সিলিকন চিপের ভেতর কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটিয়েছেন বিজ্ঞানীরা

সিলিকন চিপের ভেতর কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটিয়েছেন বিজ্ঞানীরাআইইইই স্পেকট্রাম

কোয়ান্টামের জগৎটা বড় অদ্ভুত। এখানে সাধারণ গতিবিদ্যার নিয়মকানুন অচল। এই জগতে এমন সব কাণ্ড ঘটে, যেগুলো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই বিখ্যাত পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়েও পরে হয়ে ওঠেন এর সবচেয়ে বড় সমালোচক। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এ ধরনের এক অদ্ভুত ঘটনা হলো কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট। আইনস্টাইন যাকে বলেছিলেন ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট এ ডিসট্যান্স’। অনেকে যার সরল বাংলা করেছেন, ‘দূর থেকে ভূতুড়ে কাণ্ড’।

কোয়ান্টামে এন্ট্যাঙ্গলমেন্টকে একসময় বিজ্ঞানীরা অসম্ভব মনে করতেন। কিন্তু এ যুগের বিজ্ঞানীরা এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটিয়েছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো, দুই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আর গবেষণাটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের অধ্যাপক আন্দ্রে মোরেলোর নেতৃত্বে একদল গবেষক। ১৮ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত সায়েন্স জার্নালে।

এ গবেষণায় মোরেলো আর তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, প্রায় ২০ ন্যানোমিটার দূরত্বে থাকা দুই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটানো সম্ভব। এমনিতে মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটানোর দাবি তো কতই আসছে, তৈরি হচ্ছে কত কত সম্ভাবনা। সেখানে একদল বিজ্ঞানী বলছেন ‘কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটানো সম্ভব’—এটা আর অত গুরুত্বপূর্ণ বলা কেন? কিন্তু মোরেলোর দাবি, এটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর মতে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের ভেতরে। সারা বিশ্বে বেশ কিছু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজ চলছে। কোনোটাই এখনো পরিপূর্ণভাবে কাজের উপযোগী হয়নি। মোরেলোর মতে, সাধারণ কম্পিউটারের জন্য অসম্ভব অনেক কাজ কোয়ান্টাম কম্পিউটার করতে পারে। যেমন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অণুগুলোর ভেতরে কিংবা ওষুধ তৈরিতে কোয়ান্টাম প্রভাব কাজ করে। এসবের হিসাব-নিকাশ সাধারণ কম্পিউটার করতে পারে না। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে এসব কাজ নিখুঁতভাবে করা খুব সহজ।

আরও পড়ুন

মোরেলো এবং তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের সাহায্যে আরও উন্নত কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। তাঁরা মনে করেন, সেই কম্পিউটারে তথ্য সঞ্চয়ের জন্য সবচেয়ে নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরস্পরবিরোধী দুটি ঘটনার মধ্যে ভারসাম্য আনা। কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন বাইরের কোনো শব্দ বা নয়েজ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকে। সামান্য নড়াচড়া, বিশৃঙ্খলা কিংবা স্বল্প শক্তির শব্দও এই কম্পিউটার থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে বিরাট প্রভাব রাখতে পারে। অন্যদিকে কম্পিউটারের ভেতরের যন্ত্রপাতিগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে হলে, ঠিকঠাক কাজ করতে গেলে, নয়েজ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ঠিক এই জায়গাতেই তাঁদের গবেষণা কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন এই বিজ্ঞানী।

কিছু যন্ত্র খুব দ্রুত কাজ করতে পারে। ফলে সেসব যন্ত্রে আবার নয়েজ তৈরি হয় বেশি। বাইরের প্রভাবও সেখানে সক্রিয় থাকে। তাই সেগুলো থেকে নির্ভুল মান পাওয়া কঠিন। ঠিক এ কারণেই সারা বিশ্বে একটা প্রতিযোগিতা চলছে, কে কত ভালো কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করতে পারে।

২.

মোরেলোর দল তাঁদের গবেষণায় সিলিকন চিপের ভেতর ফসফরাস পরমাণু বসিয়ে দিয়েছেন। সেই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের স্পিনের সাহায্য নিয়ে সেখান থেকে কোয়ান্টাম তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন। মোরেলো বলেন, একটি কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানাতে হলে একসঙ্গে অনেক নিউক্লিয়াস নিয়ে কাজ করতে হয়। এতদিন একাধিক নিউক্লিয়াস ব্যবহার করার একমাত্র উপায় ছিল তাদের খুব কাছাকাছি স্থাপন করা। সেসব নিউক্লিয়াসগুলোর চারপাশে একটি মাত্র ইলেকট্রন ঘুরত।

একটা নিউক্লিয়াসের তুলনায় একটা ইলেকট্রন অত্যন্ত ছোট। তাই অনেকেই ভাবেন, একটা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণনশীল ইলেকট্রন শুধু সেই নিউক্লিয়াসের প্রভাবেই আটকে থাকে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস বলছে ভিন্ন কথা। কোনো একটা ইলেকট্রনকে যদি কোনো একটা স্থানে রাখেন, তাহলে ইলেকট্রনটি সেই স্থানের সব জায়গাতেই একই সঙ্গে থাকতে পারে। অর্থাৎ পুরো জায়গাজুড়ে সে মেঘের মতো করে থাকবে। ঠিক এ কারণেই একটা ইলেকট্রন একাধিক নিউক্লিয়াসের সঙ্গে একই সময়ে যোগাযোগ করতে পারে। এ কথা ভেবেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে অনেক নিউক্লিয়াসের জন্য একটিমাত্র ইলেকট্রন রাখা হয়।

কিন্তু একটা ইলেকট্রন আর কতটুকু জায়গাতেই-বা ছড়িয়ে থাকতে পারে! ইলেকট্রনের ‘ছড়িয়ে পড়া’র ব্যাপারটা একটা নির্দিষ্ট শক্তিস্তর জুড়েই সম্ভব। সেই শক্তিস্তরের সীমাও নির্ধারিত। তাই তার বাইরে অন্য কোনো নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। অর্থাৎ লক্ষ-কোটি নিউক্লিয়াসকে এভাবে একটি ইলেকট্রনের সাহায্যে যোগাযোগ করানো সম্ভব নয়। তাই মোরেলোরা ব্যবহার করেছেন এন্ট্যাঙ্গল ধর্ম। এ জন্য তাঁরা বিশেষ এক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যার নাম দিয়েছেন ইলেকট্রনিক টেলিফোন প্রযুক্তি।

আরও পড়ুন

এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, একটা থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষার সাহায্যে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। ধরা যাক, একটা জেলখানায় কয়েক হাজার লোককে বন্দী করে রাখা হয়েছে। ধরা যাক, একেক কক্ষে ২০ জন কয়েদি আছে। প্রতিটা কক্ষ সাউন্ডপ্রুফ। অর্থাৎ কক্ষের ভেতরের শব্দ যেমন বাইরে আসে না, তেমনি বাইরের শব্দও ভেতরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু নিজেদের ভেতর কথা বলতে পারে বন্দীরা। আবার এই কয়েদিরা অন্য কক্ষে বন্দী সহচরদের সঙ্গেও কথা বলতে চায়। কিন্তু সেটা গলা ফাটিয়ে বললেও অন্য কক্ষের কেউ শুনতে পারে না। তাই তারা তাদের খাবার সার্ভ করা লোকের সাহায্যে জেলারের কাছে আবেদন করে—অন্য সব কক্ষে বন্দীদের সঙ্গে যেন কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয়।

জেলার তাঁদের আবেদন মঞ্জুর করেন। প্রতিটা কক্ষে একটা টেলিফোন বসিয়ে দেন। এখন কয়েদিরা চাইলেই অন্য বন্দীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন টেলিফোনের সাহায্যে। মোরেলো বলেন, তাঁরা কয়েদিদের মতো প্রচুর নিউক্লিয়াস আটকে রাখেন চিপের ভেতর। আলাদা আলাদা ব্লকে। এক ব্লকের নিউক্লিয়াসগুলো যাতে আরেক ব্লকের নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, এ জন্য তাঁরা ‘ইলেকট্রনিক টেলিফোন’-এর ব্যবস্থা করেছেন।

কিন্তু কী এই ইলেকট্রনিক টেলিফোন? সহজ করে বললে, এখানে টেলিফোনের কাজ করে ইলেকট্রন। বিজ্ঞানীরা সে জন্য প্রতিটা নিউক্লিয়াস ব্লকে একটা করে ইলেকট্রন ব্যবহার করেছেন। সেই ইলেকট্রন যেহেতু মেঘের মতো করে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাই একটি ইলেকট্রন পাশের ব্লকের ইলেকট্রনের সংস্পর্শে আসতে পারে। এই সংস্পর্শের ফলে ইলেকট্রন দুটি এন্ট্যাঙ্গলড হয়, অর্থাৎ এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হয় তাদের মধ্যে। একবার দুটো ইলেকট্রনের মধ্যে এন্ট্যাঙ্গল প্রক্রিয়া শুরু হলে তাদেরকে যত দূরেই নেওয়া হোক, এদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে। এমনকি একটা ইলেকট্রনের অবস্থা ও বিভিন্ন ধর্ম জানতে পারলে অন্যটার অবস্থা ও ধর্মগুলোও তাৎক্ষণিকভাবে জেনে ফেলা সম্ভব। এমনকি এটাকে ব্যবহার করে অন্যটাকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব। মোরেলো ও তাঁর দল কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে একটা ব্লকের নিউক্লিয়াসের সঙ্গে আরেকটা ব্লকের নিউক্লিয়াসের যোগাযোগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। আর এ কাজে তাঁরা ইলেকট্রনকে মাধ্যম বা টেলিফোন হিসেবে ব্যবহার করছেন। এটা বলা যায় ইলেকট্রন চ্যানেল।

মোরেলো ও তাঁর দল ‘জিওমেট্রিক গেট’ নামে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এই ইলেকট্রন চ্যানেল ব্যবহার করে নিউক্লিয়াসগুলোর মধ্যে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটিয়েছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে যেমন সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনের নিউক্লিয়াসে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটানো সম্ভব হয়েছে, তেমনি দূরের নিউক্লিয়াসগুলোকেও যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুন

৩.

গবেষকেরা সিলিকন চিপে ফসফরাসের নিউক্লিয়াসগুলোকে রেখেছিলেন ২০ ন্যানোমিটার দূরত্বে। ২০ ন্যানোমিটার খুব ছোট দূরত্ব, সন্দেহ নেই। কিন্তু কোয়ান্টাম লেভেলে এই দূরত্ব কম নয়। কারণ কণাগুলো আরও ছোট। এন্ট্যাঙ্গলড নিউক্লিয়াসগুলোর মাঝখানে প্রায় ৪০টির মতো সিলিকন পরমাণু ছিল। সেই পরমাণুগুলোকে পাশ কাটিয়ে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখনকার সিলিকন চিপগুলোর আকার ইতিমধ্যে ন্যানোমিটার স্কেলে পৌঁছে গেছে। ইতিমধ্যে কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ক্যালকুলেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহার করা যাচ্ছে। সুতরাং চাইলেই এখন এই এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট প্রক্রিয়ার সাহায্যে সিলিকন চিপগুলোতে ইলেকট্রন বিটের বদলে কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিট ব্যবহার করে পরিচালনা করা যাবে। ফলে দ্রুতই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজে লাগানো সম্ভব হবে এই চিপগুলো। এমনকি স্মার্টফোনসহ অন্যান্য যন্ত্রেও ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

মোরেলো আশা করছেন, আরও বেশি দূরত্বে নিউক্লিয়াসগুলোর মধ্যে এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটানো সম্ভব হবে। সুতরাং তাঁদের এই গবেষণা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে বড় ধরনের সাফল্য বয়ে আনতে যাচ্ছে।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট