আশ্চর্য ব্যাঙ!

অলংকরণ: রাকিব

এক

বাবা, দেখো কী সুন্দর একটা ব্যাঙ!

আট বছরের কৌশিক ছোটাছুটি করছিল রিসোর্টের আঙিনাজুড়ে। ঢাকা শহরে তো আর এমন খোলা জায়গা পায় না, ছোটাছুটির সুযোগ নেই, তাই আনন্দে আত্মহারা। হঠাৎ শান্ত হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কৌতূহলে বাবার উদ্দেশে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে উঠল। বাবা, দেখো একটা ব্যাঙ!

বর্ষাকাল, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে দুদিন ধরে, আর এটা মৌলভীবাজারের একটা ইকো রিসোর্ট, পাহাড়ি বুনো জায়গা, চারদিকে ঘন গাছপালা আর ঝোপ, ব্যাঙ কেন, এখানে সাপখোপ থাকাও বিচিত্র নয়। কৌশিকের মা চেঁচিয়ে উঠলেন, দেখো কিন্তু বিরক্ত কোরো না, কামড়ে দেবে।

কৌশিকের মায়ের কথা শুনে হেসে উঠলেন কৌশিকের বাবা, তুমিও যেমন। ব্যাঙ বুঝি কামড়ায়?

তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই আর্তচিৎকার। কৌশিকের মা–বাবা আরাম করে রিসোর্টের কটেজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, কৌশিকের চিৎকার শুনে সব ফেলে পড়িমড়ি করে ছুটলেন। কৌশিক ততক্ষণে ব্যথায় বসে পড়েছে। ওর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। কী হলো, কী হলো, বলতে বলতে ওকে কোলে তুলে নিলেন মা। সে আঙুল তুলে ঘাসে ঢাকা পথটার দিকে নির্দেশ করে বলল, ওই দেখো ব্যাঙটা, আমাকে হঠাৎ কামড়ে দিল! আমি কিন্তু ওকে কিছু করিনি মা!

কৌশিকের বাবা একঝলকের জন্য দেখতে পেলেন ব্যাঙটাকে। চেনাজানা কোনো ব্যাঙের মতো মনে হলো না। ফড়িংয়ের মতো সবুজ গায়ের রং, ফুটকি নয়, শরীরজুড়ে কালো কালো ডোরা কাটা, সাইজে মাঝারি আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, ব্যাঙটা দুই পাটি দাঁত বের করে তাঁর দিকে মুখ খিঁচিয়ে একলাফে পার হয়ে গেল স্যাঁতসেঁতে জায়গাটা। টুপ করে ডুব দিল ওপাশের ডোবার পানিতে। কৌশিকের মায়ের কান্নামেশানো চেঁচামেচিতে তাঁর ঘোরলাগা অবাক ভাবটা কাটল, কী হলো, দাঁড়িয়ে আছ কেন অমন বোকার মতো? বাবুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। বিষাক্ত ব্যাঙ কি না, কে জানে!

ফড়িংয়ের মতো সবুজ গায়ের রং, ফুটকি নয়, শরীরজুড়ে কালো কালো ডোরা কাটা, সাইজে মাঝারি আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, ব্যাঙটা দুই পাটি দাঁত বের করে তাঁর দিকে মুখ খিঁচিয়ে একলাফে পার হয়ে গেল স্যাঁতসেঁতে জায়গাটা।

দুই

ব্যাঙের কামড়?

মুহিব শুনে বেশ অবাক হলো। বাপের জন্মে শোনেনি যে কোনো রোগী ব্যাঙের কামড় খেয়ে চিকিৎসকের কাছে আসে। কৌশিককে বেডের ওপর শুইয়ে মনোযোগ দিয়ে পায়ের আঙুল পরীক্ষা করল সে। রক্ত লেগে আছে খানিকটা, শুকিয়ে গেছে এতক্ষণে। চামড়ায় একটা ছোট্ট কামড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। চারটে দাঁত বসেছিল। ব্যাঙ, নাকি অন্য কিছু? ভাবতে ভাবতেই অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করে দিল জায়গাটা। তারপর অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগিয়ে দিল। রক্তপাত বন্ধ হয়েছে কিন্তু ইনফেকশনের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিষটিষ নেই তো? উদ্বিগ্ন গলায় বললেন কৌশিকের মা।

