বাবাকে খুঁজতে এসেছে রজার। আজ রোববার। তাই নিয়ম অনুযায়ী আজ তার বাবার অফিস করার কথা নয়, ছুটিতে থাকা উচিত। রজার তাই খোঁজখবর নিতে এসেছে, বাবার অফিসে সব ঠিকঠাক আছে কি না।
বাবাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। কারণ, জায়ান্ট কম্পিউটার মাল্টিভ্যাক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সবাই পরিবার নিয়ে অফিসের পাশে একই পরিসরে বাস করেন। তাঁরা সবাই মিলে ছোটখাটো একটা শহর গড়ে তুলেছেন। আর এ শহরের বাসিন্দারা পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করেন।
রোববারের রিসিপশনিস্ট রজারকে চেনে। ওকে দেখে মেয়েটা বলল, ‘বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাও নাকি? নিচের “এল” করিডরে আছেন উনি, ওখানে চলে যাও। তবে বাবা কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত, তোমার সঙ্গে হয়তো দেখা করতে পারবেন না।’
রজার অবশ্য দমল না এ কথা শুনে। ভাবল, দেখি না নিচে গিয়ে দেখা করা যায় কি না। নিচের করিডরে নেমে একটা দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল সে। অনেক নারী-পুরুষের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ভেতরে। খলবলিয়ে কথা বলছে সবাই। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের মতো জনাকীর্ণ নয় আজ করিডরগুলো, বলা যায় ফাঁকা। সে জন্য কোথায় কে কী কাজ করছে, তা খুঁজে বের করা যাচ্ছে অনায়াসে।
বাবাকে খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট হলো না রজারের, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল তাঁকে। তাঁর চেহারায় বিষাদের ছাপ। দেখেই বুঝে গেল রজার, কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে।
‘রজার,’ বললেন বাবা, ‘আমি খুব ব্যস্ত। তোমাকে বোধ হয় সময় দিতে পারব না।’
রজারের বাবার বস পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বাবাকে বললেন, ‘একটু জিরিয়ে নাও, অ্যাটকিনস। ৯ ঘণ্টা ধরে তো পড়ে আছ এটা নিয়ে, কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। ছেলেটাকে নিয়ে একটু কমিশারি থেকে ঘুরে এসো। ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে আবার চলে এসো।’
বসের আদেশ শোনার ইচ্ছা আছে বলে মনে হলো না রজারের বাবার। তাঁর হাতে একটা যন্ত্র। রজার জানে, ওটা একটা কারেন্ট প্যাটার্ন অ্যানালাইজার। অবশ্য জিনিসটি কীভাবে কাজ করে, তা সে জানে না। মাল্টিভ্যাকের চলার গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে রজার—খলবলিয়ে হাসছে যেন জায়ান্ট কম্পিউটারটা।
খানিকক্ষণ দোনোমনা করে অবশেষে অ্যানালাইজারটি নামিয়ে রাখলেন বাবা হাত থেকে। ‘ঠিক আছে। চলো, রজার, তোমাকে হ্যামবার্গার খাওয়াই। এই ফাঁকে আমাকে ছাড়া এখানকার এই জ্ঞানী লোকজন খুঁজে বের করুক সমস্যাটা কী।’
হাত–মুখ ধুয়ে সাফসুতরো হয়ে তারপর রজারকে নিয়ে রওনা হলেন বাবা। কমিশারিতে গিয়ে দুটি বড় হ্যামবার্গারের অর্ডার দিলেন বাপ-বেটায়। হ্যামবার্গার, সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর সোডা পপও এল দুজনের জন্য।
‘মাল্টিভ্যাক এখনো ঠিক হয়নি, বাবা?’ হ্যামবার্গারে কামড় বসিয়ে জানতে চাইল রজার।
‘নাহ। আমরাও কোনো সমাধান করতে পারছি না। পারবও না বোধ হয়,’ বিরস বদনে উত্তর দিলেন বাবা।
‘কিন্তু কম্পিউটারটি তো চলছে। ওটার চলার আওয়াজ পেয়েছি আমি।’
‘ও হ্যাঁ, কাজ তো করছেই। সমস্যা একটাই—কম্পিউটারটি সব সময় সঠিক উত্তর দিচ্ছে না।’
রজারের বয়স ১৩। ফোর্থ গ্রেড থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখছে সে। স্কুলেই শেখানো হয়। মাঝেমধ্যে জিনিসটির ওপর তার অরুচি চলে আসে। তখন তার মনে হয়, বিংশ শতাব্দীতে জন্মালে কত না ভালো হতো! ওই সময় বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখতে হতো না। কী মজাই না করত তখন বাচ্চারা! তবে মাঝেসাঝে বাবার সঙ্গে কথা বলে বেশ উপকার হয়।
রজার বলল, ‘প্রশ্নের উত্তরটা যদি শুধু মাল্টিভ্যাকেরই জানা থাকে, তাহলে তোমরা বলছ কী করে যে কম্পিউটারটি সব সময় সঠিক উত্তর দেয় না?’
জবাবে কিছু না বলে স্রেফ কাঁধ ঝাঁকালেন বাবা। মিনিটখানেক চুপচাপ খেল দুজনে। রজারের হঠাৎ ভয় হলো, বাবা হয়তো তার প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। বলবেন, ব্যাপারটা তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝানো খুব কঠিন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না।
বাবা বললেন, ‘সোনামণি, মাল্টিভ্যাকের ব্রেন বড়সড় একটা কারখানার মতো বিশাল হতে পারে। কিন্তু তারপরও এই ব্রেন আমাদের মস্তিষ্কের মতো এত জটিল নয়।’
কথাটা বলে নিজের মাথায় টোকা মেরে দেখালেন বাবা। তারপর বললেন, ‘মাঝেমধ্যে মাল্টিভ্যাক আমাদের এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়, যে উত্তর আমরা হাজার বছর হিসাব করেও বের করতে পারিনি। কিন্তু সেই উত্তর নিয়ে আমাদের মনে কখনো কখনো সন্দেহ জাগে। তখন আমরা আবার মাল্টিভ্যাককে প্রশ্নটা করি। তখন আবার সে সম্পূর্ণ নতুন উত্তর দেয়। ভেবে দেখো, মাল্টিভ্যাক যদি সঠিক উত্তরই দিত, তাহলে আমরা একই প্রশ্নের জন্য সব সময় একই উত্তর পেতাম। এখন যেহেতু একই প্রশ্নের দুটি আলাদা উত্তর পাচ্ছি, তাহলে একটা উত্তর নিশ্চয়ই ভুল।
‘এখন সমস্যা হচ্ছে, আমরা কী করে বুঝব যে মাল্টিভ্যাকের এই ভুল আমরা সব সময় ঠিকমতো ধরতে পারছি কি না? কী করেই–বা জানব যে এর আগেও মাল্টিভ্যাক আমাদের কোনো কোনো প্রশ্নের ভুল উত্তর দেয়নি? দেখা গেল, তার কোনো ভুল উত্তরের ওপর নির্ভর করে আমরা একটা কিছু করে ফেললাম। কিন্তু পাঁচ-দশ বছর পর সেই ভুল উত্তরের কারণে সর্বনাশা কোনো ঘটনা ঘটে গেল। মাল্টিভ্যাকের ভেতরে কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে, কিছু একটা নষ্ট হয়ে গেছে ওর। আর যা-ই নষ্ট হোক না কেন, সেটা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।’
‘দিন দিন আরও খারাপ হবে কেন?’ জিজ্ঞেস
করল রজার।
হ্যামবার্গার শেষ করে বাবা এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছেন একটা একটা করে। খেতে খেতে চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, মাল্টিভ্যাককে বুদ্ধিমান বানানোর পদ্ধতিটা ভুল ছিল আমাদের।’
‘হাহ? কী বলছ?’
‘দেখো রজার, মাল্টিভ্যাক যদি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতো, তাহলে আমরা তার সঙ্গে কথা বলে ঝামেলাটা কোথায় বের করে ফেলতে পারতাম। যত জটিল সমস্যা হোক না কেন, সমাধান বেরিয়ে আসত। আবার কম্পিউটারটি যদি একেবারে সহজ-সরল বোবা যন্ত্র হতো, তাহলে খুব সহজ কিছু ভুল করত। সেসব ভুল আমরা অনায়াসে ধরে ফেলতাম। মুশকিল হচ্ছে, মাল্টিভ্যাক হচ্ছে আধা চালাক। ইডিয়ট টাইপের লোকজনের মতো। ভীষণ জটিল পদ্ধতিতে ভুল করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি আছে তার। কিন্তু ভুলটা কোথায় হচ্ছে, সেটা ধরতে আমাদের সাহায্য করার মতো বুদ্ধি তার ঘটে নেই। এখানেই তার বুদ্ধির ভাঁড়ারে টান পড়ে গেছে।’
খুব বিষণ্ন হয়ে গেছে বাবার চেহারা। তিনি বললেন, ‘কিন্তু এখন আমরা কী করব? ভয়ানক ঝামেলায় পড়ে গেলাম মাল্টিভ্যাককে নিয়ে। তাকে আরও চালাক-চতুর বানানোর উপায় আমরা এখন পর্যন্ত জানি না আরকি। আবার তাকে একেবারে সহজ-সরল বোবা যন্ত্র বানিয়ে ফেলার সাহসও পাচ্ছি না। কারণ, পৃথিবীর সমস্যাগুলো ভীষণ জটিল হয়ে উঠেছে। যেসব প্রশ্ন আসে আমাদের সামনে, সেগুলো ভীষণ জটিল। প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য মাল্টিভ্যাকের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন পড়ে আমাদের। কাজেই বুদ্ধিমত্তা কমিয়ে তাকে সহজ-সরল বোবা যন্ত্র বানিয়ে ফেললে রীতিমতো বিপর্যয় নেমে আসবে।’
‘মাল্টিভ্যাককে বন্ধ করে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারো না, বাবা?’ জানতে চাইল রজার।
‘সেটা সম্ভব নয় সোনামণি,’ বাবা জবাব দিলেন। ‘সমস্যার পাহাড় জমে আছে আমাদের কাঁধে। তাই মাল্টিভ্যাককে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চালু না রেখে উপায় নেই।’
‘কিন্তু বাবা, মাল্টিভ্যাক যদি একের পর এক ভুল করতে থাকে, তাহলে তো শেষতক তাকে বন্ধ করে দিতে হবে, তাই না? তার উত্তর যদি তোমরা আর বিশ্বাস করতে না পারো…’
‘ঠিক আছে,’ রজারের চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন বাবা। ‘সমস্যাটা কোথায়, আমরা খুঁজে বের করব, বুড়ো খোকা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।’ কিন্তু বাবার চোখে চিন্তার ছায়া খেলা করছে তখনো। ‘এবার খেয়ে নাও চটপট। বেরোতে হবে আমাদের।’
‘কিন্তু তার আগে আমার একটা কথা শোনো বাবা,’ রজার বলল। ‘মাল্টিভ্যাক যদি অর্ধেক বুদ্ধিমান হয়, তাহলে সে ইডিয়ট টাইপের হতে যাবে কেন?’
‘তাকে যে আমাদের কীভাবে নির্দেশ দিতে হয়, সেটা যদি জানতে, তাহলে আর এ প্রশ্ন করতে না বাবা।’
‘ওই একই তো কথা হলো বাবা,’ বলল রজার। ‘হয়তো তাকে নির্দেশ দেওয়ার ধরনটা ঠিক নেই। আমি তোমার মতো বুদ্ধিমান নই। তোমার মতো এত কিছু জানিও না। কিন্তু তাই বলে তো আমি আর ইডিয়ট নই। সে রকম মাল্টিভ্যাকও হয়তো ইডিয়ট নয়, সে হয়তো স্রেফ একটা বাচ্চা ছেলের মতো।’
বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন তার কথা শুনে। ‘মজার একটা কথা বলেছ তো। এ দৃষ্টিভঙ্গি দারুণ। কিন্তু তাতে কি আর কোনো তফাত হচ্ছে?’
‘অনেক তফাত হতে পারে,’ রজার বলল। ‘তুমি ইডিয়ট নও বলেই জানো না একটা ইডিয়টের মনে কী চলে। কিন্তু আমি তো বাচ্চা। তাই হয়তো আরেকটা বাচ্চার মনমানসিকতা বুঝতে পারি।’
‘তাই নাকি? তাহলে বলো তো, একটা বাচ্চার মনমানসিকতা কেমন হয়? কী চলে তার মনে?’
‘বেশ, বলছি তাহলে। তুমি বলেছ, মাল্টিভ্যাককে তোমরা দিন-রাত ব্যস্ত রাখো। একটা মেশিন দিন-রাত কাজ করতে পারে, কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু তুমি যদি আমার মতো একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হোমওয়ার্ক করাও, তাহলে সে একসময় ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সে একের পর এক ভুল করতে থাকবে। হয়তো ইচ্ছা করেই ভুলভাল কাজ করবে সে। কাজেই মাল্টিভ্যাককে রোজ দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার সময় দাও না কেন তোমরা? ওই সময়টুকু কোনো সমস্যার সমাধান করতে দেবে না তাকে। সে স্রেফ মনের আনন্দে যা খুশি তা-ই করবে, খুশিতে কলকল করবে।’
বাবার চেহারা দেখে মনে হলো রজারের কথাগুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন তিনি। পকেট–কম্পিউটারটা বের করে কী সব হিসাব মেলাতে শুরু করলেন বাবা। আরও কয়েকবার হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পকেট-কম্পিউটারটা টেপাটেপি করে বললেন, ‘তোমার কথাটা পাথ ইন্টিগ্রালে ফেলে হিসাব করে দেখলাম, তোমার কথায় একধরনের যুক্তি আছে রজার। তবে মাল্টিভ্যাককে ২৪ ঘণ্টার বদলে ২২ ঘণ্টা কাজ করালে বেশি ভালো ফল পাওয়া যাবে—এই ধারণা ভুলও হতে পারে।’
আপনমনে মাথা দোলালেন বাবা। তারপর পকেট-কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নিশ্চিত তো রজার?’ এমনভাবে প্রশ্নটা করলেন তিনি রজারকে, যেন কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত চাইছেন।
হ্যাঁ, রজার আসলেই নিশ্চিত। সে আত্মবিশ্বাস নিয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ বাবা, বাচ্চাদের তো খেলাধুলাও করতে হয় একটু।’