ছয় মিনিট

অলংকরণ: রাকিব

এসব কী বলছেন ম্যাম!’ রীতিমতো চমকে উঠল ফারহান। ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ডা. ফাইরুজ।

‘এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর আসবে না,’ ঠান্ডা গলায় বললেন তিনি।

‘কিন্তু রোগীর যদি কিছু হয়ে যায়?’

‘এই রোগী বাঁচবে না এমনিতেও…’ বড় ব্যাগটা থেকে টেবিল ল্যাম্পের মতো একটা জিনিস বের করতে করতে বললেন ডা. ফাইরুজ।

‘বাঁচার সম্ভাবনা একেবারেই কম…’ একটু থামল ফারহান, ‘প্রায় শূন্যের কাছাকাছি…কিন্তু তারপরও…’

‘সায়েন্স নিডস স্যাক্রিফাইসেস, ডা. ফারহান। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান এমনি এমনি এই পর্যায়ে আসেনি। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর সেখানে এই রোগী তো এমনিতেই মারা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা…লোকটা ফুটপাতে ঘুমিয়ে ছিল। মানে বুঝলে? একেবারেই গরিব…তিন দিন হয়ে গেল এর কোনো আত্মীয়ের দেখাও মিলল না। এর চেয়ে ভালো সাবজেক্ট আর পাব না।’

‘ঠিক যেভাবে পশ্চিমা দেশগুলো আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে ওষুধ পাঠিয়ে কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করে?’

‘তা সে যেভাবেই নাও না কেন। এই সুযোগ ছাড়ছি না।’

বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল ফারহান। সদ্য ডাক্তারি পাস করে বেরিয়েছে সে। এই অভিজাত ক্লিনিকটাতে যোগ দিয়েছে দুই মাস হলো। ডা. ফাইরুজের অধীনেই আছে। সম্ভবত নতুন বলেই তাকে এই ‘বিশেষ’ পরীক্ষণে নিতে চাইছেন ভদ্রমহিলা। অন্য ডাক্তাররা তো রাজি হতোই না, বরং ঝামেলা করে ফেলত।

যে রোগীর ব্যাপারে কথা হচ্ছে, সে এই অভিজাত ক্লিনিকের অন্য রোগীদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এখানে সাধারণত ধনীরা চিকিৎসা নিতে আসে। তিন দিন আগে রাতের বেলা এক কোটিপতি ব্যবসায়ীর ছেলে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকা এই লোকটাকে চাপা দিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন
‘এই রোগী বাঁচবে না এমনিতেও…’ বড় ব্যাগটা থেকে টেবিল ল্যাম্পের মতো একটা জিনিস বের করতে করতে বললেন ডা. ফাইরুজ।

নিজের ছেলেকে বাঁচাতে সব ব্যবস্থাই করেছেন সেই ব্যবসায়ী। সঙ্গে সঙ্গে লোকটার সুচিকিৎসার ব্যাপারটাও দেখছেন। ভর্তি করেছেন এই অভিজাত ক্লিনিকে। এটুকুই–বা এদের জন্য কজন করে?

লোকটার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। বড়জোর আর দুই দিন লাইফ সাপোর্টে বেঁচে থাকবে।

কিন্তু ডা. ফাইরুজ যা বলছেন…ওটা করলে…

‘আচ্ছা ম্যাম,’ প্রশ্ন করল ফারহান, ‘কোনো স্পেসিফিক থিওরির ভিত্তিতে আপনি কাজটা করতে চাইছেন?’

‘উমম, থিওরি একটা আছে। তবে সেটা বেশ বিতর্কিত। আমি জার্মানিতে থাকার সময় বন্ধু ডা. উইলভার অ্যারন ব্যাপারটা বুঝিয়েছিল আমাকে। ওর সঙ্গে মিলেই যন্ত্রটা বানিয়েছি…কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার মতো সাবজেক্ট আর পাইনি…তবে আজ…’

‘একটু খুলে বলবেন ম্যাম?’

‘আচ্ছা শোনো… একদম বেসিক ধারণা থেকে শুরু করি। মৃত্যুর তো দুটো পর্যায়, তাই না?’

‘হ্যাঁ, ক্লিনিক্যাল ডেথ আর বায়োলজিক্যাল ডেথ।’

‘হ্যাঁ, ক্লিনিক্যাল ডেথ পর্যায় শুরু হওয়ার পরের ছয় মিনিট পর্যন্ত মানুষের শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবিত থাকে। ছয় মিনিট পর শুরু হয় বায়োলজিক্যাল ডেথ। মানে আসল মৃত্যু…সবকিছু মরে যেতে থাকে…এই ছয় মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের ডাক্তারদের জন্য। তবে আমি যে থিওরি বলব, তা বর্তমানে মেডিকেল সায়েন্সে পড়ানো হয় না। তুমি ডা. কার্ল হেইনরিখের নাম শুনেছ?’

‘না।’

‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান বাহিনীর এক মহাবিতর্কিত ডাক্তার ছিলেন এই ভদ্রলোক। যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে অমানবিক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন তিনি। ক্লিনিক্যাল ডেথের পরের ছয় মিনিট নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন এবং এটা নাকি বের করেছিলেন যে ওই সময় বিশেষ এক ধরনের রশ্মির মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ককে পরিবর্তিত করা যায়। এই পরিবর্তন একটা সময়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে…মানুষ পরিণত হয় ‘উন্নত’ শ্রেণির এক জীবে। যাদের আচার-আচরণ, চিন্তাধারা, খাদ্যাভ্যাস—সবই আলাদা!’

‘এ আবার কেমন কথা?’

‘তাঁর মতো বিতর্কিত অনেক ডাক্তারই ছিলেন ওই সময়ের জার্মান বাহিনীতে। পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগই আমেরিকাসহ নানা পশ্চিমা দেশে চলে যান। এই ভদ্রলোক সে পথে না গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে আস্তানা গাড়েন। সেকালের সোভিয়েত সরকার লুফে নিয়েছিল তাঁকে। শোনা যায়, তাদের মদদে নিজের এই গবেষণা বেশ খানিকটা এগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু…’

‘কিন্তু কী?’

‘১৯৬০ সালে হুট করেই নিখোঁজ হন এই ভদ্রলোক! তারপর ওনার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। যা–ই হোক, আমার বন্ধু উইলভার অনেক দিন রাশিয়াতে ছিল। কীভাবে যেন ও সেই ডাক্তারের বানানো যন্ত্রের একটা ব্লুপ্রিন্ট জোগাড় করে ফেলে। ওই যন্ত্র দিয়েই সেই বিশেষ রশ্মি নিক্ষেপ করা হয়।’

‘তারপর?’

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান বাহিনীর এক মহাবিতর্কিত ডাক্তার ছিলেন এই ভদ্রলোক। যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে অমানবিক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন তিনি।

‘জার্মানিতে ওর সঙ্গে ভাব হয়েছিল আমার। ওর এক প্রকৌশলী বন্ধুর সাহায্য নিয়ে আমরা যন্ত্রটা বানিয়ে ফেলি। কিন্তু পরীক্ষা আর করা হয়নি। এক বছরের মধ্যে হৃদ্‌রোগে মৃত্যু ঘটল উইলভারের। কয় বছর পর আমিও দেশে ফিরলাম। আসার সময় ওই যন্ত্রটাও সঙ্গে করে নিয়ে আসি…আসলে এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। শোনো ফারহান…আজ রাতে তোমার বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই। ঠিক আছে?’

‘আজই?’

‘হ্যাঁ!’

‘আরেকটু চিন্তা করলে হতো না?’

‘না, গত দুই দিনে আমি অনেক চিন্তা করেছি।’

রাত দুটো বাজে।

চুপচাপ সেই রোগীর কেবিনে দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। মাথার কাছে ছোট্ট যন্ত্রটা বসাচ্ছেন ডা. ফাইরুজ।

লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়েছে লোকটার। ক্লিনিক্যাল ডেথ পর্যায় শুরু হয়ে গেছে নিঃসন্দেহে।

‘হয়ে গেছে,’ এই বলে যন্ত্রটার পেছনের একটা সুইচ টিপে দিলেন ফাইরুজ।

অদ্ভুত বর্ণের এক আলো বেরিয়ে এল সেখান থেকে। অমন রং এর আগে কখনো দেখেনি ফারহান। ওই রং আমাদের পরিচিত পৃথিবীর কোনো রং নয়! এ যেন মহাজগতের অন্ধকারতম কোণ থেকে উঠে আসা এক অজানা বর্ণের আলো।

লোকটার মাথার ওপর পড়ছে সেই আলো…

‘ছয় মিনিট হয়েছে?’ ফিসফিসে কণ্ঠে বললেন ডা. ফাইরুজ, বারবার তাকাচ্ছেন দরজার দিকে। পাছে কেউ এসে না পড়ে।

‘এখনো দুই মিনিট বাকি।’

সময় যেন থমকে গেছে।

হুট করে অদ্ভুত একটা জিনিস খেয়াল করল ফারহান, লোকটার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা যেন নড়ে উঠল!

চোখের ভুল? নাহ্‌…আবার নড়ল।

চোখ খুলে গেল লোকটার! উঠে বসল সে…

‘ও মাই গড,’ লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন ডা. ফাইরুজ।

তখনই ফারহানের নজর পড়ল লোকটার পিঠের দিকে, হিলহিলে শুঁড়ের মতো কী সব যেন বেরিয়ে আসছে ওখান থেকে।

শুধু তা–ই নয়, লোকটার বুকে বেশ বড় একটা ক্ষত ছিল…সেটাও কেমন যেন ফাঁক হচ্ছে…ওখান দিয়েও বেরিয়ে আসছে অসংখ্য শুঁড়…

আরও পড়ুন
অদ্ভুত বর্ণের এক আলো বেরিয়ে এল সেখান থেকে। অমন রং এর আগে কখনো দেখেনি ফারহান। ওই রং আমাদের পরিচিত পৃথিবীর কোনো রং নয়!

২০ বছর পর।

‘এই পুরো এলাকাতে কেউ থাকে না?’ অবাক হয়ে মারিয়াকে জিজ্ঞাসা করল আরিফ।

‘একদম! শুধু কি তা–ই? এলাকার সব কটি প্রবেশপথ আর্মির লোকেরা পাহারা দেয়, যাতে কেউ না ঢোকে। অদ্ভুত ব্যাপার জানো? এই এলাকাটুকুর আকাশে কোনো পাখিও ওড়ে না!’

‘কেন?’

‘সরকারিভাবে জানানো হয়েছিল, ২০ বছর আগে এই এলাকার একটা ক্লিনিক থেকে করোনার বিশেষ এক প্রকার ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে। ওটা এতটাই প্রাণঘাতী ছিল যে আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নাকি মানুষ মারা যেত। তাই পুরো এলাকা সিল করে দেওয়া হয়!’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ, তবে…ওখানে আগে বসবাস করতেন, এমন কিছু মুরব্বি ভিন্ন কথা বলেন!’

‘কী বলেন?’

‘ওনারা বলেন, ২০ বছর আগে নাকি ওখানে অদ্ভুত এক দানবের আবির্ভাব হয়েছিল! জিনিসটা দেখতে মানুষের মতোই, কিন্তু শরীরে অসংখ্য শুঁড়! যারা মারা গিয়েছিল, তারা নাকি ওর কারণেই মরেছিল…মানুষ, কুকুর, বিড়াল—কিছুই ছাড়েনি দানবটা! কাঁচা খেয়ে ফেলত নাকি…তবে এসবের কোনো প্রমাণ নেই।’

‘এ তো দেখি পুরো ‘রেসিডেন্ট এভিল’ গেম সিরিজের কাহিনি! এই শহরের বুকে এমন এলাকা আছে, জানা ছিল না! একদিন ওখানে ঢুকতে পারলে হতো, কী বলো?’

‘বাপ রে বাপ! কে ঢুকবে?’

‘কেন? কিসের ভয়? দানবটা এখনো আছে নাকি?’

‘ওই এলাকা থেকে নাকি রাতে অদ্ভুত সব শব্দ পাওয়া যায়…’

‘কোনো রহস্য তো আছেই!’

‘কিছু রহস্য সমাধান না হওয়াই ভালো।’

আরও পড়ুন
ওনারা বলেন, ২০ বছর আগে নাকি ওখানে অদ্ভুত এক দানবের আবির্ভাব হয়েছিল! জিনিসটা দেখতে মানুষের মতোই, কিন্তু শরীরে অসংখ্য শুঁড়! যারা মারা গিয়েছিল, তারা নাকি ওর কারণেই মরেছিল…

বেশ কয় দিন ধরেই গলিটার দিকে খেয়াল রাখছে আরিফ। ওই এলাকাতে ঢোকার যতগুলো প্রবেশপথ আছে, তার মধ্যে এই গলিটাতেই পাহারা সবচেয়ে কম। মাত্র দুজন সৈনিক থাকে।

আজ দুজনই খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল। এক দৌড়ে ঢুকে পড়লে কেউই খেয়াল করবে না!

তা–ই করল সে।

‘পোলাডা ভেতরে গেল, তাই না?’ মৃদু হাসল প্রথম সৈন্য।

‘হ, বলসিলাম না?’ পাল্টা হাসি দিল দ্বিতীয় সৈনিক।

‘দরকার আছে, প্রতি মাসেই এভাবে এক-দুজন ঢোকে, এই কারণেই...ওইডা বাইরে আসে না, আমার মনে হয়! বিড়াল-কুকুর কিন্তু ঢোকে না। অরা বুঝতে পারে, কিন্তু মানুষ...যা–ই হোক, খাওনের দরকার সবারই আছে। কী বলেন?’

‘সেটাই। পোলাডার বয়স অল্প, এই কারণেই খারাপ লাগতেসে।’

‘কিছু করার নাই আর, তয় আজ পর্যন্ত বেশ আগ্রহ দেখাইতে গিয়া যত মানুষ ঢুকসে, এই গলি দিয়াই ঢুকসে। আমরা সবই খেয়াল করি! আমাদের আগে যারা ডিউটিতে থাকত, তারাও খেয়াল করত। কম মানুষ তো আর ঢুকল না…মানুষের কৌতূহল অনেক বেশি!’

*লেখাটি ২০২২ সালের বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন