বুমেরাং
গভীর রাত। ইনস্টিটিউট অব জেনেটিকসের ল্যাবরেটরিতে নিজের কাজে মগ্ন তানিয়া রেজা। আকর্ষণীয় চেহারার এই জেনেটিসিস্টের বয়স আটাশ চলছে, কিন্তু এরই মধ্যে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে সে আপন যোগ্যতায়। এ মুহূর্তে একাকী ব্যস্ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে।
সহসা কিছু একটা প্রত্যক্ষ করে চেঁচিয়ে উঠল ‘হুররে!’ বলে।
এর কয়েক মিনিট পর তানিয়াকে দেখা গেল মুঠোফোনের রেকর্ডারে নিজের বক্তব্য রেকর্ড করতে।
‘২০২২ সালের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ আজ। গত ৩ বছরের নিরন্তর গবেষণার পর আজই কাঙ্ক্ষিত জিনটি আলাদা করতে সক্ষম হয়েছি আমি, যেটির কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মায় মানুষের। নারীর জিনোমের এক্স ক্রোমোজোম এবং পুরুষের জিনোমের ওয়াই ক্রোমোজোমে এই জিনের অবস্থান। এর রাসায়নিক সংকেত অ্যাড্রেনালিন-জাতীয় ক্ষরণের জন্য দায়ী, যার কারণে প্রেমে পড়ে মানুষ। রিসার্চের পরবর্তী ধাপে জিন থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হচ্ছে শিগগিরই।’
দুই
ক্যাফে অর্কিড। নিউইয়র্ক শহরের খদ্দেরপ্রিয় এ কফিশপে সমাবেশ ঘটেছে সুরুচিসম্পন্ন নারী-পুরুষের। তাদেরই একজন রিচার্ড এন্ডারসন। ত্রিশে পা দেওয়া সুদর্শন যুবকটিকে সঙ্গ দিচ্ছে অপূর্ব সুন্দরী শ্যামলা এক তরুণী। গাঢ় নীল স্কার্ট আর সাদা টপস মেয়েটির পরনে। কণ্ঠে দক্ষিণি টান।
‘হাই, আমার নাম রিচার্ড।’ চটুল হাসি যুবকের ঠোঁটে।
পাল্টা হাসল তরুণীও। ‘আমার নাম সিনথিয়া।’
নাইস টু মিট ইউ, সিনথিয়া।
নাইস টু মিট ইউ, রিচার্ড।
দক্ষিণের টান আপনার কণ্ঠে। এখানকার নন, অনুমান করি!
ঠিকই ধরেছেন। টেক্সাস থেকে এসেছি আমি।
টেক্সাসের কোথায়?
ছোট্ট শহর ওটা। কামবি।
তা, এখানে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো কারণে?
হ্যাঁ, অভিনয় শেখার স্কুলে ভর্তি হয়েছি। ভালো অভিনেত্রী হওয়া লক্ষ্য আমার।
চমৎকার। এ লাইনে দারুণ সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি আপনার।
ধন্যবাদ। ফুল–চন্দন পড়ুক আপনার মুখে।
কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, ঝড়ের বেগে কফিশপে প্রবেশ করল এক স্বর্ণকেশী তরুণী।
শাণিত দৃষ্টিতে চারপাশটা জরিপ করে নিয়ে সোজা এগিয়ে গেল সে রিচার্ডের দিকে। রাগে থমথম করছে চেহারা।
কাছে আসার আগপর্যন্ত দেখতেই পেল না ওকে সিনথিয়ার সঙ্গে আলাপরত যুবক।
‘আরে, মনিকা! কী অবস্থা তোমার?’ জিজ্ঞেস করল থতমত খেয়ে।
‘রাখো তোমার অবস্থা!’ বিস্ফোরিত হলো স্বর্ণকেশী, ‘সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমি! আসছ না দেখে অনুমান করেছি, এখানে পাওয়া যেতে পারে তোমাকে। ধরেছি হাতেনাতে!’
ওহ হো, দুঃখিত! একদম ভুলে গিয়েছিলাম আমি। জানোই তো, কী রকম ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে।
ত্রিশে পা দেওয়া সুদর্শন যুবকটিকে সঙ্গ দিচ্ছে অপূর্ব সুন্দরী শ্যামলা এক তরুণী। গাঢ় নীল স্কার্ট আর সাদা টপস মেয়েটির পরনে। কণ্ঠে দক্ষিণি টান।
‘ব্যস্ততা, না?’ হিংস্র বাঘিনীর দৃষ্টিতে সিনথিয়াকে দেখছে মনিকা। আবার রিচার্ডের দিকে ফিরে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, ‘গোল্লায় যাও!’
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। তাড়াহুড়া করে এগোতে গিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে বসল এক টেবিলের সঙ্গে। মেঝেতে পড়ে চুরমার হলো একটা সিরামিকের মগ।
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে টেবিলটার দিকে চাইল মনিকা। ‘তুইও গোল্লায় যা!’
মেয়েটি বিদায় নেওয়ার পর কয়েক সেকেন্ডের জন্য অস্বস্তিকর নীরবতা ঝুলে রইল রিচার্ড আর সিনথিয়ার ভেতর। শেষমেশ সিনথিয়াই মুখ খুলল।
‘দুঃখিত, যেতে হচ্ছে আমাকে। অনেক দেরি হয়ে গেছে এর মধ্যে। শুভরাত্রি। ভালো থাকবেন।’
মুখে কথা জোগাল না রিচার্ডের।
তিন
নিজের অ্যাপার্টমেন্টের শোবার ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে আর মুঠোফোনে কথা বলছে রিচার্ড এন্ডারসন।
‘পাঁচটা মিনিট সময় দিতে পারবে আমাকে?’ জিজ্ঞেস করল সে ওপাশের মানুষটিকে।
‘কী হয়েছে, রিচার্ড?’ জানতে চাইল তানিয়া, ‘কেমন যেন শোনাচ্ছে তোমার গলাটা!’
‘তোমার সাহায্য প্রয়োজন আমার। শেষ হয়ে গেছি আমি! অর্থহীন মনে হচ্ছে জীবনটা!’
ফোনের ওপাশে হাসি শোনা গেল তানিয়ার। ‘দেখো, রিচার্ড, আমি একজন জেনেটিসিস্ট, মোটিভেশনাল স্পিকার নই। তা-ও বলো, কী হয়েছে।’
সাক্ষাতে বলব সব।
ঠিক আছে। আগামীকাল অফিসে এসো তাহলে।
থ্যাংক ইউ সো মাচ, তানিয়া। দেখা হবে।
চার
পরদিন বন্ধু তানিয়া রেজার অফিসে ওর ডেস্কের সামনে চামড়ামোড়া আরামকেদারায় বসে আছে রিচার্ড। জিন, ক্রোমোজোম, কোষ আর মানব অঙ্গের বেশ কিছু ছবি ঠাঁই পেয়েছে দেয়ালগুলোয়—দৃশ্যটা বিদঘুটে লাগছে ওর কাছে।
‘হ্যাঁ, বলো এবার, কী হয়েছে।’ তাগাদা দিল তানিয়া।
ভয়ানক ব্যাপার, বুঝলে!
উফ্, আর টেনশনে রেখো না তো! তাড়াতাড়ি খুলে বলো সব।
আম-ছালা দুই-ই গেছে আমার!
মানে?
গত রাতের ঘটনাটা বলল ওকে রিচার্ড। শুনে বিমল হাসিতে ভেঙে পড়ল তানিয়া।
‘হাসছ তুমি?’ বলল যুবক আহত কণ্ঠে।
‘আরে বাবা, তুমিই–বা এত সিরিয়াস হচ্ছ কেন?’ হাসতে হাসতেই প্রশ্ন রাখল তানিয়া।
কী বলো তুমি! সিরিয়াস নয় এটা? এই প্রথম আমার জীবনে ঘটল এ ঘটনা! জঘন্য এ লাইফস্টাইল থেকে বেরিয়ে আসতে চাই আমি। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে চাই কাউকে। বিয়েশাদি করে বাপ হতে চাই বাচ্চাকাচ্চার। অনেক হয়েছে প্রেম প্রেম খেলা।
পরদিন বন্ধু তানিয়া রেজার অফিসে ওর ডেস্কের সামনে চামড়ামোড়া আরামকেদারায় বসে আছে রিচার্ড। জিন, ক্রোমোজোম, কোষ আর মানব অঙ্গের বেশ কিছু ছবি ঠাঁই পেয়েছে দেয়ালগুলোয়।
সত্যিকারে কখনো ভালোবাসোনি কাউকে?
না। সে জন্যই তো চাইছি ওটা।
কিন্তু চাইলেই তো কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারবে না তুমি, যদি না ভালোবাসাটা মন থেকে আসে।
রিচার্ডের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, কেঁদে ফেলবে যেন। ‘কেন এ রকম হলো আমার, তানিয়া? আমিও তো মানুষ, নাকি? আমারও তো মন আছে, আছে হৃদয়…।’
হেসে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করল ওকে তানিয়া। ভাবছে কী যেন। নিচের ঠোঁট কামড়ে দোনোমনা করল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, ‘আমার মনে হয়, সাহায্য করতে পারব তোমাকে।’
ঝট করে চোখ তুলল রিচার্ড।
‘হ্যাঁ।’ বলল তানিয়া, ‘একটা কথা বলছি তোমাকে। এখনো কেউ জানে না ব্যাপারটা।’
বিশ্বাস রাখতে পারো, কাউকেই বলব না আমি।
‘কথাটা হলো, অনুরাগের জিন আইডেন্টিফাই করেছি আমি।’ গলা নামিয়ে বলল তানিয়া, ‘যেটার কারণে ভালোবাসার জন্ম হয় মানুষের ভেতরে।’
তা-ই নাকি? অভিনন্দন! কিন্তু আমার তো ওই জিনই নেই!
আমাদের সবার মধ্যেই এই জিন আছে। দেখতে হবে, তোমারটা কাজ করছে কি না।
‘নিশ্চিত, মরে গেছে আমারটা, যে কারণে ভালোবাসার অস্তিত্ব নেই আমার মধ্যে।’ নীরবতা, ‘ঠিক আছে, বলো, কী করতে হবে আমাকে?’
ছোট্ট একটা টেস্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে আপাতত।
ব্যথা লাগবে না তো?
পিঁপড়ের কামড়ের মতো। খানিকটা রক্ত লাগবে তো!
ব্যস, এ-ই?
হ্যাঁ, আপাতত।
পাঁচ
রিচার্ডের রক্ত নেওয়ার এক সপ্তাহ পর।
বন্ধুর সামনের আর্মচেয়ারে শুকনো মুখে বসে আছে যুবক।
বড় করে দম নিল তানিয়া। ‘তোমার ওয়াই ক্রোমোজোমে সমস্যা পেয়েছি আমরা…।’
আরও পাংশু হলো রিচার্ডের চেহারা। ‘ক্-কী সমস্যা?’
ভয় পেয়ো না। নিরাময়-অযোগ্য কিছু নয় এটা।
কিন্তু সমস্যাটা কী?
দুটো লেটার ভুল জায়গায় রয়েছে তোমার ডিএনএতে।
মানে কী এর?
মানে হচ্ছে, জিনটা যদি বিশেষ কেমিক্যাল উৎপাদন করতে না পারে, কারও প্রতি সত্যিকারের অনুরাগ জন্মাবে না তোমার।
হেসে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করল ওকে তানিয়া। ভাবছে কী যেন। নিচের ঠোঁট কামড়ে দোনোমনা করল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, ‘আমার মনে হয়, সাহায্য করতে পারব তোমাকে।’
‘ওহ…।’ মুষড়ে পড়ল রিচার্ড, ‘কীভাবে ঠিক করবে এটা?’
আছে, উপায় আছে।
কী উপায়?
জিনটা আলাদা করে ত্রুটিপূর্ণ লেটারওয়ালা সেকশনটা মেরামত করতে হবে। এরপর ভাইরাল ভেক্টর বা ভাইরাস ব্যবহার করে হোস্ট সেলে নতুন জিন ঢুকিয়ে দেওয়া।
মাথার ওপর দিয়ে গেল।
খুবই সহজ এটা। পদ্ধতিটা নতুন যদিও। তোমাকে দিয়েই ট্রায়াল শুরু করছি আমরা। সফল হলে পেপার ছাড়ব জেনেটিকস টুডে ম্যাগাজিনে।
কীভাবে বুঝব, কাজ করেছে পদ্ধতিটা?
মিষ্টি হাসল তানিয়া, ‘তোমার মন আর হৃদয়ই জানিয়ে দেবে সেটা।’
ছয়
মাসখানেক পরের কথা।
পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে রিচার্ড আর তানিয়া।
‘হ্যাঁ, বলো…।’ মুখ খুলল বাঙালি জেনেটিসিস্ট, ‘কী যেন বলবে বলছিলে, যেটা নাকি সামনাসামনি ছাড়া বলতে পারবে না!’
‘প্রেমে পড়েছি আমি।’ সসংকোচ স্বীকার করল যুবক, ‘সত্যিকারের প্রেম যাকে বলে!’
সত্যি? কংগ্র্যাচুলেশনস!
থ্-থ্যাংক ইউ…থ্যাংক ইউ!
ট্রায়ালে তাহলে উতরে গেলাম আমরা। তো, কখন টের পেলে এটা?
এক সপ্তাহ আগে।
বলো কী! আরও আগেই জানালে না কেন তাহলে?
আসলে…নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম আমি…সত্যিই ভালোবাসা কি না এটা…।
নিশ্চিত হয়েছ?
হ্যাঁ।
‘ভাগ্যবতীটি কে, জানতে পারি?’ ভ্রু নাচাল তানিয়া।
নড়েচড়ে বসল যুবক। ইতস্তত করছে।
কী, বলতে চাইছ না? না চাইলে অবশ্য...!
তুমি!
কীহ!
‘হ্যাঁ, তুমি।’ তানিয়ার একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরল রিচার্ড, ‘অনুভব করো! বুঝতে পারছ, কেমন পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা? আমার মন আর হৃদয় বলছে, তুমিই আমার ভালোবাসার মানুষ।’