মুহিব মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক বলতে পারব না। কোনো সমস্যা হলে নিয়ে আসবেন আবার। তবে যত দূর জানি, ব্যাঙ কখনো কামড়ায় না আর তাদের মুখে বিষও নেই। হুম, বিষাক্ত ব্যাঙ আছে বৈকি, পয়জন ডার্ট ফ্রগের কথা পড়েছি কোথায় যেন। তবে ব্যাঙের বিষ থাকে তার চামড়ায়, মুখে নয়। আর ও রকম ব্যাঙ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না, ব্রাজিল, পেরু ওসব দেশে থাকে। আমার মনে হয়, ভয়ের কিছু নেই। কী, ভয় পেয়েছ কৌশিক? ব্যাঙটা ভারি অদ্ভুত, তা–ই না?

কৌশিক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ আঙ্কেল। কেমন জ্বলজ্বল করে তাকিয়েছিল। রাগী চোখে।

মুহিব হাসল, আমার এক বন্ধু আছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের শিক্ষক। ওকে এর কথা বলতে হবে। নতুন নতুন আজব প্রজাতির প্রাণীর দেখা পেলে তাদের ছবি তোলা তার শখ। রিসোর্টের নামটা যেন কী বললেন?

মাধবীলতা। গম্ভীর মুখে বললেন কৌশিকের বাবা। বেড়াতে এসে তাঁদের মন খারাপ। কেমন একটা অঘটন ঘটে গেল।

কৌশিকরা চলে গেলে মুহিবের চেম্বারে বেশ ভিড় জমে গেল। ব্যাঙের কথা তার আর মনে রইল না। এমনকি তার পরের কয়েক দিনও মনে পড়ল না। মনে পড়ল ঠিক চার দিন পর, যখন কুলাউড়ার এক কৃষক পায়ের পাতায় সেলুলাইটিস নিয়ে এল তার চেম্বারে। ডায়াবেটিস বেশি লোকটার, সহজে ঘা শুকাবে না। একটুখানি কেটে পুঁজ বের করে দিতে হবে। পাশের ছোট অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ছোট্ট সার্জারিটা করতে করতে জিজ্ঞেস করল সে, কীভাবে ব্যথা পেয়েছিলেন?

খেতো কাম করাতে আছিলাম। আখতার একটা ব্যাঙে কামড়াইল।

শুনে চমকে উঠল মুহিব। ব্যাঙ?

অয় অয়। সবুজ একটা ব্যাঙ। আমি মনে করছিলাম সাপ। কামড় খাইয়া লাফ দিছি, দেখি একটা ব্যাঙ দাঁত–মুখ খিঁচাইয়া লাফ দিয়া গেল গিয়া।

কী আশ্চর্য! এক সপ্তাহে দু–দুটো ব্যাঙের কামড়ের রোগী! এ তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আজই তৃষাকে ফোন দিতে হবে। সেই রাতে বাড়িতে ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই বন্ধু তৃষাকে ফোন করল মুহিব। একথা–ওকথার পর আসল কথা পাড়ল একসময়, আচ্ছা তৃষা, এমন কোনো জাতের ব্যাঙ আছে যে মানুষকে কামড়াতে পারে?

শুনে হেসে ফেলল তৃষা, ব্যাঙ কীভাবে কামড়াবে? ব্যাঙের তো কোনো দাঁতই নেই! তাই ব্যাঙের কামড় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।

শুনে একেবারে বেকুব হয়ে গেল মুহিব। দাঁত নেই? তবে ওই দাগ চারটে কিসের? এদের কামড়ালই–বা কে?

আরও পড়ুন
২০০ মিলিয়ন বছর আগের প্রাচীন দাঁতওয়ালা ব্যাঙ? এখনো প্রকৃতিতে রয়ে গেছে? কী বলছ এসব মুহিব? যদি তা–ই হয়, তাহলে তো হইচই পড়ে যাবে।

তিন

ডোলো‌‌’স ল অব ইররিভারসিবিলিটি বলে, কোনো প্রজাতি বিবর্তনের মাধ্যমে যদি কোনো বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, তবে তা আবার ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

গম্ভীর মুখে কথাটা বলল তৃষা। যেমন মানুষের আর লেজ ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। লুইস ডোলো নামের প্যালেনটোলজিস্ট আজ থেকে শত বছর আগে এই থিওরি দিয়েছেন, তাঁর নামেই এই ল আর এটা সর্বজনস্বীকৃত।

এমন কি হতে পারে না যে প্রাচীন প্রজাতির ব্যাঙ দু–একটা এখনো কোথাও কোথাও রয়ে গেছে? মুহিব প্রশ্ন করল।

তৃষা অবাক হয়ে তার দিকে থাকাল, ২০০ মিলিয়ন বছর আগের প্রাচীন দাঁতওয়ালা ব্যাঙ? এখনো প্রকৃতিতে রয়ে গেছে? কী বলছ এসব মুহিব? যদি তা–ই হয়, তাহলে তো হইচই পড়ে যাবে।

মুহিব চিন্তিত মুখে বলল, বাচ্চাটার কথা যদি না–ও বিশ্বাস করি, বুঝলাম সে ব্যাঙ চেনে না, কিন্তু তার বাবা বলেছেন তিনি নিজে দাঁত বের করা ব্যাঙটাকে দেখেছেন। সবুজ গায়ের রং। ডোরাকাটা। আর দাঁত বের করে মুখ খিঁচাচ্ছিল। আর ওই কৃষকটাও একই কথা বলল। দুজন বয়স্ক লোক একই মিথ্যা বলবে কেন?

শোনো, দাঁত জিনিসটা লাগে খাওয়ার জন্য, পায়চারি করতে করতে বলল তৃষা। বহু বছর আগে ব্যাঙ বা অ্যামফিবিয়ানরা দাঁত ব্যবহার করত। তারা তখন শিকার কামড়ে খেত। ক্রমে ব্যাঙরা পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকতে শুরু করে। আর এই শিকারে তারা ব্যবহার করতে শুরু করল আঠালো জিব। জানো তো ব্যাঙ অনেক দূর থেকে লম্বা জিব বের করে দূরের কোনো পোকাকে শিকার করতে পারে, এ জন্য তাকে শিকারের কাছে যেতে হয় না। এর ফলে তাদের দাঁতের প্রয়োজনীয়তা কমতে শুরু করে। ক্রমে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে তারা দাঁত জিনিসটাই হারিয়ে ফেলে। যদিও বিজ্ঞানীরা ব্যাঙের চোয়ালে হারিয়ে যাওয়া দাঁতের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। কিন্তু এখন ওতে কেবল চোয়ালটাই আছে, ডেন্টিন বা এনামেল, মানে দাঁতের উপকরণ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এখন যদি দাঁতওয়ালা ব্যাঙ সত্যিই পাওয়া যায়, তবে এটাকে একটা ইভালুশনারি লিপ বলা যায়। মানে বিবর্তনের লম্ফ। ইভালুশনের উল্টো দিকে হাঁটা। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার মুহিব। দিস ইজ ইমপসিবল। এভাবে চললে একসময় টিকটিকি আবার ডাইনোসরে রূপান্তরিত হবে, তা কি হয়?

মুহিব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তাহলে বিষয়টাকে ইগনোর করতে বলছ?

তৃষা তার পাশে বসল। পূর্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, না। ইগনোর করাটা অসম্ভব। চলো, ওই রিসোর্টটাতে যাই। এই অদ্ভুত ব্যাঙের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

অলংকরণ: রাকিব
ব্যাঙ প্রকৃতির একটা আশ্চর্য জীব। এরা যখন শিশু থাকে, মানে ট্যাডপোল, তখন তারা হার্বিভোরাস, মানে ভেজিটেরিয়ান। পানির প্লাঙ্কটন, আগাছা, অ্যালজি খেয়ে বেঁচে থাকে।
আরও পড়ুন

চার

মাধবীলতা রিসোর্টটা একটা পাহাড়ের ওপর। ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে রিসোর্টটা। বেশ সবুজ আর বন্য, মন ভরে যায় দেখলে। তবে রিসোর্টের ম্যানেজার কেমন যেন রহস্যজনক আচরণ করছেন। ওপরের দিকে একটা কটেজ চেয়েছিল তৃষা আর মুহিব, তিনি তা দিতে চাইলেন না। বললেন, মেইন বিল্ডিংয়ের ধারেকাছে নিন। দূরেরগুলো থেকে ওঠানামা কষ্ট।

আমাদের কষ্ট করতে আপত্তি নেই। দূরেরটাই নেব। মুহিবের কথা শুনে তিনি মুখ কালো করে ফেললেন। মিনমিন করে বললেন, মানে যখন–তখন কিছু লাগলে চট করে না–ও পেতে পারেন। আমাদের স্টাফসংখ্যা কমে গেছে।

কেন? এবার প্রশ্ন করল তৃষা।

চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। ভিতুর ডিম একেকটা।

কিসের ভয়ে?

এবার চমকে গেলেন ম্যানেজার। তাড়াতাড়ি বললেন, না না, তেমন কিছু নয়। আচ্ছা, আপনারা তবে ৭ নম্বর কটেজটা নিন। ওটা মাঝামাঝি জায়গায়।

তৃষা সাবধানে প্রশ্ন করল, আপনাদের এখানে সাপ–ব্যাঙ আছে নাকি?

ম্যানেজার ইতস্তত করে বললেন, জঙ্গলের মধ্যে রিসোর্ট, ভরা বর্ষাকাল, থাকতেই পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই। আমরা সাপ তাড়ানোর জন্য কটেজের আশপাশে নিয়মিত কার্বলিক অ্যাসিড ছিটাই। আর পোকামাকড় নিধনের জন্য কীটনাশকও দেওয়া হয়। আমাদের এখানে আলহামদুলিল্লাহ, কোনো পোকামাকড় নেই। পেস্ট কন্ট্রোল টিম তিন–চার দিন পরপরই আসে। একটা মশাও পাবেন না।

তৃষা রেগে গিয়ে বলল, ভেরি গুড।

তবে কটেজে ঢুকে পেছনের ব্যালকনির দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল তৃষা। পেছনে একটা ছোট সবুজ টিলা, মাধবীলতার ঝাড় আর নীল–বেগুনি বুনো ফুলে ঢাকা। অনেক নিচে কুলকুল করে বয়ে চলেছে একটা ছড়া। বাহ! তবে একটু পরই মন খারাপ হয়ে গেল ওর। ব্যালকনির মেঝেতে মরে পড়ে রয়েছে প্রজাপতি আর বোলতা। নিশ্চয় এরা ফুলের মধু খেতে এসেছিল। ম্যানেজারের করিতকর্মা পেস্ট কন্ট্রোল টিমের পাল্লায় পড়ে অঘোরে মরেছে। মেজাজ খারাপ করে বলল তৃষা, ইকো রিসোর্টের নামে ইকোসিস্টেমটা নষ্ট করে ফেলেছে এরা। পোকামাকড় এভাবে নিধন করলে সাপ–ব্যাঙরা খাবে কী? খাবারের অভাবে ব্যাঙরা এখন মানুষ কামড়াতে শুরু করেছে। বোঝো এবার!

ব্যাঙ তো কারনিভোরাস, মানে মাংসাশী, তা–ই না? প্রশ্ন করল মুহিব।

লেকচার দেওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশি হলো তৃষা।

ব্যাঙ প্রকৃতির একটা আশ্চর্য জীব। এরা যখন শিশু থাকে, মানে ট্যাডপোল, তখন তারা হার্বিভোরাস, মানে ভেজিটেরিয়ান। পানির প্লাঙ্কটন, আগাছা, অ্যালজি খেয়ে বেঁচে থাকে। যখন থেকে তাদের পা গজাতে শুরু করে, তখন থেকে তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে যেতে থাকে। তারা ভেজিটেরিয়ান থেকে ক্রমে কারনিভোরাস হয়ে ওঠে। পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙ সাধারণত কীটপতঙ্গ খায়। আবার বড় সাইজের ব্যাঙ, যেমন প্যাক মেন ফ্রগ বা আমেরিকান বুল ফ্রগ, বড় বড় জিনিসও অনায়াসে খেয়ে ফেলে। যেমন টিকটিকি, পাখি, ইঁদুর, বাদুড়, এমনকি ছোট ছোট সাপও।

বলো কী?

হুম। আরও ভয়ংকর ব্যাপার, ব্যাঙ হলো একধরনের ক্যানিবল, মানে একটা ব্যাঙ আরেকটা ব্যাঙকেও খায়। একই অ্যাকুরিয়ামে বড় ব্যাঙ আর ছোট ব্যাঙ রাখা উচিত নয়। বড়টা ছোটটাকে খেয়ে ফেলবে!

সে কী! ভীষণ বাজে ব্যাপার তো!

ঠিক। তৃষা এবার ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দেয়, মানে ব্যাঙ জিনিসটার খাদ্যাভ্যাস খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। এরা যা খুশি, তা–ই করতে পারে। এই মাধবীলতা রিসোর্টের আজব কারনিভোরাস দাঁতালো ব্যাঙরা মানুষের মাংস খেতে শুরু করলে আমি অবাক হব না।

মুহিব ভয় পেয়ে যায় একটু। রিসোর্টের স্টাফরা পালাল কেন সবাই? ব্যাঙটা কি ওদেরও আক্রমণ করেছে? ম্যানেজার কিছু একটা লুকাচ্ছে বলে মনে হলো মুহিবের।

অসুস্থ লোকটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল লবির একটা সোফায়। পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে লোকটা। শরীরটা পানিশূন্য। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

পাঁচ

ভোর হতে না হতেই কটেজের দরজায় আঘাত। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিল মুহিব, দেখছিল যে সে একটা ছোট টিকটিকি হয়ে গেছে আর ভয়ংকরদর্শন ব্যাঙ তাকে তাড়া করছে খাওয়ার জন্য, শব্দ শুনে এসির ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও ঘেমেনেয়ে ধড়মড় করে জেগে উঠল। দরজা খুলে দেখল, রিসোর্টের একজন স্টাফ দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে তৃষাও বেরিয়ে এসেছে।

স্যার, আপনি তো একজন ডাক্তার, তা–ই না? নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল লোকটা।

হুম। কিন্তু কেন? মুহিবের চোখে তখনো ঘুম।

স্যার, আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট শেফ খুবই অসুস্থ। সারা রাত পেটব্যথায় কাতরাইছে। এখন শুরু হইছে ডায়রিয়া আর বমি।

স্যালাইন খাইয়েছ?

স্যালাইন খাইয়াও বমি করতেছে। কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে, স্যার।

তাহলে তো মনে হয় হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। চলো তো দেখি, কী ব্যাপার?

অসুস্থ লোকটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল লবির একটা সোফায়। পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে লোকটা। শরীরটা পানিশূন্য। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুহিব পালস দেখল, পালস ক্ষীণ হয়ে এসেছে। রক্তচাপও কমে যাচ্ছে। একে হাসপাতালে নিয়ে শিরায় স্যালাইন দেওয়া দরকার। কাছাকাছি একটা হাসপাতালে তার এক বন্ধু আছে। সে ফোন করে সব ব্যবস্থা করল। রিসোর্টের জিপে তাকেসহ আরেকজন স্টাফকে তুলে দিল। বলে দিল, কী করতে হবে। ফুড পয়জনিং গোছের কিছু হবে। এত সব ঝামেলা সেরে কটেজে ফিরে দেখে, তৃষা ব্যালকনিতে বসে আছে। ওকে দেখে হাসল তৃষা, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।

হুম, তা–ই। কী আর করা। হাসল মুহিবও।

ব্যাঙটার জন্য অপেক্ষা করছি। যদি দেখা পাই। দেখো, ক্যামেরার লেন্সজুড়ে বসে আছি।

কামড়ে না দেয়।

আরে অত কাছে যাব না। আর এশিয়ান ব্যাঙ বিষাক্ত নয় মোটেও।

এগুলো এশিয়ান, না এলিয়েন, কে জানে?

বলতে না–বলতেই সকালবেলা ডাকতে আসা স্টাফটা এসে হাজির। ভয়ে চোখ–মুখ শুকিয়ে গেছে। মুহিবকে দেখে ফিসফিস করে বলল, স্যার, আপনারা চলে যান। এই রিসোর্ট ভালা নয়।

মানে?

এইখানে ব্যাঙের উৎপাত। দিন–রাত বাড়তেছে। ওরেও কামড়াইছিল। সে বুঝে নাই। কিন্তু তার পায়ের কাছে দাঁতের দাগ দেখছি আমি। আমরা একসঙ্গেই ঘুমাইছিলাম রাতে। তারপর শুরু হইল প্রচণ্ড পেটব্যথা।

নিশ্চয় ফুড পয়জনিং। কিছু উল্টাপাল্টা খেয়েছিল।

না স্যার। এইটা ওই ব্যাঙের বিষ। ব্যাঙের ডরে সব পলাইছে। চাকরির মায়ায় আমরা কয়জন পইড়া রইছিলাম, আর না। আইজই চইলা যামু। রহমত হাসপাতাল থাকি ফিরিয়া আসুক। আমরা এক গেরামের তো।

লোকটা চলে গেলে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল মুহিব। ব্যাঙের বিষের কারণে এমনটা হতে পারে? তৃষা ল্যাপটপ খুলে পড়াশোনায় ডুবে গেল। এই সুযোগে মুহিব একটা চক্কর দিয়ে এল পুরো পাহাড়। আশ্চর্য ব্যাঙের দেখা অবশ্য মিলল না। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ করল মুহিব। গোটা জঙ্গল আর পাহাড়ে কোনো কীটপতঙ্গ, পাখিটাখি নেই। এত ফুল কিন্তু কোনো প্রজাপতি, মৌমাছি বা বোলতা নেই। কেমন অদ্ভুত নির্জন আর নির্জীব জায়গাটা। যেন প্রাণের উপস্থিতি নেই এখানে, আশ্চর্য!

কটেজে ফিরতেই বন্ধুর ফোন। অ্যাসিস্ট্যান্ট শেফ রহমত মিয়া এখন বেশ সুস্থ। ডায়রিয়া–বমি থেমেছে। পেটব্যথা এখনো একটু আছে। তবে লোকটার সব মাংসপেশি অবশ হয়ে যাচ্ছিল। শুনে চমকে উঠল মুহিব, সেকি?

সিম্পটমগুলো মরফিন পয়জনিংয়ের মতো মুহিব, বলল তার বন্ধু। ওখানে কি এরা ড্রাগট্রাগ নেয় নাকি? অ্যানিওয়ে, আন্দাজের ওপর ন্যালোক্সেন ইনজেকশন দিতেই সুস্থ হয়ে উঠল। সে জন্যই সন্দেহটা আরও পাকাপোক্ত হলো।

বন্ধুর ফোন রেখে চিন্তিত মুখে তৃষার রুমে আসতে তৃষা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে বলল, এপিবাটিডিন!

মানে কী?

লাতিন আমেরিকার পয়জন ডার্ট ফ্রগের ত্বকে যে বিষ থাকে, তার নাম এপিবাটিডিন। মরফিনের মতো কিন্তু মরফিনের চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী ব্যথানাশক। মাত্র আড়াই মিলিগ্রাম এপিবাটিডিন প্রায় ১০ মিলিগ্রাম মরফিনের সমান কাজ করতে পারে। এই দারুণ রাসায়নিক নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন দুনিয়ার বড় বড় বিজ্ঞানী। পয়জন ডার্ট ফ্রগের ত্বক থেকে সংগ্রহ করা হতো এপিবাটিডিন। তারপর কমার্শিয়াল ব্যবহারের জন্য পাঠানো হতো গবেষণাগারে। বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো ইনভেস্ট করে এই মলিকিউলের ওপর। অপারেশনের পর বা ক্যানসারের রোগীর ব্যথা–যন্ত্রণা কমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ দিতে পারে এটি। সফল হলে তো পোয়াবারো। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। আর এ কাজ করতে গিয়ে লাখ লাখ ব্যাঙ হত্যা করতে শুরু করে তারা। কয়েক মিলিগ্রাম এপিবাটিডিন সংগ্রহ করতে ইকুয়েডরের তিন হাজার ব্যাঙের ত্বক ছিলে নিয়েছিলেন এর আবিষ্কারক জন ডেলি আর চার্লস মেয়ার্স।

কী সর্বনাশ!

হুম। এভাবেই মানুষ যুগে যুগে প্রকৃতি আর এর সন্তানদের ধ্বংস করেছে। তার প্রতিশোধও প্রকৃতি নেবে। এই দেখো, বিষাক্ত দাঁতওয়ালা ব্যাঙ ফিরে আসছে। তৃষা রেগে গেল কথাটা বলতে বলতে।

কিন্তু এপিবাটিডিন প্রজেক্টের কী হলো?

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ফেজ টু ট্রায়াল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু তারপর প্রচণ্ড পেটব্যথা, বমি, ডায়রিয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় ট্রায়াল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইকুয়েডরের পয়জন ডার্ট ফ্রগগুলোও শেষাবধি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়।

তৃষার কথা শুনে মুখ হাঁ হয়ে গেল মুহিবের। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এই রিসোর্টে কী হচ্ছে তাহলে? অ্যাসিস্ট্যান্ট শেফ রহমত মিয়াকে কি তবে সত্যিই বিষাক্ত ব্যাঙ কামড়ে দিয়েছে? কিন্তু ব্যাঙের বিষ তো থাকে তার চামড়ায়, দাঁতে নয়। কিছু একটা মেলানো যাচ্ছে না। কোথায় যেন একটা রহস্য থেকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

ছয়

তিন দিন মাধবীলতায় থেকেও আশ্চর্য ব্যাঙের দেখা পায়নি মুহিব বা তৃষা। এমনকি তারা গোটা পাহাড়–জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। স্রেফ উধাও হয়ে গেছে দাঁতালো ব্যাঙগুলো। তবে রহমত মিয়ার রক্তের স্যাম্পল তারা ঢাকার কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে পাঠিয়েছিল। সেখানে এপিবাটিডিনের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বেশির ভাগ স্টাফ কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে পরের সপ্তাহেই সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় মাধবীলতা রিসোর্ট। দিন দিন রিসোর্টটা জংলি, পরিত্যক্ত ও ভুতুড়ে হয়ে গেলে এর প্রবাসী মালিক গোটা জমিটা কয়েক মাস পর একজনের কাছে বিক্রি করে দেন। নতুন মালিক এখানে আদিবাসীদের জন্য একটা স্কুল চালু করার উদ্যোগ নিলেন। জঙ্গল সাফসুতরো করে স্কুলের কাজ শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। কিন্তু যে কোম্পানিকে মেরামত আর সাফসুতরোর কাজ দেওয়া হয়েছিল, তার লোকেরা প্রথম দিন পরিত্যক্ত তালা দেওয়া কটেজগুলোর তালা খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। কটেজের মেঝে, ব্যালকনি, বিছানা, বাথরুম, জানালা সর্বত্র তখন গিজগিজ করছিল হাজার হাজার সবুজ রঙের দাঁতওয়ালা ব্যাঙ!

মাধবীলতা স্কুল চালু করার আগে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার ব্যাঙ হত্যা করেছিল এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

 *লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ২০২২ সালের জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন