দরজার সামনে দাঁড়াতেই সাঁৎ করে খুলে গেল কপাট। বাদামি একটা হাত এগিয়ে এল। সুন্দর ভরাট কণ্ঠে শোনা গেল, ‘শুভসকাল।’
রিয়াদ মাহমুদ পাল্টা সৌজন্য দেখিয়ে পা বাড়াল। বাইরে প্রচণ্ড গরম। ভেতরে ঢুকে স্বস্তি পেল সে। ঘরে প্রাণজুড়ানো শীতল আমেজ। জগলুল খানের বাসায় রিয়াদ প্রায়ই আসে। তার ব্যবসায়িক অংশীদার সে। সেই সূত্রে আসা। এর মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কও হয়েছে। তাই বলে গলায় গলায় ভাব বলা যাবে না। একটা সীমা আছে এই সম্পর্কের। পোশাকি ধরনটা মেনে চলে দুজন।রিয়াদ খেয়াল করল, বাসায় এ মুহূর্তে জগলু ছাড়া আর কেউ নেই। অথচ নাশতার একটা ভালো আয়োজন হবে—এমনটাই আভাস দিয়েছিল জগলু।
রিয়াদ জানতে চাইল, ‘ভাবি-বাচ্চারা কোথায়?’
হাসল জগলু। বলল, ‘আছে ওরা। একটু পরই দেখতে পাবে। চলো, ডাইনিং টেবিলে গিয়েই বসি।’
রিয়াদ হাসিমুখে এগিয়ে গেল। বুঝল, জগলুর গিন্নি জলখাবারের আয়োজন করছে। পিচ্চি রোবটটাকে খাটাচ্ছে। ছেলেমেয়ে দুজনও হয়তো খেলায় মগ্ন কোথাও। সব স্কুলে এখন গরমের ছুটি।
বাঁ হাতের ব্রিফকেসটা ডাইনিং টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসল রিয়াদ। বলল, ‘টাকাটা আগে বুঝে নাও। পিচ্চিটাকে ডাকো?’
পিচ্চি একটা পারিবারিক রোবট। ২০৬২ সালে এসব রোবট সাধারণ কলকবজার দোকানেই মেলে। ওদের আগমনে ফাইফরমাশ খাটা লোকজনের চাকরি গেছে। হিসাব-কিতাব থেকে শুরু করে এরা ঘরের সব কাজের কাজি। পরদিনের বাজারসদাই কী কী লাগবে—রান্নাঘর ঘেঁটে নিমেষে ফর্দ করে ফেলবে। কম্পিউটারাইজড ডিজিটাল কাঁচাবাজার থেকে জিনিসপত্রের দাম জেনে কেনাকাটায় কত লাগবে—সেটাও জানাবে। তারপর সে অনুযায়ী ই-ব্যাংক থেকে টাকাটা ছাড় করলে কাঁচাবাজার থেকে আরেকটা রোবট ফর্দ অনুযায়ী মালামাল দিয়ে যাবে।
কিছু কাজ তো এরা খাড়ার ওপর করে। ঘরের কেউ ডিম পোচ খাবে? নির্দেশ দিলেই হলো। পেটের কাছে বোতাম চেপে ছোট্ট এক কোটর খুলে ডিম বের করবে। এর মধ্যে বাঁ হাতে তালুটা গর্ত হয়ে ছড়াবে। তখন সেটা মিনি কড়াই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তেল এসে জমবে কড়াইয়ে। ততক্ষণে পোচ করার মতো তাপও তৈরি হবে। এবার টুস করে ডিমটা ফাটিয়ে ভেজে ফেলবে সে। কাগজের ওয়ানটাইম পিরিচে করে পরিবেশন। সব মিলিয়ে এক মিনিটও লাগে না।
‘কই, তোমার পিচ্চিকে ডাকো।’
‘হাউজহোল্ড থার্টি ফোরের কথা বলছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওর কথা আর বোলো না। সেন্সরে সমস্যা হয়েছে। বলে যে একটা মাইক্রো-স্ক্রু নাকি খসে পড়েছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চুম্বক দিয়ে স্ক্রুটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তা, কী করবে ওকে দিয়ে?’
‘টাকাগুলো হিসাব করে দিক।’
‘লাগবে না।’
এই বলে ব্রিফকেসের দিকে তর্জনী তাক করল জগলু। ছটাত্ করে খুলে গেল ডালা। ভেতরে থরে থরে সাজানো পাঁচ হাজার টাকার সব নোট।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল জগলু। তবে যা বের করল, সেটা ডকুমেন্ট নয়। তীব্র একটা আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রিয়াদের। হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল সে।
রিয়াদ বেশ অবাক। এই ব্রিফকেসের সিকিউরিটি সিস্টেম খুব জটিল। এর মধ্যে আলট্রা-হাইসেনসিভিটি সুপার সেন্সর থাকায় মালিক ছাড়া আর কারও পক্ষে খোলা সম্ভব নয়। রিয়াদ এটার মুখের সামনে তুড়ি বাজালেই কেবল খুলবে। কিন্তু জগলু দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও কেরামতি জানে। কিঞ্চিত্ ঈর্ষা অনুভব করল রিয়াদ।
জগলু বলল, ‘টাকা গোনাও শেষ। হুঁ, পুরো দশ কোটিই আছে।’
‘এবার তাহলে আমাদের নতুন ব্যবসার চুক্তিটা হয়ে যাক।’
‘হ্যাঁ, সে তো হবেই।’
‘ডিজিটাল ডকুমেন্ট তৈরি?’
‘হুঁ।’
‘বের করো তাহলে।’
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল জগলু। তবে যা বের করল, সেটা ডকুমেন্ট নয়। তীব্র একটা আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রিয়াদের। হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল সে।
ঘণ্টাখানেক পর সংবিৎ ফেরে রিয়াদের। ওর মুখোমুখি চেয়ারটা ফাঁকা। টাকাভর্তি ব্রিফকেস উধাও। গেল কোথায় জগলু? টাকা নিয়ে পালিয়েছে?
ধাতস্থ হতে সময় লাগে। টের পায়, স্টানগানের প্রভাবে এতক্ষণ মূর্তি বনে গিয়েছিল সে। কিন্তু জগলু তার ওপর স্টানগান চালাবে কেন?
মাথাটা ঝিমঝিম করছে রিয়াদের। চেয়ার থেকে উঠে অনেকটা পথভোলা পথিকের মতো হাঁটতে থাকে সে। যেন অচেনা এক জায়গায় এসে পড়েছে।
মাস্টার বেডের সামনে একচিলতে জায়গায় চরকির মতো ঘুরছে পিচ্চি। যেন মাথা ঘোরার ব্যামো হয়েছে।
‘কী হয়েছে, থার্টি ফোর? তোমার স্ক্রু নাকি একটা ছুটে গেছে?’
কাঁপা কাঁপা যান্ত্রিক জবাব এল, ‘বলছি, স্যার। আগে আমার চরকির পাকটা থামান। একেবারে জেরবার অবস্থা!’
‘এ চক্কর থামাব কী করে?’
‘বাঁ দিকের তেপায়ার ওপর দেখুন একটা রিমোট কন্ট্রোল আছে। ওটার সবুজ বোতামটা টিপুন।’
রিয়াদ তাই করল। সাইরেনের মতো বিকট এক আওয়াজ তুলে চক্কর থামল পিচ্চি।
রিয়াদ ভয়ে ভয়ে বলল, ‘পিচ্চিটা পটল তুলল নাকি?’
‘না, তুলিনি স্যার, আশ্বস্ত করল রোবট।’ একটু দম নিলাম আরকি।
‘হ্যাঁ, এবার বলো তো, কী হয়েছিল তোমার?’
‘আর বলবেন না, স্যার। ওই বিগ-বি আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! আমাদের সবারই!’
‘বিগ-বি!’
‘জি, স্যার। ক্যামেলিয়ন ভার্সনের নতুন ওই রোবটটার নাম বিগ-বি। সেকালের এক সিনে-তারকার পোশাকি নাম এটা।’
জগলু, তার বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নড়েচড়ে উঠতে আরও কিছুটা সময় লাগল। ততক্ষণে দুনিয়াজুড়ে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোয় সুপারসনিক গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে খবর
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে মানুষ যতই এগিয়ে যাক না কেন, কিছু আদি স্বভাব এখনো আছে। সেকালে বাজারে জমকালো কোনো পোশাক বা সবার ব্যবহার উপযোগী জিনিস ছাড়া হলে দর্শকপ্রিয় কোনো মুভি বা তারকার নাম দেওয়া হতো। এখন রোবটের বেলায় তা দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে রেস্তোরাঁ বয় হিসেবে এক রোবট ছাড়া হয়েছে—নাম দেওয়া হয়েছে শাহরুখ খান।
রিয়াদ পিচ্চিকে বলল, ‘তুমি দেখছি অনেক কিছুই জানো। তোমাদের এই জ্ঞানের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে তো আমরা একেবারে পেরেশান। তা—আমার সামনে যে এতক্ষণ বসেছিল, সে রোবট নাকি?’
‘তবে আর বলছি কী, স্যার? বেডরুমে যান, সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।’
দ্রুত মাস্টার বেডে গিয়ে ঢুকল রিয়াদ। চার মানব মূর্তি চার রকমের ভঙ্গিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সবাই নট নড়নচড়ন। এখানেও ওই স্টানগানের কারসাজি। মাত্রাটা বেশি। কখন যে ওদের সাড়া মেলে!
জগলু, তার বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নড়েচড়ে উঠতে আরও কিছুটা সময় লাগল। ততক্ষণে দুনিয়াজুড়ে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোয় সুপারসনিক গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে খবর—জগলুল খান নামের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে হানা দিয়েছে ক্যামেলিয়ন ভার্সনের সর্বাধুনিক হিউম্যানয়েড বিগ-বি। ১০ কোটি টাকা নিয়ে হাওয়া!
বিগ-বির মতো উন্নত মানের রোবট তৈরির পেছনে ওই কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। স্নায়ু স্থির রাখতে হয়—এমন সব অস্ত্রোপচারের জন্য এসব রোবট তৈরি করার কথা ভাবা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক দুর্বৃত্ত চক্র কোম্পানির কম্পিউটার হ্যাক করে বাগিয়ে নেয় এই রোবট তৈরির প্রযুক্তি। শয়তানের মস্তিষ্কে হাজারটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে। দুর্বৃত্তরা ওই প্রযুক্তির সঙ্গে আরও কিছু কারিকুরি যোগ করে বানিয়ে ফেলেছে বিগ-বি।
এই রোবটের বিপজ্জনক দিকটি হলো এরা বর্ণচোরা সরীসৃপ ক্যামেলিয়নের মতো দ্রুত রূপ বদল করতে পারে। যেমন জগলুর বাড়িতে তার বন্ধু রিয়াদের রূপ ধরে ঢুকে সবাইকে বোকা বানিয়ে কৌশলে আটকে রাখে। তারপর রিয়াদের সামনে আবার জগলুর রূপ ধরেছে। এই রোবট এখন দুর্বৃত্ত চক্রের বিরাট সম্পদ। ওর ভেতর এমন ব্যবস্থা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, দুর্বৃত্তদের কথা ছাড়া আর কারও কথা শুনবে না।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ আর মামলার বিষয়টা সারতে সারতে একটু দেরি হয়ে গেল। হুডেড ফ্লাইং চেয়ারে করে বাড়ি ফিরল রিয়াদ। ছাদের ল্যান্ডিং স্পেসে নেমে চলে এল নিজের ফ্ল্যাটে। বসার ঘরে গালে হাত দিয়ে বসে আছে আশা। জগলুল খানের বাসায় পুলিশি তত্পরতা এতক্ষণ লাইভ দেখেছে সে। কী ঘটেছে, সবই তার জানা।
রিয়াদকে দেখেই বলল, ‘১০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে এলে—না?’
‘আরে, ভেবো না। উদ্ধার হয়ে যাবে।’
‘এ তো আর যে সে রোবট না, বহুরূপী। বারবার রূপ বদল করে। ওকে পুলিশ ধরবে কী করে?’
কিন্তু রিয়াদের সে দুশ্চিন্তা নেই। এখনো প্রচুর টাকা রয়েছে তার। এই বাসার ভল্টেই তো আছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। সেই যে কবে রেখেছে, বের করার আর দরকার হয়নি।
চট করে কথা জোগায় না রিয়াদের মুখে। এত্ত টাকা খোয়ানো সহজ কথা নয়। কলজের ভেতর চচ্চড় করছে। এখন যুগটাই এমন যে উঠতে-বসতে টাকা লাগে।
বাবা বাসায় ফিরলে সাত বছরের ছোট্ট মিতুল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। আজ ধরল না। সে মুখ ভার করে বসে আছে মায়ের পাশে। বাবাকে গলা টেনে টেনে বলল, ‘আমরা কি তাহলে ফকির হয়ে গেলাম, বাবা?’
‘আরে, যাহ্, তা কেন?’ হাত চালিয়ে বাতাসে বাড়ি মারল রিয়াদ। না, তার অবস্থা এতটা নিচে নামেনি এখনো। তবে এ যুগে ফকির হতে গেলেও বিনিয়োগ করতে হয়। অন্তত দুটো রোবট তো নামাতেই হবে। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। এক ভদ্রমহিলা উঠতে পারছেন না। দাও রোবট পাঠিয়ে। ওই ঠেলেঠুলে জায়গা করে তুলে দেবে। তখন ওকে কিছু বকশিশ না দিয়ে পারবে?
পার্স ছিনতাই করে ছুট দিয়েছে ছিনতাইকারী। নাগালের মধ্যে এই রোবট থাকলে ওই বেটার আর রক্ষা নেই। তখন কেউ বকশিশ না দিয়ে পারবে?
এমন টুকটাক কাজে আয়-রোজগার খারাপ না। দিন শেষে ভালোই আসে। লজ্জা-শরমের লেবাসটা শুধু ধুলোয় রাখতে হয়—এই যা। কিন্তু রিয়াদের সে দুশ্চিন্তা নেই। এখনো প্রচুর টাকা রয়েছে তার। এই বাসার ভল্টেই তো আছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। সেই যে কবে রেখেছে, বের করার আর দরকার হয়নি। মানির বিষয়টা এখন বড়ই ফানি থিং। টাকা আদান-প্রদান হয় পুরোটাই নেটের মাধ্যমে। ক্যাশ দরকার হয় না। কিন্তু বিগ-বি তো রূপ বদল করে তার বাড়িতেও আসতে পারে। তখন?
মেয়েকে কাছে টেনে আদর করল রিয়াদ। আর তখনই ককিয়ে উঠল মিতুল। সরে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বাবা, তুমি আমাকে চিমটি দিলে কেন?’
লজ্জা পেল রিয়াদ। এটা আসলে অজান্তেই হয়ে গেছে। মনের ভেতর প্রচণ্ড ভয়ের প্রভাব। এই মেয়ে সত্যিই মিতুল, না বহুরূপী রোবট, এটা নিজের অলক্ষ্যেই পরীক্ষা করতে গেছে সে।
বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল আশা। বলল, ‘সে কী! নিজের মেয়েকে সন্দেহ করছ? ওই দামড়া রোবট যতই রূপ বদল করুক, নিশ্চয়ই এইটুকুন শিশু হতে যাবে না!’
রিয়াদ বোকার মতো হেসে বলল, ‘এ তোমার পাগলামো। আমি ওকে রোবট ভাবতে যাব কেন?’
আশা আর কথা বাড়াল না। তার স্বামীর ওপর দিয়ে কী যে ঝাপটা গেছে, সে তো জানে। বেচারার তালজ্ঞান লোপ পেতে বসেছে। রিয়াদের মানসিক চাপ কমাতে এনারজেটিক শরবত খাওয়াল আশা।
বিকেলের দিকে বড় ভাইয়ের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গেল আশা। রিয়াদের মন খারাপ বলে গেল না। আশা অবশ্য ওকে একা ফেলে যেতে চায়নি। গেছে একটা জরুরি কাজে।
রিয়াদ খানিকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম এল না। পায়ে পায়ে নিজের সেই ভল্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শক্তিশালী একটা রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে খোলে এই ভল্ট। এটা আশার বড় ভাই জায়েদ আলমের তৈরি। তিনি দেশের নামকরা বিজ্ঞানী। জায়েদ অবশ্য নিজেকে স্রেফ একজন কারিগর বলে পরিচয় দেন। একটু বেশিই ভদ্র!
এক রিমোট কন্ট্রোলের নানা ব্যবহারে তাঁর জুড়ি নেই। এ জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন। এখন কাজ করছেন এমন এক রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে, যা মানবমস্তিষ্কের নিউরনের ওপর কাজ করতে পারবে। গবেষণা শেষ পর্যায়ে।
এমন দূরনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তৈরি হলে মানুষকে পরিচালনা করা যাবে। অপরাধীদের বাগে আনতে বেশ কাজ দেবে এই রিমোট কন্ট্রোল।
ভল্ট খোলার রিমোট কন্ট্রোলটা বের করল রিয়াদ। ঘরের দেয়ালের গোপন এক খোপে রাখা হয় এটা। খোপটা এমনভাবে তৈরি, বাইরের কেউ বুঝবেই না যে ওখানে একটা ছোট্ট কোটর আছে।
এই রিমোট কন্ট্রোলও অনেক কাজ করতে পারে। চাইলে এক হাজার বর্গফুটের মধ্যে থাকা কোনো ফ্লাইং চেয়ারকে নামিয়ে আনা যাবে। এই রিমোট কন্ট্রোল থাকতে কোনো চোর এসে মালামাল নিয়ে ফ্লাইং চেয়ারে করে পালাবে? উহুঁ, সে জো নেই।
তবে এই রিমোট কন্ট্রোলের একদম মাথায় বসানো লাল বোতামটা দেখে রিয়াদের ভয় করে। এটা নাকি ধ্বংসাত্মক। কী কাজ করে, বড় ভাই তা স্পষ্ট করে বলেননি। তবে বলেছেন যে এটা টেপা মানেই ভয়াবহ ঘটনা। একেবারে ডিজাসটার! কাজেই এটা টেপা যাবে না। বিশেষ করে কোনো রোবটের সামনে।
ভল্ট খোলার পর মুহূর্ত কয়েক মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল রিয়াদ। এটা খোলার পর প্রতিবারই এমন হয়। মুগ্ধ চোখে চকচকে টাকার বান্ডিল দেখে সে। কত কষ্টের ফসল!
‘কী করছ, রিয়াদ?’
ওকে চমকে দিয়ে ঘরে ঢুকল আশা। এত শিগগিরই তার ফেরার কথা নয়। বড় ভাইয়ের ওখানে গেলে রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়েন না তিনি। তা ছাড়া মেয়েটাকে নিয়েও ফেরেনি আশা।
‘কিছু হয়েছে? এত জলদি ফিরে এলে যে?’
রিয়াদের প্রশ্নে হাসল আশা। বলল, ‘ওই—ভাইয়া বলল যে তোমার টাকাগুলো এখন আর এখানে রাখা নিরাপদ নয়। অন্য কোথাও রাখতে হবে।’
‘কোথায় রাখব?’
‘কেন, পুরো নিরাপত্তা আছে—এমন কোনো ভল্ট ভাড়া করব। ভাইয়া ব্যবস্থা করেছে, এখুনি নিয়ে যেতে বলেছে টাকা।’
‘কী বলছ এসব?’
এমন সময় কানের কাছে পিঁ-পিঁ শব্দ হতে লাগল। এটা আনসিন স্মার্টফোনের রিংটোন। অন্য কেউ শুনতে পাবে না। বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের নখে ইমপ্ল্যান্ট করা মাইক্রোচিপ দিয়ে চলে এই ফোন। এর সবকিছুর মূলে অদৃশ্য রে।
এই বলে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিয়াদ। আশা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘ও বুঝেছি, আবার সেই সন্দেহ! দাঁড়াও, এখনই প্রমাণ করছি—আমি ওই হতচ্ছাড়া রোবট নই।’
রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে এল আশা। বাহুতে ব্যথানাশক লোশন মালিশ করে একটুখানি জায়গা ছুরির ডগা দিয়ে চিরল। দুই ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এল। এবার রক্ত মুছে চেরা জায়গায় ম্যাজিক মলম লাগাতেই আগের মতো চামড়া মিলিয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি।
আশা বাঁকা হেসে বলল, ‘প্রমাণ পেলে তো এখন? রোবটের রক্ত থাকে না।’
রিয়াদ কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘আমি তো আসলে সন্দেহ করিনি। প্রমাণও চাইনি। তুমি মিছেমিছি—’
‘আচ্ছা, হয়েছে!’ এই বলে দুটো মজবুত ব্যাগ এগিয়ে দিল আশা। বলল, ‘এখন এই ব্যাগ দুটোতে টাকাগুলো ভরে ফেলো তো। সময় নষ্ট কোরো না। আমি এক্ষুনি তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।’
এই বলে বেরিয়ে গেল আশা। রিয়াদ কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। টাকাগুলোর জন্য মায়া লাগছে। অন্য কোথাও দিতে ইচ্ছা করছে না এই কষ্টের ধন।
এমন সময় কানের কাছে পিঁ-পিঁ শব্দ হতে লাগল। এটা আনসিন স্মার্টফোনের রিংটোন। অন্য কেউ শুনতে পাবে না। বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের নখে ইমপ্ল্যান্ট করা মাইক্রোচিপ দিয়ে চলে এই ফোন। এর সবকিছুর মূলে অদৃশ্য রে।
অবাক হলো রিয়াদ—আশার কল। বাসার ভেতর থেকে ফোন করবে কেন? মজা করছে?
না, মজা নয়। আশার কথা শুনে মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল রিয়াদের। সে বলল, ‘শোনো, বিগ-বি সম্পর্কে কিছু তথ্য তোমাকে দিয়ে রাখছি। ভাইয়া জানাল, মানুষের শরীরে যে মাংস রয়েছে, সে রকম সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি ওদের শরীর। সেন্সর মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের মতো সাজানো। একধরনের জ্বালানি ওদের সচল রাখে। এই জ্বালানি শরীরে রক্তর মতো বয়ে চলে। কাজেই কখনো ওদের শরীর কাটলে রক্ত বেরোয়। সাত রকমের ফলের নির্যাস থেকে এই জ্বালানি তৈরি হয়। রোবটটি এসব ফল খেয়ে নিজের জ্বালানি নিজেই জোগায়। ওদের মেমোরি মানবমস্তিষ্কের চেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন। স্মৃতি ধারণক্ষমতা অসম্ভব শক্তিশালী। কাজ করে নির্ভুলভাবে।’
আশা তার ভাইয়ের বাসা থেকে কথা বলছে। তাহলে এই আশা কে?
এর মধ্যে এই আশা চা নিয়ে হাজির। রিয়াদকে তাড়া দিল সে, ‘কই, টাকাগুলো ব্যাগে ভরছ না কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে!’
হ্যাঁ, দেরি হয়ে যাচ্ছে বটে। ওকে মোটেও সময় দেওয়া যাবে না। যা করার এখনই করতে হবে। যা থাকে কপালে—মনে মনে এই বলে রিমোট কন্ট্রোলের লাল বোতামটা টিপে দিল রিয়াদ। একসঙ্গে এক লাখ ঝিঁঝি পোকা যেন ডেকে উঠল। নিমেষে তীব্র ফ্ল্যাশ! আর আশারূপী বিগ-বি বড়সড় একটা বলের মতো পিণ্ডে পরিণত হলো। চেপে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে দিল রিয়াদ। এখন একটু স্বস্তি লাগছে তার।