নিউ মেক্সিকোর রসওয়েল শহরের ৭৬ মাইল উত্তর–পশ্চিমে জায়গাটি।
১০ জুলাই, ১৯৪৭। ঝোড়ো বাতাস গুলিবর্ষণের মতো আঘাত হানছে মানুষটির মুখ আর উন্মুক্ত হাত দুটোয়। হ্যাটটা শক্ত করে মাথার সঙ্গে চেপে ধরে ট্রাক থেকে ট্রাকে ছুটছেন তাগড়া লোকটি। যত জোরে সম্ভব, চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছেন চালকদের। কিন্তু বাতাস উড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে তাঁর কথাগুলো। ১৫ মিনিট আগে শুরু হওয়া বালুঝড়ের সঙ্গে চিৎকারের পাল্লা দিতে দিতে উত্তরোত্তর ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন তিনি।
আড়াই টনের ১৫টি ট্রাকের সারির শেষ চালকটি নড করল। বুঝতে পারছে, হঠাৎ শুরু হওয়া এই মরুঝড় শান্ত না হওয়া পর্যন্ত গ্রামীণ হাইওয়ে ফোরের ধারে অপেক্ষা করতে হতে পারে কনভয়টি।
পেশায় ধাতুবিদ ড. কেনেথ আর্লি। তর্কাতীতভাবে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান কার্গোটির দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত। অন্তত এমনটাই বুঝ দিচ্ছেন তিনি নিজেকে। বহন করা ক্রেটগুলো যাতে নিরাপদে নেভাডায় পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য গ্যারিসন লি নিজে নির্বাচন করেছেন তাঁকে। হ্যাঁ, উড়ে যেতে পারতেন তাঁরা লাস ভেগাসের আর্মি এয়ারফিল্ডে। কিন্তু আকাশপথে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিরাপদ ট্রাক কনভয়ে করে কার্গো পরিবহনের তাগিদ দিয়েছে তাঁদের। ডক্টর নিজের সেরা ১০ নিরাপত্তাকর্মীকে নিযুক্ত করেছেন অস্বাভাবিক কার্গোটিকে পাহারা দেওয়ার জন্য।
বাতাসের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে প্রথম ট্রাকের কাছে ফিরে গেলেন ড. আর্লি। ভেতরে বসা চালকের উদ্দেশে হাত নেড়ে এগিয়ে গেলেন সবুজ সরকারি শেভ্রোলেটটির দিকে। ওটার পেছনের দরজা খুলতে খুলতে শুকরিয়া অনুভব করলেন গাড়িটির নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে বলে।
একটা ঢোঁক গিলে আর্লির উদ্দেশে ঘাড় ঘোরাল চালক, ‘অদ্ভুত সব ফিসফাস চলছে এ নিয়ে। শুনলে পেটের ভাত চাল হয়ে যাওয়ার অবস্থা!’
মাথা থেকে হ্যাট খুলে নিয়ে ঝাড়লেন ডক্টর। ছোট একটা ধুলার মেঘ তৈরি হওয়ায় কেশে উঠল তাঁর সিকিউরিটি চালক।
দুঃখ প্রকাশ করে পাশের সিটে হ্যাটটা ছুড়ে দিলেন আর্লি। কোটের পকেট থেকে বের করে নিলেন পুরু কাচের চশমা। ওটা নাকে লাগিয়ে সামনে ঝুঁকে এলেন তিনি, সামনের সিটের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখলেন কনুই দুটো। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, কপাল খুলল রেডিওর ব্যাপারে?’
টুঁ শব্দটিও করছে না, ডক্টর। বিরস কণ্ঠে বলল চালক, ‘খুব সম্ভবত ঝড়ের কারণে। খারাপ আবহাওয়ার পাল্লায় পড়লে বোঝা যায়, যতখানি বলা হয়, আসলে ততখানি ভালো নয় আর্মির বাতিল করা রেডিওগুলো।’
‘কম্ম কাবার! পিছিয়ে আসতে হবে জানলে আমার পেছনটা জ্বালিয়ে দেবেন লি। কারণ, তাঁর শিডিউলে গড়বড় হয়ে যাচ্ছে এতে।’ পাশের জানালা দিয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করলেন আর্লি, ‘এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় বসে অপেক্ষা করার ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না আমার।’
‘আমারও না, ডক্টর। সত্যি কথাটাই বলি আপনাকে। ক্রেটগুলোয় কী রয়েছে, জানার পর থেকে গতকাল দেখা দুনিয়াটা পাল্টে গেছে বলে মনে হচ্ছে আমার।’ একটা ঢোঁক গিলে আর্লির উদ্দেশে ঘাড় ঘোরাল চালক, ‘অদ্ভুত সব ফিসফাস চলছে এ নিয়ে। শুনলে পেটের ভাত চাল হয়ে যাওয়ার অবস্থা!’
তরুণ আর্মি লেফটেন্যান্টের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আর্লি। মাত্র মাস তিনেক হলো, দলে যোগ দিয়েছে ছেলেটি।
‘আলবত বুঝতে পারছি, কী বলতে চাইছ তুমি।’ বললেন তিনি, ‘নতুন কমপ্লেক্সে জিনিসটা সহিসালামতে পৌঁছে না দেওয়া অবধি সোয়াস্তি নেই কারও।’
উইন্ডশিল্ড ভেদ করে চাইলেন ডক্টর। আশ্চর্য হলেন কালো পোশাকধারী তিন ব্যক্তিকে দেখে। চোখজোড়া সরু করে বালুর ভেতর দিয়ে তাকানোর চেষ্টায় নাকের ওপর নেড়েচেড়ে নিলেন তিনি চশমাটা।
মড়া দেখেও অতখানি ভয় পেতেন না আর্লি, যতটা পাচ্ছেন তিনি হতচ্ছাড়া ওই ১০ ফুট বাই ১০ ফুট মাপের কনটেইনারগুলোকে। গুঞ্জন উঠেছে, খাঁচা নাকি ওগুলো! প্রাণপণে ব্যাপারটা চেপে রাখতে চাইছেন লি। কিন্তু খাঁচাগুলোর মধ্যে যে জিনিস রয়েছে বলে ভাবছে সবাই, সেটা যদি সত্যি হয় তো…!
শরীরের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টায় চোখ দুটো বুজে ফেললেন ডক্টর।
‘এরা আবার কারা?’ হঠাৎই গলা চড়ে গেল লেফটেন্যান্টের।
আর্মি অফিসারের দিকে চোখ মেলে তাকালেন আর্লি। দেখতে পেলেন, রেডিও হ্যান্ডসেট নামিয়ে রেখে বেল্টে আটকানো হোলস্টার থেকে কোল্ট পয়েন্ট ৪৫ বের করে নিল তরুণ অফিসার।
উইন্ডশিল্ড ভেদ করে চাইলেন ডক্টর। আশ্চর্য হলেন কালো পোশাকধারী তিন ব্যক্তিকে দেখে। চোখজোড়া সরু করে বালুর ভেতর দিয়ে তাকানোর চেষ্টায় নাকের ওপর নেড়েচেড়ে নিলেন তিনি চশমাটা। রাস্তার আড়াআড়ি বয়ে চলেছে বালুর ঝড়।
‘হুড আর গগলস পরেছে নাকি ওরা?’ প্রশ্ন তাঁর।
জবাব না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল লেফটেন্যান্ট। ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল ড. আর্লির কথাগুলো, ছড়িয়ে দিল বালুর ভেতর।
‘ইউনাইটেড স্টেটসের সরকারি কনভয় এটা। তোমরা…।’
এটুকুই বলতে পারল শুধু তরুণ লেফটেন্যান্ট। আতঙ্কিত আর্লির চোখের সামনে তিন আগন্তুকের মাঝখানের জন টমসন সাবমেশিনগানের মতো দেখতে অস্ত্রটা ওপরে তুলল। তিন পশলা গুলি এসে বিঁধল আর্মি অফিসারের ঊর্ধ্বাঙ্গে। প্রথমে দরজার বাজুতে, এরপর রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ল হতভাগ্য অফিসার। বাতাসের কারণে সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল লেফটেন্যান্টের পিঠ ফুঁড়ে বেরোনো রক্তের কুয়াশা।
‘সরি, ডক্টর!’ ঝড় ছাপিয়ে শোনার মতো করে বলল অনাহূত আগন্তুক, ‘কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশটা রক্ষা করার হ্যাপা যে কতখানি, সেটা যদি বুঝত আপনাদের ওপরওয়ালা!’
‘ঈশ্বর!’ আঁতকে উঠলেন আর্লি।
আচমকা উপলব্ধি করলেন তিনি, এ মুহূর্তে আশ্রয় নেওয়ার সেরা জায়গা নয় গাড়িটা। হঠাৎ সিট থেকে ঝাঁপ দিলেন বালু আর বাতাসের মধ্যে। একটা হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়িয়ে সাময়িক আড়াল নিলেন শেভির পেছনে। একদম কাজ করতে চাইছে না মাথাটা। ঘাড় নিচু করে সারির প্রথম ট্রাকটির দিকে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় পিঠে এসে বিঁধল পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের পরপর পাঁচটি বুলেট।
রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পাশের খন্দের মধ্যে পড়ে গেলেন হতভাগ্য আর্লি। শরীরের রক্ত শুষে নিচ্ছে বালু, কালো কমব্যাট গিয়ার পরা আগন্তুকদের একজনকে নিজের ওপর ঝুঁকে পড়তে দেখলেন ভদ্রলোক। চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে আরেকটু ঝুঁকে এল সে, এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে দস্তানা পরা একটা হাত রাখল আর্লির কম্পিত কাঁধে।
‘সরি, ডক্টর!’ ঝড় ছাপিয়ে শোনার মতো করে বলল অনাহূত আগন্তুক, ‘কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশটা রক্ষা করার হ্যাপা যে কতখানি, সেটা যদি বুঝত আপনাদের ওপরওয়ালা!’
বিভ্রান্ত আর্লি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন লোকটির দিকে।
চকিতে চারপাশটা জরিপ করে মাথা ঝাঁকাল আগন্তুক। এরপর মুখ নিয়ে এল ড. আর্লির একদম কানের কাছে, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ডক্টর, আপনি আর আপনার লোকেরা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন আমেরিকা, তথা দুনিয়ার নিরাপত্তার পথে।’ বিষণ্ন শোনাল তার গলাটা। মাথা নাড়ল আফসোসের ভঙ্গিতে। গুলিবিদ্ধ আর্লি শেষনিশ্বাস ফেলতেই সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে সঙ্গীদের নির্দেশ দিল সে চিৎকার করে।
নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করতে হলো কনভয়ের বাকিদেরও।
মরুভূমির ছোট এয়ারবেজটি থেকে রহস্যময় কার্গোসহ কোথায় যে হারিয়ে গেল এরপর হতভাগ্য লোকগুলো, জানে কেবল ঈশ্বর আর নীলনকশার পেছনের মানুষগুলো! ৭৭টি বছর ধরেই অমীমাংসিত রয়ে গেছে রহস্যটি।
আর এটি হচ্ছে লিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গ্রহান্তরের প্রাণিবিষয়ক ধামাচাপা!