পরমাণুর সিংহভাগ জায়গা ফাঁকা হলে শক্ত বস্তু শক্ত থাকে কীভাবে

পরমাণুর ৯৯.৯৯৯৯ ভাগ জায়গাই ফাঁকা। অর্থাৎ, আপনি যে চেয়ারে বসে আছেন বা যে মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, তার প্রায় পুরোটাই শূন্য! তাহলে আমরা কেন মাটি ফুঁড়ে নিচে পড়ে যাই না? দেয়ালের ভেতর দিয়ে কেন চলে যেতে পারি না? চলুন, সেই রহস্যের জট খোলা যাক।

আমরা কেন পরমাণুর ভেতরের ফাঁকা স্থান দেখতে পারি নাছবি: শাটারস্টোক

আপনি এই মুহূর্তে যে চেয়ারে বসে আছেন, যে মেঝেতে পা রেখেছেন কিংবা যে বই হাতে ধরে আছেন—খোলা চোখে এসবই মনে হয় একেবারে শক্ত এবং নিরেট। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বলছে একদম উল্টো কথা। এসব শক্ত বস্তু আসলে প্রায় পুরোটাই ফাঁকা জায়গা।

বিভিন্ন পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, একটা পরমাণুর প্রায় ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৬ ভাগই ফাঁকা স্থান। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দেয়ালের ভেতর দিয়ে আমাদের হাত কেন চলে যায় না? কিংবা চেয়ারে বসলে সেটা গলে ঠাস করে নিচে পড়ে যাই না কেন? টেবিলে হাত রাখলে সেটা শক্ত লাগে কেন? রহস্যটা কী?

এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে পরমাণুর গঠনটা আসলে কেমন এবং এর ভেতরটা কতটা ফাঁকা। একটা পরমাণুর মাঝখানে থাকে নিউক্লিয়াস। সেখানে প্রোটন এবং নিউট্রন কণা শক্তভাবে পরস্পরের সঙ্গে গুটিসুটি মেরে থাকে। একটা পরমাণুর সঙ্গে তুলনা করলে তার নিউক্লিয়াসের আকার অবিশ্বাস্য রকম ছোট। কিন্তু কতটা ছোট?

একটা পুরো পরমাণুর তুলনায় প্রায় এক লাখ ভাগের এক ভাগ মাত্র জায়গা জুড়ে থাকে নিউক্লিয়াস। তুলনাটা বোঝা যাবে একটা ফুটবল স্টেডিয়ামের উদাহরণ দিলে। পুরো পরমাণুকে যদি একটা স্টেডিয়ামের সমান বড় করা হয়, তাহলে নিউক্লিয়াস হবে মাঠের মাঝখানে রাখা একটা ছোট্ট মটরদানার মতো।

আর ইলেকট্রনগুলো? সেগুলো স্টেডিয়ামের চারপাশে ঘুরতে থাকা ধূলিকণার চেয়েও ছোট। স্টেডিয়াম থেকে তাদের দূরত্ব হবে প্রায় কয়েক কিলোমিটার। আর নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনের মাঝখানের বাকি জায়গাটুকু স্রেফ ফাঁকা।

আরও পড়ুন
আপনি যখন একটা টেবিলে হাত রাখেন, তখন আপনার হাতের পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো টেবিলের পরমাণুর ইলেকট্রনগুলোর কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা দেখা দেয়।

আমাদের দেহের প্রতিটি কোষও গড়ে ওঠে পরমাণু দিয়ে। দেহের প্রতিটি পরমাণুর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য—তারও সিংহভাগ জায়গা এ রকমই ফাঁকা। কাজেই আপনার হাত, আপনার চোখ, আপনার মস্তিষ্ক—সবকিছুর সিংহভাগই শূন্যস্থান। মানুষের শরীরে প্রায় ১০ হাজার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণু রয়েছে।

এখানে বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে একটা অবিশ্বাস্য তথ্য উদ্‌ঘাটন করেছেন। আমাদের দেহের সব পরমাণুর ফাঁকা জায়গাগুলো যদি কোনোভাবে সরিয়ে দেওয়া যেত এবং শুধু কঠিন অংশগুলো একসঙ্গে জড়ো করা যেত, তাহলে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের পুরো শরীর একটা চিনির দানার চেয়েও ছোট হয়ে যেত। ভাবা যায়!

তাহলে এত ফাঁকা জায়গা নিয়ে পরমাণু নিরেট হয়ে ওঠে কীভাবে? শক্ত বস্তু শক্ত থাকে কীভাবে? পরমাণুর এই অদ্ভুত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে মূলত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের দুটো মৌলিক নীতিতে। প্রথমটি হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকর্ষণ এবং দ্বিতীয়টি পাউলির বর্জন নীতি। এই দুটি নীতিই একসঙ্গে কাজ করে একটা বস্তুকে শক্ত বা নিরেট রাখে এবং আমাদের দেয়ালের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে দেয় না।

মানুষের শরীরে প্রায় ১০ হাজার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণু রয়েছে
মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

প্রথমে বলা যাক বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকর্ষণের কথা। অনেকে ভাবেন যে বস্তু শক্ত থাকার একমাত্র কারণ হলো ইলেকট্রনগুলোর ঋণাত্মক চার্জ একে অন্যকে ঠেলে দেয়। দুটো চুম্বকের একই মেরু যেমন একে অপরকে দূরে ঠেলে, তেমনি দুটো পরমাণু খুব কাছে এলে তাদের ইলেকট্রনগুলোও একে অপরকে বিকর্ষণ করে। দুটি বস্তু যখন খুব কাছে আসে, তখন তাদের ইলেকট্রন মেঘের মধ্যে এই বিকর্ষণ দ্রুত বেড়ে যায়। আপনি যত বেশি চাপ দিতে চান, বিকর্ষণ তত বেশি শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বস্তু ভেদ করে যাওয়ার বদলে আপনি এক শক্ত প্রতিরোধ অনুভব করেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটা আসলে সম্পূর্ণ নয়।

আসল ঘটনা অনেক বেশি মজার ও জটিল। আপনি যখন একটা টেবিলে হাত রাখেন, তখন আপনার হাতের পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো টেবিলের পরমাণুর ইলেকট্রনগুলোর কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিটি ইলেকট্রন একটা নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে থাকে, আর একই শক্তিস্তরে একটা নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকট্রনই থাকতে পারে। এটা অনেকটা একটা বাসে সীমিতসংখ্যক আসন থাকার মতো—সব আসন ভরে গেলে নতুন যাত্রী বসতে পারবে না।

আরও পড়ুন
ইলেকট্রনকে আমরা প্রায়ই গ্রহের মতো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে বলে মনে করি। কিন্তু বাস্তবে ইলেকট্রন কোনো ছোট বল নয়; এটি একটি কোয়ান্টাম কণা, যার আচরণ তরঙ্গের মতো।

দুটি পরমাণু যখন খুব কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে, তখন তাদের ইলেকট্রনগুলোর ‘নাচের ধরন’ বদলে যায়। প্রতিটি ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে ঘোরে। অনেকটা নৃত্যশিল্পীর মতো। একটা পরমাণুর ইলেকট্রন যখন অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসের কাছে চলে আসে, তখন তার নিম্ন শক্তিস্তরের ‘নাচের জায়গা’ আর খালি থাকে না—সেখানে ইতিমধ্যে অন্য পরমাণুর নিজের ইলেকট্রন রয়েছে। নতুন আগন্তুককে তাই উচ্চ শক্তিস্তরে উঠে যেতে হয়, আরও দ্রুত এবং আরও শক্তিশালী ‘নাচ’ শুরু করতে হয়।

এই উচ্চ শক্তিস্তরে যাওয়ার জন্য শক্তির প্রয়োজন। আর সেই শক্তি জোগাতে হয় আপনার হাতের চাপ থেকে। শুধু দুটো পরমাণুকে কাছাকাছি ঠেলতেই বেশ শক্তি লাগে, কারণ তাদের সব ইলেকট্রনকেই উচ্চ শক্তিস্তরে যেতে হয়। এখন কল্পনা করুন, আপনার হাতের অগণিত পরমাণু এবং টেবিলের অগণিত পরমাণু—এদের সবাইকে একসঙ্গে ঠেলে কাছাকাছি আনতে কত বেশি পরিমাণ শক্তি লাগবে। এই শক্তি আপনার মাংসপেশি জোগাতে পারে না। ফলে টেবিল আপনার হাতকে আটকে দেয়, শক্ত মনে হয়।

এখানে কাজ করছে পাওলির বর্জন নীতি। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী উলফগাং পাউলি এই নীতিটি আবিষ্কার করেন। এই নীতি অনুসারে, যেকোনো দুটো ইলেকট্রন একই কোয়ান্টাম অবস্থায় থাকতে পারে না। প্রতিটি ইলেকট্রনকে তার নিজস্ব একটা ‘ঠিকানা’ থাকতে হবে। এটা এমন যেন প্রকৃতির একটা কঠোর নিয়ম—দুজন মানুষ একই সময়ে একই জায়গায় দাঁড়াতে পারে না।

আরও মজার ব্যাপার হলো, ইলেকট্রনকে আমরা প্রায়ই গ্রহের মতো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে বলে মনে করি। কিন্তু বাস্তবে ইলেকট্রন কোনো ছোট বল নয়; এটি একটি কোয়ান্টাম কণা, যার আচরণ তরঙ্গের মতো। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে, পরমাণুর ইলেকট্রন আসলে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে না, বরং নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটি ইলেকট্রন মেঘ তৈরি করে। এই মেঘের ঘনত্বই বলে দেয়, কোথায় ইলেকট্রন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

দুটো পরমাণু যখন কাছাকাছি আসে, তাদের ইলেকট্রন মেঘ একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে চায়। কিন্তু পাউলির বর্জন নীতি তা ঘটতে দেয় না। এই নীতির সহজ কথা হলো, একই কোয়ান্টাম অবস্থায় দুটো ইলেকট্রন একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই পরমাণুগুলো একে অপরকে দূরে ঠেলে দেয়। অর্থাৎ আপনার হাতের ইলেকট্রন আর টেবিলের ইলেকট্রন এক জায়গা ভাগ করে নিতে রাজি নয়। তারা একে অপরকে এড়িয়ে চলে, আর এই এড়িয়ে চলাটাই আমাদের কাছে প্রতিরোধ হিসেবে ধরা দেয়।

আরও পড়ুন
এই একই নীতি কাজ করে সব কঠিন পদার্থে। ধাতু, কাঠ, পাথর, প্লাস্টিক—সবকিছুতেই। পাউলির বর্জন নীতিই তরল ও কঠিন পদার্থকে প্রায় অসংকোচনশীল করে তোলে।

এই প্রক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয় ডিজেনারেসি প্রেশার বা অবক্ষয় চাপ। এটা একটা কোয়ান্টাম যান্ত্রিক চাপ, যা আসলে কোনো প্রথাগত বল থেকে আসে না। ইলেকট্রনগুলো তাদের শক্তির বণ্টন এমনভাবে করতে বাধ্য, যাতে পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলা হয়। আপনি যখন কোনো কিছুকে চাপ দিতে চান, ইলেকট্রনগুলোকে ছোট জায়গায় ঠেসে ফেলতে হয়। তখন তাদের আরও উচ্চ শক্তিস্তরে উঠে যেতে হয়। সেটা করতে দরকার প্রচুর পরিমাণ শক্তি।

তামার একটা ব্লকের কথা চিন্তা করুন। এর ভ্যালেন্স ইলেকট্রনগুলো যে ডিজেনারেসি প্রেশার তৈরি করে, তার পরিমাণ প্রায় ৪০ গিগাপ্যাসকেল। এটা সমুদ্রের তলদেশের চাপের চেয়ে হাজার গুণ বেশি! এই বিশাল বহির্মুখী চাপকে ভারসাম্য রাখে পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো। আবার এই নিউক্লিয়াসই তার চারপাশের ইলেকট্রনগুলোকে ধরে রাখে। এই দুই চাপের মধ্যে ভারসাম্যের কারণেই তামার ব্লক শক্ত থাকে, সহজে চাপা যায় না।

এই একই নীতি কাজ করে সব কঠিন পদার্থে। ধাতু, কাঠ, পাথর, প্লাস্টিক—সবকিছুতেই। পাউলির বর্জন নীতিই তরল ও কঠিন পদার্থকে প্রায় অসংকোচনশীল করে তোলে।

অনেকের মনে হতে পারে, ইলেকট্রনগুলো কেন নিউক্লিয়াসের ওপর আছড়ে পড়ে পরমাণুটিকে সংকুচিত করে ফেলে না? এখানে কাজ করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। এই নীতি অনুযায়ী, ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র কণার অবস্থান যত নিখুঁতভাবে জানার চেষ্টা করা হবে, তার গতিবেগ বা শক্তি তত বেড়ে যাবে।

ইলেকট্রনকে যদি নিউক্লিয়াসের খুব ছোট্ট জায়গায় আটকে থাকতে বাধ্য করা হতো, তবে তার শক্তি এত বেড়ে যেত যে সে পরমাণু থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেত। এই শক্তির কারণেই ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াস থেকে দূরে একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা ইলেকট্রন মেঘ দখল করে রাখে, যা পরমাণুকে তার আয়তন দেয়।

এর সঙ্গে যোগ হয় বৈদ্যুতিক বল। তবে শুধু বিকর্ষণই সব নয়। পরমাণুগুলো কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না, কেন টেবিল বা চেয়ার একটি নির্দিষ্ট আকারে টিকে থাকে? এর উত্তর হলো রাসায়নিক বন্ধন। পরমাণুর ভেতরকার নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনের আকর্ষণ বল পরমাণুগুলোকে একে অপরের সঙ্গে গেঁথে রাখে। এই আকর্ষণ (যা বস্তুকে ধরে রাখে) এবং বিকর্ষণের (যা অন্য বস্তুকে ঢুকতে বাধা দেয়) সূক্ষ্ম ভারসাম্যই আমাদের চারপাশের জগতকে একটি শক্ত কাঠামো দেয়।

লবণের মতো আয়নিক কঠিনে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন পরস্পরকে তীব্র আকর্ষণে আঁকড়ে ধরে। আবার হীরার মতো বস্তুতে কার্বন পরমাণুগুলো শক্ত সমযোজী বন্ধনে এমন জাল তৈরি করে যে সেই কাঠামো ভাঙা অত্যন্ত কঠিন। এই মাইক্রোস্কোপিক বন্ধনগুলো মিলেই তৈরি হয় ম্যাক্রোস্কোপিক দৃঢ়তা।

এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার। পরমাণুর ভেতরের ফাঁকাটা আমাদের দৈনন্দিন অর্থে ফাঁকা নয়। সেখানে বাতাস নেই, কিন্তু সেখানে কোয়ান্টাম ক্ষেত্র আছে, ইলেকট্রনের তরঙ্গ আছে, বলের আদান–প্রদান আছে। এই অদৃশ্য ক্ষেত্রগুলোই আসলে বাস্তবের সবচেয়ে শক্ত দেয়াল। আপনার হাত টেবিলের ভেতরে ঢুকে না যাওয়ার কারণ কোনো কঠিন দেয়াল নয়, বরং অগণিত ইলেকট্রনের সম্মিলিত ‘না’ বলা।

সূত্র: পার্টিকেল ফিজিকস/ ফ্রাঙ্ক ক্লোজ, চার্জ/ ফ্রাঙ্ক ক্লোজ, ওয়েস্ট টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটি