আকাশের ওপারে আকাশ

আবার সেই একই স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন।

উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি লাইব্রেরিটার ভেতরে। এ এক মহাজাগতিক গোলকধাঁধা। একের পর এক সরু গলি। কোথাও সরলরৈখিক, কোথাও গোলাকার। কোন গলিটা যে কোথায় গিয়ে মিশেছে, কোনো দিক-ঠিকানা নেই। প্রতিটি গলির দুপাশে থরে-বিথরে আলমারি রাখা। এর মধ্যেই আমি উদ্‌ভ্রান্তের মতো খুঁজে ফিরছি এক টুকরা কাগজ। আমার মায়ের চিঠি। নামের আদ্যক্ষর, সময়কাল, কোথাকার অধিবাসী ইত্যাদি নানা তথ্যে ক্রমান্বয়ে সাজানো আছে লাইব্রেরিটা। বিভিন্ন ভাষার নানা বর্ণ বড় করে লেখা আছে প্রতিটি আলমারির গায়ে। সব আছে, কিন্তু বাংলা খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই।

সরু একটা গলির শেষ মাথায় এসে থমকে গেলাম। আর যাওয়ার পথ নেই। কানাগলি। ভেবেছিলাম, এখান দিয়ে অন্য কোনো গলিতে গিয়ে বেরোতে পারব। হলো না। শেষ প্রান্তের আলমারি দুটোর ওপরে বড় করে লেখা অদ্ভুত কোনো ভাষার এক বর্ণ। চিনতে পারলাম না।

ফিরব কীভাবে? কে যেন মাথার ভেতরে বলছে, দৌড়াও! সর্বশক্তিতে। সময় ফুরিয়ে আসছে। এক্ষুনি, ছুট দাও! দূর থেকে মনে হচ্ছে গলির যে মাথা দিয়ে ঢুকেছি, ওটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছুট দিলাম প্রাণপণে। ছুটছি…ছুটছি…

এর মধ্যেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মাথার ওপরে বহুদিনের পুরোনো ফ্যান ঘ্যাড় ঘ্যাড় করে ঘুরছে। বুকের ভেতরে লাফাচ্ছে পাগলা ঘোড়া। গলা শুকিয়ে কাঠ।

উঠে বসলাম। নাহ্‌, এভাবে হচ্ছে না।

দুই

কম্পিউটারের স্টার্ট বাটনটা চাপ দিতেই মনিটরে জ্বলজ্বল করে উঠল পৃথিবীর মানচিত্রটা। রাতে স্লিপ মোডে দিয়ে শুয়েছিলাম। এখন ঘুম ভেঙেই যন্ত্রটা আমাকে নিজের অবস্থান ও সময় স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে। ১৬ জুন, ২০৫৪ সাল। বঙ্গ স্টেট, ইউনাইটেড গন্ডোয়ানাল্যান্ড।

পুরো পৃথিবীতে এখন মাত্র দুটি রাষ্ট্র। কে জানত, ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তার জের ধরে পুরো পৃথিবী দুভাগ হয়ে যাবে? আস্ত একটা বিশ্বযুদ্ধ, টাকার দরপতন থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির ধাঁ ধাঁ উত্থান আর দেশের সীমানা বিলীন হয়ে গিয়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠিত হওয়া—২০২৬ সালের মধ্যে রাতারাতি বদলে গেল পুরো পৃথিবী। আগে যে অংশগুলো ছিল ইউরোপ আর আমেরিকা, এখন সেটার নাম হয়ে গেছে ইউনাইটেড লরেশিয়া। আর এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়া মিলে হয়ে গেছে ইউনাইটেড গন্ডোয়ানাল্যান্ড। মানুষ যেন একলাফে ফিরে গেছে কয়েক কোটি বছর অতীতে!

মাথায় বারবার ঘুরেফিরে আসছে লাইব্রেরিটা। গত কয়েক দিন বারবার একই দুঃস্বপ্ন দেখছি ঘুমে। আমার মায়ের চিঠিটির খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছি লাইব্রেরি নামের ওই গোলকধাঁধায়।

কম্পিউটারের হোমস্ক্রিনের নিচের ডান কোনায় দেখা যাচ্ছে তারিখ ও অবস্থান। অল্প কয়েকটি সফটওয়্যার আর একটা ব্রাউজারের আইকন দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনজুড়ে। এখন সবকিছুই হয় ক্লাউডে। সরকার অনুমোদিত কিছু সফটওয়্যারই খালি ব্যবহার করা যায়। ব্রাউজার ওপেন করে অ্যাকসেস করা যায় ক্লাউড সার্ভার। ওয়েবসাইটে কাজ দেওয়া থাকে। প্রত্যেকের দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট কাজ করা যায়। কাজ সম্পন্ন হলে পেমেন্ট চলে আসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। খাবার বা প্রয়োজনীয় কিছু কেনার কাজও অনলাইনে। নির্দিষ্ট পণ্য বেছে অর্ডার করলেই হয়। চলে আসে দোরগোড়ায়। প্রায় এ রকম একটি পৃথিবীর কথা কল্পনা করেছিলেন চৈনিক লেখক মা বয়ং। তাঁর ‘দ্য সিটি অব সাইলেন্স’ গল্পটির প্রেক্ষাপট ছিল ২০৪৬ সাল। কে জানত, তার কল্পনা আসলেই বাস্তব রূপ নেবে?

ব্রাউজারে ক্লিক করেই মনে হলো, এখন থাকুক। কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। রাতে ঘুম হয়নি। একটু বাইরে গিয়ে ঘুরে এলে ভালো লাগবে। ব্যাংকে টাকাপয়সা কিছু জমা আছে। মাসটা টেনেটুনে চলে যাবে।

একসময় এই দেশটির নাম ছিল বাংলাদেশ। আমি যে এলাকায় থাকি, তার নাম ছিল মোহাম্মদপুর, কাদেরাবাদ হাউজিং। ছোটবেলার সেসব স্মৃতি এখনো মনে আছে। বাবার সঙ্গে হাউজিংয়ের এই রাস্তা ধরে কত হেঁটে গেছি। রাস্তাটা গিয়ে উঠেছে তৎকালীন বেড়িবাঁধে। এলাকাটার নাম ছিল বোটঘাট। একটু পূর্ব দিকে এগোলেই রায়েরবাজার বধ্যভূমি। এখন ওর পাশে বিশাল কবরস্থান। মোহাম্মদপুর থেকে একটা মেট্রোরেললাইন এসেছে এদিকে। একটু পরপর শাঁ শাঁ করে ছুটে যায় বিদ্যুৎ–চালিত ট্রেন।

ওদিকেই যাওয়া যাক। স্মার্ট মোবোওয়াচটা হাতে পরে নিলাম। এই ঘড়িতেই এখন যোগাযোগ করা যায় সবার সঙ্গে। ইন্টারনেট ব্রাউজ করা যায়। ওয়ান–স্টপ সলিউশন। ইয়ারবাডটা গুঁজে দিলাম কানে। তারপর কী মনে করে বাবার এমপিডিটা পকেটে পুরে নিলাম। বাসা থেকে বেরিয়ে পা বাড়ালাম আগেকার বোটঘাট, অর্থাৎ বর্তমান গ্রেভইয়ার্ড সাইটের দিকে।

মাথায় বারবার ঘুরেফিরে আসছে লাইব্রেরিটা। গত কয়েক দিন বারবার একই দুঃস্বপ্ন দেখছি ঘুমে। আমার মায়ের চিঠিটির খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছি লাইব্রেরি নামের ওই গোলকধাঁধায়। অথচ ও জিনিস বাস্তবে আমি কখনো দেখিনি। কক্ষনো না।

আমার বয়স যখন আট, তখন আমার মা ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখনো ক্যানসারের তেমন কোনো চিকিৎসা ছিল না। পরের বছর, ২০২২ সালে ক্যানসারের নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। ডস্টারলিম্যাব। আর এখন তো যে কেউ মাস তিনেক ওষুধ খেয়েই দিব্যি সুস্থ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসা বলতে তখন ছিল কেবল কেমোথেরাপি। আমাদের মতো দরিদ্রদের পক্ষে এত ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া আম্মুর যখন ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন তিনি চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ে ছিলেন। ফুসফুসে পানি চলে এসেছিল। আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালের ডাক্তারেরা দেখে একবাক্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সম্ভব নয়। তাঁদের আর কিছু করার নেই। আমরা চাইলে তাঁরা থেরাপি দিয়ে দেখতে পারেন। কিন্তু তাতে মায়ের কষ্ট বাড়বে, কমবে না। তার চেয়ে কিছু ওষুধ দিয়ে যথাসম্ভব কম কষ্ট পেয়ে যেন বাকি দিনগুলো কাটিয়ে যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তাঁরা।

মৃত্যুর চার দিন আগে আম্মু আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বিশেষ কিছু না। নিজের যেন যত্ন নিই, আব্বুর দিকে যেন খেয়াল রাখি, মন খারাপ করে যেন বসে না থাকি ইত্যাদি।

আম্মুর মৃত্যুর পরে আব্বু কেমন অন্য রকম হয়ে গেলেন। ভাইবোন ছিল না আমার। সারা দিন বাসায় কাটত একাকী। আব্বু সারা দিন কাটাতেন প্রাইভেট একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে। প্রায় চার বছর গবেষণার পর আব্বুর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সোসাইটিতে। দিনটি ছিল ২২ আগস্ট, ২০২৫। রজার পেনরোজ প্রস্তাবিত ‘কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজি’র পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণ হাজির করেন তিনি এই গবেষণাপত্রে।২ পেনরোজের প্রস্তাবটি এর আগে কেউ সিরিয়াসলি নেননি। আব্বু হিসাব-নিকাশ কষে ও ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে দেখান, শুনতে যতই অদ্ভুত শোনাক, পেনরোজের প্রস্তাবটি বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

পেনরোজ দাবি করেন, আমাদের মহাবিশ্বটা ধীরে ধীরে পরবর্তী বিগ ব্যাংয়ের দিকে এগোচ্ছে। কীভাবে? আমরা জানি, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে। এটি নিয়মিত প্রসারিত হচ্ছে। পেনরোজের দাবি, মহাবিশ্ব এভাবে যত প্রসারিত হবে, এর এনট্রপি তত বাড়তে থাকবে। আর মহাবিশ্বের ভেতরের সব পদার্থ এবং সবটা শক্তি গিলে নিতে থাকবে কৃষ্ণগহ্বরগুলো। একসময় শুধু কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া আর কিছু থাকবে না। তখন কৃষ্ণগহ্বরগুলো একে অন্যকে গিলে নিতে শুরু করবে। সবশেষে যে বিশাল কৃষ্ণগহ্বরটি গিলে নেবে বাকি সব, মহাবিশ্বের সব পদার্থ, সবটুকু শক্তি জমা হবে এর কেন্দ্রের একটি বিন্দু, অর্থাৎ সিঙ্গুলারিটিতে।

কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর শুধু পদার্থ গিলেই নেয় না, হকিং বিকিরণ বা বাষ্পায়নের ফলে এ থেকে বিভিন্ন পদার্থ বেরিয়ে আসে শক্তি আকারে। মহাবিশ্বের সবটা শক্তি এক বিন্দুতে জমা। ভয়ংকর এনট্রপি। এ সময় কৃষ্ণগহ্বর একসঙ্গে উগরে দেবে সব। ফলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। মহাবিস্ফোরণ। বিগ ব্যাং!

আগের কোনো এক মহাবিশ্বের এ রকমই এক অবশেষ কৃষ্ণগহ্বরের প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম। কিন্তু তাঁর তত্ত্বমতে, এই বিস্ফোরণের অবশেষ, হালকা উষ্ণ কিছু অঞ্চল আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা। এই অঞ্চলগুলোর পরিধি হবে চাঁদের আট গুণের মতো। পেনরোজ অবশ্য তার গবেষণাপত্রে এই অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করতে পারেননি। কিন্তু তিনি এদের নাম দিয়েছেন ‘হকিং বিন্দু’।

আমার বাবা হিসাব কষে এবং ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে দেখান, আমরা আসলে এই হকিং বিন্দুগুলো দেখতে পাই। এ রকম ছয়টি পয়েন্ট প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বা ছবিগুলোতেও দেখা যায়।

পেনরোজ এ গবেষণাপত্র দেখে নিজে বাবাকে মেইল করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এটা আমার হাইপোথিসিসের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রমাণ বলে আমি মনে করি। এই সিগন্যালগুলো যে র৵ান্ডম কিছু নয়, এ ব্যাপারে আমরা ৯৯.৯৮ শতাংশের মতো নিশ্চিত। এগুলোই আমাদের আগের মহাবিশ্বের কৃষ্ণগহ্বরের অবশেষ।’

এমপিডি নামের এই যন্ত্রটা আমি যত্ন করে সামলে রেখেছি। কিন্তু এটা কীভাবে কাজ করে, আমি জানি না। বিজ্ঞান নিয়ে আমার খুব বেশি জানাশোনা নেই। যদিও বাবার পথ অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স করেছিলাম।

এর কিছুদিনের মধ্যেই বাবা পেনরোজের সঙ্গে যুগ্মভাবে গবেষণার আমন্ত্রণ পান। সেই যে তিনি আমাকে রেখে গিয়েছেন, আর ফেরেননি। বেঁচে থাকতে প্রতি মাসে অবশ্য কাকে দিয়ে যেন কিছু টাকা পাঠাতেন আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। কাকে দিয়ে পাঠাতেন, কীভাবে করতেন, আমি জানি না। কিন্তু কাজটা নিশ্চয়ই যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। কারণ, লরেশিয়ার মুদ্রা গন্ডোয়ানাল্যান্ডে অচল। যা-ই হোক, খেয়ে-পরে ভালোই চলে যেত আমার ও দিয়ে। আর, এই পুরোটা সময় আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিল আম্মুর চিঠিটি।

মাসখানেক আগে আব্বু মারা গেছেন। কোনো রোগে ভুগে নয়, স্বাভাবিকভাবেই। আচমকা। তার এক সহকর্মী আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন বিষয়টা। ফোনটা দিতে তাঁকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বাবা থাকতেন ইউনাইটেড লরেশিয়ায়। আমি গন্ডোয়ানাল্যান্ডের মানুষ। সরকার নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগব্যবস্থায় ও দেশ থেকে সাধারণত এখানে কাউকে ফোন করতে দেওয়া হয় না। ভদ্রলোক শুধু ফোন দিয়েই থেমে যাননি, বাবার উইল অনুযায়ী রেখে যাওয়া সব একটা বাক্সে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমার কাছে। সেই সঙ্গে বাবার অ্যাকাউন্টে জমা একটা বড় অঙ্কের অর্থও আমার পাওয়ার কথা। সমস্যা হলো, লরেশিয়ান সেই অর্থ আমার এখানে কোনো কাজে আসবে না। তাই তাঁকে বলেছি, আপাতত থাকুক। পরে কখনো আমি পারলে যোগাযোগ করব।

বাবার সেই বাক্সে একগাদা কাগজপত্রের সঙ্গে কিছু কাপড়চোপড়, আমাদের একটি পারিবারিক ছবি এবং এমপিডি নামের সেই যন্ত্রটা আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। যন্ত্রটির পেছনে একটা কাগজে ছোট্ট করে লেখা, ‘রাহাত, এই এমপিডিটা সামলে রেখো। কোনো দিন হয়তো এটা তোমাকে মহাবিশ্বের চেয়ে বড় কোনো জগতের রাস্তা দেখিয়ে দেবে।’

এমপিডি নামের এই যন্ত্রটা আমি যত্ন করে সামলে রেখেছি। কিন্তু এটা কীভাবে কাজ করে, আমি জানি না। বিজ্ঞান নিয়ে আমার খুব বেশি জানাশোনা নেই। যদিও বাবার পথ অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স করেছিলাম। পরে অবশ্য পেটের তাড়নায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছি। এখন সরকারি বিভিন্ন সার্ভারের নানা রকম সমস্যা সারিয়ে আমার দিন কাটে। আর মাঝেমধ্যে যখন মন খারাপ হয়ে যায়, তখন আম্মুর চিঠিটার অভাব খুব অনুভব করি। কীভাবে যে হারিয়ে গেল চিঠিটা। এ রকম সময়ে আমি এই এমপিডি এবং স্মার্ট মোবোওয়াচটা হাতে পরে হাঁটতে বেরোই। পথে পথে ঘুরিফিরি। গান শুনি। আর মনে মনে অপেক্ষা করি, যন্ত্রটা কোনো দিন হয়তো আমাকে আসলেই মহাবিশ্বের চেয়ে বড় কোনো জগতে পৌঁছে দেবে। হোক সেটা মৃত্যুর পরে, কী আসে যায়?

আরও পড়ুন
অলংকরণ: আরাফাত করিম

তিন

গ্রেভইয়ার্ড সাইটের এখানে, রায়েরবাজার বধ্যভূমির পাশেই একটি পুরোনো বাসা। দেখে মনে হয়, টোকা দিলেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে। বাসাটির কোনো বিশেষত্ব নেই। এমনিতে আমি পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হলো। বাবার এমপিডিটা বিপ বিপ করে উঠল হঠাৎ।

ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গেলাম। পকেট থেকে বের করতেই দেখলাম, সেই ছোটবেলায় দেখা আর্কেড গেমের মতো একটা হলুদ ডিসপ্লে জ্বলজ্বল করছে যন্ত্রটার চার ইঞ্চি স্ক্রিনে। স্নেক গেমের সাপের মতো ডট ডট দিয়ে তৈরি একটা রেখা কম্পাসের কাঁটার মতো ইঙ্গিত করছে ভাঙাচোরা বাসাটার দিকে। যন্ত্রটা ঘোরালেই কাঁটাটা নড়েচড়ে আবার বাসাটার দিকেই ফিরে যাচ্ছে। তার মানে কী, জিনিসটা একটা কম্পাস? কিন্তু কী দেখাচ্ছে?

বিষয়টা বোঝা দরকার। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম ভাঙাচোরা বাসাটার দিকে। কোনো গেটও নেই সামনে। দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকতেই ডানে একটা টেবিল। পেছনে একটা চেয়ার। চেয়ারের পেছনে তাকাতেই দেখলাম, একটা সবুজ সাইনবোর্ড—রশীদ উদ্দীন স্মৃতি পাঠাগার। মানে লাইব্রেরি! অবাক চোখে রুমের উল্টো পাশে তাকালাম। একটা বইও নেই ঘরটায়। টেবিল বরাবর মাথার ওপরে একটা ফ্যান। বাঁয়ে এবং দরজা বরাবর ওপাশে সাদা দেয়াল। ওপাশের দেয়ালটা টেবিলের পেছনের দেয়াল, অর্থাৎ ডানের দেয়াল থেকে এক হাত সামনে এসে থেমে গেছে। এই সরু জায়গাটাই নিশ্চয় ভেতরে যাওয়ার পথ।

ভেতরে ঢুকব? কেউ কি আছে এই মরার লাইব্রেরিতে? আজকাল তো কেউ বই পড়ে না। বই নামের কিছুর আসলে অস্তিত্বই নেই। প্রয়োজনীয় প্রায় সব বই বা ডকুমেন্ট পাওয়া যায় সরকারের ‘ইউনাইটেড লাইব্রেরি’, অর্থাৎ ই-লাইব্রেরিতে।

কৌতূহলের জয় হলো। যদিও দুঃস্বপ্নের লাইব্রেরিটাও একবার উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। হাতের তালুতে চেপে রাখা এমপিডিটার স্ক্রিন দেখে নিলাম একবার সাবধানে। এখনো জ্বলছে। দাগটা নির্দেশ করছে ভেতরের দিকেই। যাওয়া যাক তাহলে।

ভেতরে ঢুকে অবাক হলাম। যদিও অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। এসেছি পাঠাগারে, বই তো থাকবেই। কিন্তু এত বই এ দেশে এখনো আছে, তা–ও আবার আমার হাতের এত কাছে, অবাক না হয়ে উপায় কী! থরে থরে আলমারিভর্তি বই আর বই। রুমটাও দেখে অবাক হলাম। দৈর্ঘ্যে বিশাল রুমটির সঙ্গে সামনের ছোট রুমটির কোনো সম্পর্ক আছে, বিশ্বাসই হতে চায় না। আলমারির ওপরে কাগজে বড় করে লেখা আছে, কোনটিতে কী ঘরানার বই রাখা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সাহিত্য, ইতিহাস আরও কত–কী!

অবাক চোখে হেঁটে দেখছি। আশপাশে কেউ নেই। মনে হচ্ছে ভিন্ন কোনো জগতে চলে এসেছি। মাঝেমধ্যে থেমে অবশ্য হাতের যন্ত্রটায় চোখ বুলিয়ে নিতে ভুলছি না।

বাবা দাবি করেছেন, মহাবিশ্বের আকার যে গোল, বিষয়টি আমরা জানি। বহু মহাবিশ্বের ধারণা এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। কিন্তু এর পক্ষে গাণিতিক যুক্তিগুলো বেশ শক্তিশালী।

হাঁটতে হাঁটতে একদম শেষ মাথায় চলে এলাম। শেষ চমকটা এখানেই ছিল। বয়স্ক একজন মানুষ। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা। ডুবে গেছেন বইয়ের জগতে। মানুষটিকে দূর থেকে দেখতে পাইনি। কত বড় লাইব্রেরি, ভেবে অবাক হলাম আবারও। ইনিই কি লাইব্রেরিয়ান? জিজ্ঞেস করার ইচ্ছাটাকে মাটিচাপা দিলাম। ওনার বই পড়ায় বাদ সাধতে ইচ্ছা করছে না।

বোকার মতো ঘুরে বেড়ালাম আরও কিছুক্ষণ। তারপর বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এলাম। এর মধ্যেই যন্ত্রটা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও চালু করতে পারলাম না। জিনিসটা যে কী ইঙ্গিত করল, আবার কেন নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেল, কিছুই বুঝলাম না।

এত বুঝে কাজ নেই। এক দিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। আর না। বাসার দিকে পা বাড়ালাম। খিদে লেগে গেছে। ফ্রিজে একটা পিৎজা আছে, গরম করে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। রাতের ঘুমটা উশুল করা দরকার।

চার  

২৮ জুলাই ১৯৫৪। 

অনেক দিন পর রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল বাবার জিনিসপত্রের বাক্সটা। ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। সময় কত সহজে সব ভুলিয়ে দেয়!

কাগজপত্রগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হঠাৎ একটা কাগজে চোখ আটকে গেল। শিরোনামে বড় করে বাংলায় লেখা, মাল্টিভার্সাল পোর্টাল ডিটেকশন উইথ ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স। এতগুলো ইংরেজি কাগজের মধ্যে এটা বাংলায় কেন লেখা, ভেবে একটু অবাক লাগল। শব্দগুলো আবার ইংরেজি।

লেখাটা পড়তে গিয়ে টের পেলাম, মাথার ভেতরে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। খটমটে সব বৈজ্ঞানিক শব্দ বাবা বাংলায় লিখে রেখেছেন। অথচ শব্দগুলো সব ইংরেজি।

বাবা দাবি করেছেন, মহাবিশ্বের আকার যে গোল, বিষয়টি আমরা জানি। বহু মহাবিশ্বের ধারণা এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। কিন্তু এর পক্ষে গাণিতিক যুক্তিগুলো বেশ শক্তিশালী। অপরিচিত বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম লিখে, তাঁদের বেশ কিছু গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

তারপর দাবি করেছেন, অনেকগুলো গোলাকার জিনিস পাশাপাশি থাকলে, প্রতিটি গোলক বাকিগুলো থেকে বহু দূরে থাকবে, গাণিতিকভাবে এ রকম হাইপোথিসিস কেমন যেন বিচ্ছিন্ন। তার চেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়, সুন্দর ও গাণিতিক হাইপোথিসিস হতে পারে, গোলকগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি ধাক্কা খাবে, একটি আরেকটির ওপরে এসে পড়বে। মহাকাশের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। গ্যালাক্সিগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ধাক্কা খায়। প্রতিটি নক্ষত্র ঘুরতে ঘুরতে ছুটে যাচ্ছে তার পাশের গ্রহের দিকে। মহাবিশ্বগুলোর জন্যও এ কথা সত্যি।

এ পর্যায়ে এসে বাবা একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন। ২০১০ সালে বিজ্ঞানী স্টিফেন এম ফিনি উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রোপি প্রোবের (WMAP) তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি আমাদের মহাবিশ্ব নিকট অতীতে অন্যান্য মহাবিশ্বের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।৪

কিন্তু দুটি মহাবিশ্ব পরস্পর ধাক্কা খেলে, একটি আরেকটির গায়ের ওপর এসে পড়লে আমরা সেটা টের পাই না কেন? এর উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন এম তত্ত্বের কথা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বগুলোর মাত্রা হবে ১০-১১টির মতো। আমরা মোটে চারটি মাত্রার দেখা পাই। বাকিগুলো কুঁচকে আছে খুব ছোট পরিসরে। সে ক্ষেত্রে একটি মহাবিশ্ব আরেকটির গায়ে ধাক্কা খাওয়ার সময় ভিন্নমাত্রায় ধাক্কা খায়। সে জন্য একটির কিছু অংশ আরেকটির ভেতর দিয়ে চলে গেলেও আমরা টের পাই না। এটা একটা সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে।

বাবা দাবি করেছেন, আরেকটি বিষয় এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। পৃথিবীর যেমন মহাকর্ষীয় সীমানা আছে, এই সীমানায় পৃথিবী তার ওপরের সবকিছুকে ধরে রাখে; একই জিনিস অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। ঠিক সে রকম প্রতিটি মহাবিশ্বেরও সীমানা আছে। কিন্তু এই সীমানা শুধু মহাকর্ষীয় সীমানা নয়, ভিন্ন কোনো ধরনের ফোর্স ফিল্ড। বায়ুমণ্ডল যেমন পৃথিবীর বাইরের সবকিছু থেকে পৃথিবীর সব জীবকে রক্ষা করে, তেমনি এই সীমানা রক্ষা করে মহাবিশ্বকে। তবে এই বলের প্রকৃতি কেমন, সে বিষয়ে বাবা কিছু লেখেননি। তিনি শুধু লিখেছেন, এই বলের কারণেই মহাবিশ্বের পদার্থ ও ভরের পরিমাণ নির্দিষ্ট বা সংরক্ষিত। কারণ, এই বল বাইরে থেকে কোনো কিছুকে মহাবিশ্বের ভেতরে ঢুকতে দেয় না। বরং একটি মহাবিশ্ব তার এই সীমানার মধ্যেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে, তার সব পদার্থ ও শক্তি গিলে নেয় মহাবিশ্বটির ভেতরের কৃষ্ণগহ্বর। তারপর সেটি যখন সব উগরে দেয়, বিগ ব্যাং ঘটে ও নতুন মহাবিশ্ব তৈরি হয়। এই সীমানা না থাকলে বিগ ব্যাংয়ের সময় সবটুকু পদার্থ ও শক্তি ছড়িয়ে যেত সীমানার বাইরে, হয়তো চলে যেত অন্য কোনো মহাবিশ্বে। তাতে পুরো সিস্টেমটার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেত।

বাবার ধারণা, প্রতিটি মহাবিশ্বের বাইরের সীমানা, অর্থাৎ এই ফোর্সফিল্ডগুলো একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে কাঁপছে। অর্থাৎ প্রতিটি মহাবিশ্বের ফোর্সফিল্ডের তরঙ্গদৈর্ঘ্য, কম্পাঙ্ক ইত্যাদি সব এক। সে কারণে দুটি মহাবিশ্বের মধ্যে যখন সংঘর্ষ হয়, যে বিন্দুতে এরা একটি আরেকটির সঙ্গে ধাক্কা খায়, সে বিন্দুতে একই কম্পাঙ্কের তরঙ্গ বিপরীত দশায় থাকে। তাই তারা একটি আরেকটির প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। ফলে দুটি মহাবিশ্বের কোনোটিতেই বিষয়টি আলাদাভাবে বোঝা যায় না। তা ছাড়া মহাবিশ্বগুলোর মাঝের বেশির ভাগটা ফাঁকা। দুটি গ্যালাক্সি যেমন অনেক সময় একটি আরেকটির মধ্য দিয়ে চলে গেলেও এর ভেতরের জিনিসগুলো ধাক্কা খায় না, খানিকটা সে রকমই হয় এ সময় দুটি মহাবিশ্বের মধ্যে।

আরও পড়ুন
আমি সামান্য মানুষ। কোনো বিজ্ঞানী নই। পদার্থবিজ্ঞান পড়েছি পড়ার জন্য। বোঝার চেষ্টা তেমন করিনি। ডিগ্রি অর্জনের জন্য অত দরকারও পড়ে না। সেই আমি এসব কিসের ভেতরে এসে পড়লাম?

কিন্তু ঠিক যে বিন্দুগুলোতে মহাবিশ্ব দুটি ধাক্কা খায়, মূলত সে বিন্দুগুলোতে একটা পোর্টালের মতো খুলে যাওয়ার কথা। ফোর্সফিল্ড নিষ্ক্রিয়। তার মানে, এ পোর্টালগুলো ব্যবহার করে কেউ চাইলে আরেকটি মহাবিশ্বে চলে যেতে পারবে।

এ জায়গায় এসে একটা শব্দে চোখ আটকে গেল আমার। মাল্টিভার্সাল পোর্টাল ডিটেক্টর (এমপিডি) যন্ত্রটি দিয়ে এই পোর্টালগুলো শনাক্ত করা সম্ভব।

মানে কী! আমার টেবিলের ওপরে রাখা ৪ ইঞ্চি ওই যন্ত্র একটা মাল্টিভার্সাল পোর্টাল ডিটেক্টর? ওটা দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করা সম্ভব?

মাসখানেক আগের ঘটনাটার কথা পড়ে গেল আমার। মনে পড়ে গেল, গত এক মাসে আরও অনেকবার আমি সেই অদ্ভুত লাইব্রেরিটা দেখেছি। স্বপ্নে বা দুঃস্বপ্নে। পা ছড়িয়ে মেঝেতেই বসে পড়লাম।

আসলেও সম্ভব? কীভাবে!

পাঁচ

দ্রুত কাপড়চোপড় পরে প্রস্তুত হলাম। মোবোওয়াচটা হাতেই আছে। এমপিডিটা নিয়ে একরকম ছুট দিলাম গ্রেভইয়ার্ড সাইটের দিকে। 

দূর থেকেই দেখতে পেলাম, বাড়িটা আগের মতোই আছে। কাছাকাছি আসতেই এমপিডির স্ক্রিনটা জ্বলে উঠল। বিপ বিপ শব্দ শোনা গেল কয়েকবার। স্ক্রিনে ডট ডট দিয়ে তৈরি সেই রেখাটি আগের মতোই বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করছে।

সেদিনের মতোই ঢুকে দেখি, ডানের চেয়ারটা খালি। দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। পরবর্তী প্রায় এক ঘণ্টা আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম সবকিছু। উঁহু, কিচ্ছু নেই। এমপিডিটা তাহলে কিসের দিকে ইঙ্গিত করছে?

এই পুরো সময় লাইব্রেরির ও মাথায় বসে থাকা বুড়ো মানুষটি একবারও মুখ তুলে তাকাননি। শুধু পৃষ্ঠা ওলটাতে দেখেছি তাকে। একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করি, এই লাইব্রেরির বিশেষত্ব কী? আমার স্বপ্নে দেখা লাইব্রেরি আর এটা কি এক? নিজেকে সামলে রাখলাম বহু কষ্টে। স্বপ্নে কী দেখেছি, তা এই বুড়ো মানুষটির জানার কথা নয়। আসলে, আমার মাথা কাজ করছে না। যুক্তি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

আমি সামান্য মানুষ। কোনো বিজ্ঞানী নই। পদার্থবিজ্ঞান পড়েছি পড়ার জন্য। বোঝার চেষ্টা তেমন করিনি। ডিগ্রি অর্জনের জন্য অত দরকারও পড়ে না। সেই আমি এসব কিসের ভেতরে এসে পড়লাম?

ঠিক এ সময় চোখের কোণে লাইব্রেরির শেষ মাথায় কিসের যেন নড়াচড়া ধরা পড়ল। ভালো করে তাকিয়েও বিষয়টা কী, ধরতে পারলাম না। ঠিক সেই মুহূর্তে বিষয়টা খেলে গেল মাথায়। দেয়ালটা, ওপাশের দেয়ালটা চেক করা হয়নি। চোখের কোণে আমি দেয়ালটায় নড়াচড়া দেখেছি। তরঙ্গের মতো!

দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে। দেয়ালটায় ধাক্কা দিতে যাব, সে সময় বুড়ো মানুষটি পেছন থেকে কী যেন বললেন। চিৎকার করছেন মনে হলো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। আমার পুরো জগৎটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। কয়েক হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ যেন ধাক্কা দিয়েছে। বিচিত্র সব আকৃতি খেলা করছে চোখের সামনে। যন্ত্রণার তীব্রতাই হোক কিংবা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অমানবিক এ অভিজ্ঞতা অসহ্য বোধ হওয়ায়, আপনাতেই বুজে এল চোখ দুটো।

ছয়

আস্তে-ধীরে চোখ খুলে গেল। মৃদু আলো এসে চোখে পড়ছে। মাথায়, সারা দেহে অসহ্য ব্যথা। কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, কী হয়েছে। জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় আছি, সেটা ধরতে পারলাম না।

উঠে বসলাম কষ্টেসৃষ্টে। ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে আসছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সব। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম, একটা লাইব্রেরিতে আছি আমি। আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই লাইব্রেরি!

কিন্তু জায়গাটা কোথায়? আমি কি সত্যি সত্যি অন্য কোনো মহাবিশ্বে চলে এসেছি? বিষয়টা বোঝা দরকার।

স্বপ্নে যেমন দেখতাম, লাইব্রেরিটা ঠিক সে রকম। গোলকধাঁধার মতো। সরু সরু সব গলি চলে গেছে নানা দিকে। প্রতিটি গলির দুপাশে থরে–বিথরে সাজানো আলমারিভর্তি বই। বিচিত্র সব বর্ণে কী কী যেন লেখা প্রতিটি আলমারিতে। কোনো কোনো বর্ণ দেখে মনে হচ্ছে, আমার চেনাজানা কোনো সভ্যতার বর্ণ নয় এগুলো।

আরও পড়ুন

বাংলা বর্ণের খোঁজ করছি ঘোরগ্রস্তের মতো। পাচ্ছি না কিছুতেই। এলোমেলোভাবেই কী যেন একটা চিন্তা পাকিয়ে উঠছে মাথার ভেতরে। একটা গলির শেষে গিয়ে দেখি, আর পথ নেই। শেষ মাথায় গোলাকার কাচের মতো একটা জানালা। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে দেখি, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উঁহু, কথাটা ভুল হলো। বুঝতে পারলাম, কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ জিনিস আমার পরিচিত নয় মোটেও।

বিষয়টা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। জ্ঞান হারানোর আগে যেমন বিচিত্র সব আকৃতি দেখেছিলাম, খানিকটা সে রকম। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, মানে বিমূর্ত চিত্রের মতো নানা রকম আকৃতি। মানুষের মস্তিষ্ক যেকোনো কিছুর মধ্যেই প্যাটার্ন খোঁজে। মেঘের ভেতরে হাতি-ঘোড়া দেখতে পায়। মশারির কোনার দিকে তাকালে দেখে মানবাকৃতি। আমার মনে হলো, এই আকৃতিগুলো আসলে ত্রিমাত্রিক নয়। আমার মস্তিষ্ক জোর করে এগুলোকে ত্রিমাত্রিকভাবে দেখাতে চাইছে। সে জন্য কোথাও দেখতে পাচ্ছি ষড়্‌ভুজ বা নয়ভুজের মতো উদ্ভট আকৃতি। প্রথম যখন তাকিয়েছিলাম, তখন কিছু না দেখতে পাওয়ার কারণটাও পরিষ্কার হলো। মানুষের মস্তিষ্ক একদম অপরিচিত কিছুর দিকে তাকালে চট করে দেখতে পায় না। কারণ, মস্তিষ্ক ওই জিনিসের সঙ্গে কোনো আকৃতি মেলাতে পারে না। ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়।

আক্ষরিক অর্থেই কোটি কোটি চিঠি। পাগলের মতো উল্টে যাচ্ছি একের পর এক। মনে হচ্ছে বাংলায় লেখা পৃথিবীর সব চিঠি যেন এখানে রাখা। হাতব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু থামলাম না।

এ রকম ঘটনার অনেক উদাহরণ আছে। একটি বিখ্যাত উদাহরণ হলো, ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক যখন অস্ট্রেলিয়ার বোটানি বে, অর্থাৎ উপকূলে জাহাজ নিয়ে পৌঁছান, তখন স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁদের নৌকা দেখতে পাননি। তাঁরা দেখেছিলেন, তিনি পানিতে ভেসে আসছেন। এর কারণ, তাঁরা আগে কখনো নৌকা বা জাহাজ দেখেননি। তাঁদের মস্তিষ্ক তাই জিনিসটা দেখতেই পায়নি! এ ঘটনার কথা লিখে গেছেন তাঁর জাহাজে কর্মরত উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ব্যাংকস।

পরবর্তী অনেকটা সময় ঘুরে বেড়ালাম আমি লাইব্রেরিটার মধ্যে। আলমারির বদলে কোথাও কোথাও সিন্দুকের মতো রাখা। পুরোটা কাচের। ওর ভেতরে কোথাও গাছের গুঁড়ি, কোথাও পাথর, কোথাও পার্চমেন্ট রাখা দেখলাম। কিছু বাক্সের মধ্যে কী আছে, দেখে ঠিক চিনতে পারলাম না। মনে হলো যেন কিচ্ছু নেই। বুঝতে পারলাম, জিনিসগুলোর আকৃতি আমার অপরিচিত।

বেশ কয়েকটি ও রকম কানাগলির শেষে আরও কিছু জানালা চোখে পড়ল। কোনোটির বাইরেই আমার পরিচিত কোনো আকৃতি দেখতে পেলাম না। কত সময় পেরিয়েছে, বোঝার জন্য মোবোওয়াচের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। ঘড়িটার ডিসপ্লে বন্ধ হয়ে গেছে। ব্ল্যাঙ্ক।

এ সময় ডান দিকের, মানে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে ডানে একটা গলিতে যেন পরিচিত কোনো শব্দ চোখে পড়ল। বাংলা? ছুটে গেলাম। খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পর বুঝলাম, বাংলা নয়। অসমীয়া। তার মানে, বাংলা কাছাকাছি কোথাও-ই থাকার কথা। হাতের বাঁয়ে একটা গলি পেয়ে ঢুকে পড়তেই প্রথম বাংলা অক্ষর চোখে পড়ল। আলমারিটার ওপর বড় করে লেখা,

ক-কবিতা

(নামের আদ্যক্ষর অনুসারে সাজানো)

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর এগিয়ে ‘চ’ পেলাম।

চ-চিঠিপত্র

(নামের আদ্যক্ষর অনুসারে সাজানো)

আক্ষরিক অর্থেই কোটি কোটি চিঠি। পাগলের মতো উল্টে যাচ্ছি একের পর এক। মনে হচ্ছে বাংলায় লেখা পৃথিবীর সব চিঠি যেন এখানে রাখা। হাতব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু থামলাম না। থামার উপায় নেই আমার। আম্মুর চিঠিটা যখন খুঁজে পেলাম, ততক্ষণে সময়, ব্যথাবোধ বা অনুভূতি একরকম লুপ্ত হয়ে গেছে।

চিঠিটা হাতে পেতেই শান্তির পরশ ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা দেহে। সেই সাদা পৃষ্ঠা, এক কোনায় একটু ভাঁজ, অল্প কয়েকটি বাক্য। অতি সাধারণ এক চিঠি। অথচ কী পরম অমূল্য!

সেই মুহূর্তে মাথার ভেতরে পাকিয়ে উঠতে থাকা চিন্তাটা রূপ পেল। জায়গাটা নিশ্চয়ই আন্তমহাবিশ্ব শূন্য!

আরও পড়ুন

আমার বাবার হাইপোথিসিসে কিছুটা ভুল ছিল। মহাবিশ্বগুলো একটি আরেকটির গায়ে ধাক্কা খায় না। প্রতিটি মহাবিশ্বকে আলাদা করে রেখেছে এই আন্তমহাবিশ্ব শূন্যস্থান। সম্ভবত, আমি লাইব্রেরি হিসেবে একে দেখছি, কারণ, চিঠিটি আমি খুঁজছিলাম প্রবলভাবে। পরম এ শূন্যতাকে আমার মস্তিষ্ক লাইব্রেরি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আন্তমহাবিশ্ব এই শূন্যস্থান সম্ভবত একটি ডেটা সেন্টার। প্রতিটি মহাবিশ্বের সব ধরনের তথ্য, সবকিছু সংরক্ষিত আছে এখানে। অতীতে যা হয়েছে, ভবিষ্যতে যা হবে—সব। ডেটা সেন্টারটি ঘিরে রাখা ফোর্স ফিল্ডটির একটি করে অংশ উপরিপাতিত হয়েছে প্রতিটি মহাবিশ্বকে ঘিরে রাখা ফোর্স ফিল্ডের ওপরে। সে জায়গাগুলোই কাজ করে পোর্টাল হিসেবে। আবার এই আন্তমহাবিশ্ব শূন্যস্থান নিশ্চিত করে প্রতিটি মহাবিশ্বের নিরাপত্তা।

আমার এই ভাবনার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। পুরোপুরি প্রমাণ করা সম্ভবও নয়। এর জন্য কোনো গাণিতিক যুক্তি বা সমীকরণ দাঁড়া করানো তো আরও অসম্ভব আমার পক্ষে। কিন্তু নিজের মতো করে খানিকটা প্রমাণ খুঁজে দেখতে পারি। চেষ্টা করতে দোষ কী?

আমি একটা বইয়ের খসড়া লিখেছিলাম। একটা কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসিকা। সেটা নিশ্চয়ই এখানে থাকবে আমার ভাবনা সত্য হলে। ‘ক’ বর্ণটির খোঁজে আবার পা বাড়ালাম। ‘কল্পবিজ্ঞান’ লেখা আলমারিটা খুঁজে বের করা দরকার।

আবারও কোটি কোটি বইয়ের স্তুপ ঘেঁটে দেখা। অবশেষে খুঁজে পেলাম। আছে, আমার খসড়াটি এখানেই আছে। কিন্তু আরও চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। খসড়াটির পরেই একটা বই রাখা। ‘জোছনা আঁধারলোকে’। লেখক: রাহাত আখন্দ। মানে, আমি! অথচ এ বই আমি লিখিনি। কিন্তু এ গল্পটা নিয়ে আমি ভেবেছি। তার মানে কী, ভবিষ্যতে লিখব? নাকি… 

বইটিতে প্রকাশের তারিখ দেওয়া ১৭ আগস্ট ১৯৫৪। পদার্থবিজ্ঞান তেমন না বুঝলেও, বিষয়টা বুঝতে আমার খুব বেশি সময় লাগল না। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। মাথার ভেতরে কেউ একজন বলছে, পালাও। সর্বশক্তিতে। সময় ফুরিয়ে আসছে। এক্ষুনি, ছুট দাও! মনে হচ্ছে, গলির যে মাথা দিয়ে ঢুকেছি, ওটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছুট দিলাম প্রাণপণে। ছুটছি…ছুটছি…

কথায় আছে না, পিঁপড়ের পাখা গজায় মরার জন্য? উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতেই আমি মহাজাগতিক গোলকধাঁধা থেকে খুঁজে বের করলাম জায়গাটা। যেখানে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু অনেক খুঁজেও লাভ হলো না।

আটকা পড়েছি আমি। আন্তমহাবিশ্ব এই শূন্যতা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই।

কী হয়েছে, সেটা বোঝা খুব কঠিন কিছু নয়। মহাবিশ্বের ভর ও শক্তির পরিমাণ সংরক্ষিত। নির্দিষ্ট। তাই যে মুহূর্তে আমি পোর্টাল দিয়ে মহাবিশ্ব থেকে বেরিয়ে এসেছি, সেই মুহূর্তে আমার তথ্য ব্যবহার করে সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার একটি কপি তৈরি করেছে। যে মুহূর্তে আমি জ্ঞান হারিয়েছি, শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো সৃষ্টি হয়েছে আমার দুটি অবস্থা। এর একটি আবার ফিরে গেছে আমার মহাবিশ্বে। না হয় আমি বেরিয়ে গেলে আমার ভর ও শক্তিটুকু মহাবিশ্ব থেকে বেরিয়ে যেত। ভেঙে পড়ত শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি।

তার মানে, আমার একটি প্রতিরূপ এ মুহূর্তে পৃথিবীতে আমার জীবনটি যাপন করছে। আর আমি আটকে গেছি অনন্ত শূন্যতায়।

মেঝেতে বসে পড়লাম। মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে কেমন যেন। শুধু ছোটবেলায় পড়া জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা ঘুরছে মস্তিষ্কে।

সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস:

বাতাসের ওপারে বাতাস—

আকাশের ওপারে আকাশ।

তথ্যনির্দেশ ও সূত্র

১. দ্য সিটি অব সাইলেন্স: চৈনিক লেখক মা বয়ং-এর এই উপন্যাসিকাটি প্রথম ২০০৫ সালে সায়েন্স ফিকশন ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে কেন লিউ চৈনিক কল্পবিজ্ঞানের ইংরেজি অনুবাদ সংকলন ইনভিজিবল প্ল্যানেটস গ্রন্থে এটি অনুবাদ করেন। বাংলায় এ বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে আফসার ব্রাদার্স থেকে, ২০২০ সালে।

২. কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজি নিয়ে সলিম আখন্দের গবেষণাপত্র: সলিম আখন্দ, বিফোর দ্য বিগ ব্যাং: দ্য হকিং পয়েন্টস দ্যাট এনলাইটেন দ্য স্কাই, রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সোসাইটি, প্রকাশকাল: ২২ আগস্ট ২০২৫। এই গবেষণাপত্রটির নাম তিনি দিয়েছিলেন পেনরোজের মূল গবেষণাপত্রটির সঙ্গে মিল রেখে—রজার পেনরোজ, বিফোর দ্য বিগ ব্যাং: অ্যান আউটরেজিয়াস নিউ পার্সপেক্টিভ অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশনস ফর পার্টিকেল ফিজিকস, রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সোসাইটি, প্রকাশকাল: ২৬ জুন ২০০৬।

৩. রজার পেনরোজের সাক্ষাৎকার। ৪ অক্টোবর ২০২৫।

৪. স্টিফেন এম ফিনি উইলকিনসনের গবেষণাপত্র: স্টিফেন এম ফিনি, ম্যাথিউ সি জনসন, ড্যানিয়েল জে মর্টলক এবং হিরন্য ভি পেইরি, ফার্স্ট অবসার্ভেশনাল টেস্টস অব ইটার্নাল ইনফ্লেশন: অ্যানালাইসিস মেথডস অ্যান্ড ডব্লিউএমএপি সেভেন ইয়ার রেজাল্টস, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০।

আরও পড়ুন