ‘আ নিউ টাইপ অব সেকেন্ডারি রেডিয়েশন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় রমন এবং কৃষ্ণানের লেখা এ আবিষ্কার–সংক্রান্ত একটি নোট। পত্রিকার ঠিক পরের সংখ্যাতেই ব্রিটিশ পদার্থবিদ ফ্রেডারিক লিন্ডম্যান রমনের গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এর পর থেকে সত্যিই বদলে গিয়েছিল রমনের চারপাশের পৃথিবীটা। ইতালি, সুইটজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড বিভিন্ন দেশ থেকে সম্মান আসতে থাকে। পরের বছরই জুন মাসে নাইটহুড উপাধি দেওয়া হয় তাঁকে। এবার তিনি হলেন স্যার সি ভি রমন এবং লোকসুন্দরী লেডি রমন।
সাফল্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসে ১৯৩০ সালে। ওই বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘোষণা হয়েছিল নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে, ভারতে তখন ১৪ নভেম্বর ভোরবেলা। এদিকে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান ১০ ডিসেম্বর। এই অল্প সময়ের মধ্যে টিকিট কেটে জাহাজে করে সুইডেন পৌঁছানো অসম্ভব। শোনা যায়, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির ব্যাপারে রমন এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি পুরস্কার ঘোষণার দুই মাস আগেই জাহাজের টিকিট বুকড করে ফেলেছিলেন। তবে রমনের জীবন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানী সিভারাজ রমাসেশন (সম্পর্কে তিনি রমনের ভাইপো) আবার বলেন, নোবেল পুরষ্কারের কথা মাথায় রেখে ১৯৩০ সালের জুলাই মাসেই নাকি তিনি সস্ত্রীক ইউরোপ যাত্রার জন্য টিকিট কেটে ফেলেছিলেন।
১৪ নভেম্বর পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা ছেড়ে সপরিবার মাদ্রাজের উদ্দেশে রওনা হলেন স্যার সি ভি রমন। ছোট দুই সন্তানকে মাদ্রাজে আত্মীয়দের কাছে রেখে বোম্বাই এসে উপস্থিত হলেন রমন ও লোকসুন্দরী। তাঁরা চেপে বসলেন এস এস ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজে। গন্তব্য বার্লিন। সেখানে দুই দিনের জন্য অধ্যাপক পিটার প্রিংশেমের আতিথ্য গ্রহণ করবেন তাঁরা। তারপরেই স্টকহোম। ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকল পরাধীন ভারতের এক তরুণের বিজ্ঞান বিশ্বজয়ের।