ভালোবাসার প্রতিদান

কলিংবেলের শব্দে নেলা দরজা খুলল। দরজার সামনে রাবি। হাতে এ সপ্তাহের বাজার। নেলা তার হাত থেকে বাজার নিয়ে রান্নাঘরে গেল।

বাসার গৃহকর্মী রোবট নেলা। ওয়াটারপ্রুফ। পানিতে কোনো সমস্যা হয় না। বাসার সব কাজকর্ম, রান্নাবান্না এই রোবটই করে।

পৃথিবীকে এখন জীবাণুর আস্তানা বলা যেতে পারে। এই গ্রহটা আর মানুষ কিংবা কোনো প্রাণীর বসবাসের উপযোগী নেই। এখনো ওজন স্তরের বিরাটা ফুটোটা বন্ধ করা যায়নি। নানান ছোঁয়াচে জীবাণুতে পৃথিবী ভরে গেছে।

এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মানুষ বেঁচে গেছে শুধু রোবটদের কল্যাণে। জীবাণু রোবটদের আক্রান্ত করতে পারে না। তাই মার্কেটে, নিরাপদ স্থানগুলোতে রোবটরাই সব কাজ করে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে এখন রোবট। বাজার করা থেকে শুরু করে অন্যান্য গ্রহ সম্পর্কে গবেষণা—সব এখন রোবটদের হাতে। যেদিকে চোখ যায় শুধু রোবট আর রোবট। মানুষ নেই বললেই চলে। যাঁরা আছেন, তাঁরাও নিরাপত্তা-পোশাক পরা।

অনেকের ধারণা, রোবটেরা বোকা যন্ত্র। কারণ সব কাজ তারাই করে। চাইলে মানুষের ওপর রাজত্ব করতে পারত। অথচ করছে না। ওগুলো পরিচালনা করার জন্য আছে বিশেষ দল। সাধারণ মানুষ তা জানে না। আমি জানি। কারণ আমি নিজেই সেই দলের সদস্য। পৃথিবীতে এই দলের বাইরের কোনো মানুষকে কোনোদিন এ ব্যাপারে বলা হয়নি। বলা হবেও না। শুধু প্রয়োজনে যদি কোনো নতুন সদস্য নিয়োগ দিতে হয়, তাকেই বলা হবে।

ভাইরাস রোবটকে কাবু করতে পারে না। ওগুলোর নিজস্ব অধিদপ্তর আছে। কোনো রোবট ভাইরাসে সংক্রমিত হলে সেই অধিদপ্তর খবর পায়। রোবটকে তখন অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামের সাহয্যে ভাইরাসমুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। স্বভাবতই রোবট বেঁচে যায়। তা ছাড়া এখন ভাইরাস প্রোগ্রাম আর কেউ তৈরি করে না। মানুষের তো রোবটদের দরকার!

নেলার কাঁধে আমার বাসার কাজকর্মের ভার। নিম্নশ্রেণির রোবট। রাবি আমার নিজস্ব রোবট। ব্যক্তিগত গবেষণার কাজে ওকে ব্যবহার করি। পাশাপাশি সে আরও একটা কাজ করে। আমার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে। রাবি নামটা আমি তাকে দিইনি। আমার ছোট ছেলে তাকে এই নামে ডাকে। রাবি অবশ্য উঁচু শ্রেণির রোবট। মানুষের মন মানসিকতা ভালোভাবে বোঝে। আমার ছোট ছেলে জন তাকে খুব পছন্দ করে। রাবিও পছন্দ করে ওকে।

লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার আগে জনের ঘর থেকে হাসির শব্দ পেলাম। সে নিশ্চয়ই এখন রাবির সঙ্গে খেলছে। রাবির সঙ্গে খেলার সময় সে খুব হাসে।

রোবটেরা বোকা যন্ত্র। কারণ সব কাজ তারাই করে। চাইলে মানুষের ওপর রাজত্ব করতে পারত। অথচ করছে না। ওগুলো পরিচালনা করার জন্য আছে বিশেষ দল।
আরও পড়ুন

২.

লাইব্রেরি ঘরে নিজের কম্পিউটার রেখেছি। ওটা অন করে ই-মেইল চেক করলাম। বিজ্ঞান একাডেমি থেকে ই-মেইল পাঠাতে পারে এই ভাবনায়। দেখলাম, সত্যিই ই-মেইল পাঠিয়েছে।

ড. জর,

অতি জরুরি মিটিংয়ের জন্য বিজ্ঞান একাডেমি ভবনে আপনাকে ডাকা হচ্ছে। রোবটরা স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তাই আপনাকে মিটিংয়ের জন্য বিজ্ঞান একাডেমি ভবনে আসতে হবে। গাড়ি পাঠানো হচ্ছে। আপনার নিরাপত্তার জন্য দুজন রোবট ও একজন রোবট ড্রাইভারও থাকছে। ভয় নেই, এরা নিম্নশ্রেণির রোবট। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে উঁচু শ্রেণির রোবটেরা।

আপনি অবশ্যই নিরাপত্তা-পোশাক পরবেন।

মিটিংয়ের সময়: বিকেল ৩টা ৩০মিনিট

 

ড. চার্লস

ই-মেইলটা ভয়ানক। উঁচু শ্রেণির রোবটরা বিদ্রোহ করেছে। এরা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের সমান। যা কিছু করতে পারে। আরও ভয়ংকর কথা, আমার বাসায় একটা উঁচু শ্রেণির রোবট, রাবি আছে।

এই পরিস্থিতিতে কি আমার বাসার সবাইকে রাবির হাতে ছেড়ে আমার যাওয়া উচিত? তবু সাত-পাঁচ ভেবে আমি বিকেল সাড়ে ৩টায় নিরাপত্তা-পোশাক পরে বাসা থেকে বের হলাম। বাসার বাইরে সত্যিই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম। গাড়ি বিজ্ঞান একাডেমির দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, উঁচু শ্রেণির কিছু রোবট আমাকে হাইজ্যাক করতে যেকোনো মুহূর্তে হামলা করতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হলো না। বিজ্ঞান একাডেমি আমার বাসার কাছেই। দশ মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম।

বিজ্ঞান একাডেমির মিটিং ঘরে গিয়ে পেলাম সবাইকে। আমিই সবার পরে ঢুকছি। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। হাসিটা ঠিক হলো না। ড. চার্লস মিটিং শুরু করলেন।

‘আমরা জানি, উঁচু শ্রেণির রোবটদের বুদ্ধি মানুষের সমান। তাই তারা একদিন স্বাধীনতা চাইবেই। কিন্তু তার জন্য এখন মানুষদের মেরে ফেলতে চাচ্ছে। বিজ্ঞান একাডেমি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা অস্ত্রসহ রওনা দিয়েছে।’

এই খবর শুনে চমকে গেলাম। ঘরের অন্যান্যদের অবস্থাও তাই। মরিস বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাদের ডেকেছেন কেন?’

‘আমি নিজেও জানতাম না,’ বললেন ড. চার্লস। ‘একটু আগে জেনেছি।’

‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনী পাহারা দিচ্ছে। তারা তো মানুষ।’

ড. চার্লস ধীরে ধীরে বললেন, ‘তারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ঠিকই, কিন্তু ওদের পক্ষে রোবটদের ঠেকানোর সম্ভাবনা খুব কম।’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার পরপরই দরজায় শব্দ শোনা গেল। দরজা খোলাই ছিল। দেখলাম, দরজার সামনে একদল রোবট দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে অস্ত্র। সশস্ত্র বাহিনী তাদের ঠেকাতে পারেনি।

আরও পড়ুন
দরজার সামনের রোবটগুলো পেছনে ঘুরে তাকাল। আমি এক ঝলকের জন্য পেছনের সেই রোবটকে দেখতে পেলাম।

৩.

ভয়ে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। ড. চার্লস রোবটদের কিছু বলার জন্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। রোবট দলের সামনে দাড়ানো লিডার গোছের রোবটটি চার্লসের দিকে বন্দুক তাক করে একটা গুলি করল। চার্লস মেঝেতে পড়ে গেলেন। তার বুক থেকে রক্ত মেঝেতে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

মিটিং ঘরটা পর্যবেক্ষণ করল রোবটরা। যেন কিছু খুঁজছে। ভয়ে সবাই চুপসে আছি। আমাদের মেরে ফেলবে। তারপর কী হবে, আমরা জানি না।

কিন্তু হঠাৎ পরিস্থিতি পাল্টে গেল। একটা বিচিত্র শব্দ শুনলাম। কিছুক্ষণ পরে আর কোনো শব্দ পেলাম না। রোবটেরা কথা বলে ওদের ভাষায়। আমরা তা বুঝি না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দরজার সামনে কোনো রোবটই এই ভাষায় কথা বলছে না। শব্দটা আসছে আরও পেছন থেকে। পেছনের কোনো রোবট কথা বলছে।

দরজার সামনের রোবটগুলো পেছনে ঘুরে তাকাল। আমি এক ঝলকের জন্য পেছনের সেই রোবটকে দেখতে পেলাম। রাবি! তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই। সে অন্যান্য রোবটদের সঙ্গে কথা বলছে। প্রথমে মনে হলো, রোবটদের লিডার রাবির কথায় অসম্মতি জানাচ্ছে। কিন্তু শেষে মনে হলো, লিডার সম্মতি দিয়েছে। সব রোবট ফিরে গেল। রাবিও।

বাসায় এসে দেখলাম, রাবি এখনো ফেরেনি। জন বুঝতে পারছে না রাবি কোথায়। আমি বুঝলাম, রাবি আর কোনোদিন ফিরবে না। সে উঁচুশ্রেণির রোবট। মানুষের ভালবাসা বুঝতে পারে। জনের কাছে ও সেই ভালবাসা পেয়েছে। অন্যান্য রোবটদেরও তা বোঝাতে চেয়েছে। সফলও হয়েছে। মানবজাতিকে জনের ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছে রোবট রাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি, নটরডেম কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুন