সৌরজগতের ভয়ংকরতম অগ্ন্যুৎপাত

জুনো নভোযানের চোখে বৃহস্পতির উপগ্রহ আইও (IO)

সৌরজগতের সবচেয়ে শক্তিশালী অগ্ন্যুৎপাত ঘটে বৃহস্পতির সালফার সমৃদ্ধ চাঁদ আইও-তে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইন্সটিটিউট (পিএসআই)-এর গবেষকেরা উপগ্রহটির আগ্নেয়গিরিগুলোর বিপুল সক্রিয়তা লক্ষ্য করেছেন। এত বেশি অগ্ন্যুৎপাত এর আগে কখনো কোথাও দেখা যায়নি।

এই বিপুল অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বৃহস্পতির চারপাশে তৈরি হয় প্লাজমার চক্র। গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে আগ্নেয়গিরিগুলো অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময়ের মাঝে বিপুল পরিমাণ গ্যাস, ছাই আর ধুলিকণা ছড়িয়ে পরে চারপাশে।

আইও পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে আকার-আয়তনে সামান্য বড়। আগ্নেয়গিরির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত বৃহস্পতির এই চাঁদ। এর বুকে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪০০টি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১৫০টি আগ্নেয়গিরি সবসময় সক্রিয় থাকে। এসব সক্রিয় আগ্নেয়গিরির কারণে উপগ্রহটির পৃষ্ঠে তৈরি হয়েছে গলিত লাভার বিশাল হ্রদ।

উপবৃত্তাকার কক্ষপথে বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করে আইও। ফলে প্রতিবার ‘সুইং’ করার সময় বৃহস্পতির তীব্র মহাকর্ষের টানে এর আকৃতি বদলে যায়।

আরও পড়ুন
নাসার গ্যালিলিও মহাকাশযানের তোলা আইও-এর ছবি।
নাসা

‘সুইং’ বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। তবে এটা বুঝতে হলে আইও-এর গতিপথের বিষয়টা বুঝতে হবে। আইও-এর গতিপথ উপবৃত্তাকার। যেকোনো উপবৃত্তের থাকে দুটো উপকৃন্দ্র। এই উপকেন্দ্রে থাকা অবস্থায় এটি বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে আসে। তখন বৃহস্পতির মহাকর্ষীয় টানে এটির গতি বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে খানিকটা বিকৃত হয়ে যায় আকৃতি। গতি দ্রুত হয়ে গিয়ে এটি যে ছুট দেয়, সেটাকেই ইংরেজিতে বলে ‘সুইং’ করা। (একটা মজার বিষয় বলে রাখি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রটির জন্য। উপকেন্দ্রে থাকা অবস্থায় উপগ্রহের গতি যে বেড়ে যাবে, সেটা কেপলারের সূত্র থেকেই জানা যায় বা হিসেব করা যায়।)

বৃহস্পতির টান ছাড়াও অন্যান্য ‘গালিলিও চাঁদ’-এর মহাকর্ষ প্রভাব পড়ে আইওতে। (বলে রাখি, গ্যালিলিও টেলিস্কোপে চোখ রেখে বৃহস্পতির যেসব উপগ্রহ আবিষ্কার করেছেন, তাদের বলে গ্যালিলিও চাঁদ।) এই টানাটানির কারণে তৈরি হয় অভ্যন্তরীণ ঘর্ষণ। ঘর্ষণ মানেই তাপ। অতিরিক্ত তাপের কারণে ভেতরের গলিত লাভা বেরিয়ে আসে পৃষ্ঠ ফুঁড়ে।

আইও-এর অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাব পড়ে বৃহস্পতিতেও। উপগ্রহটির কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই। অগ্ন্যুৎপাতে বেরিয়ে আসা সালফার ডাই-অক্সাইড উপগ্রহের মহাকর্ষে তাই আটকে যায় না। বৃহস্পতির চারপাশে ঘুরতে থাকা প্লাজমার চক্র তৈরি করে এগুলো।

এই প্লাজমার চক্র আবার বৃহস্পতির স্থায়ী অতিবেগুনি আরোরা বা মেরুজ্যোতি তৈরির অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে।

বৃহস্পতির এই জটিল ব্যবস্থাটি আমাদের জন্য বিস্ময়কর, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানেই এর মাহাত্ম্য শেষ নয়। এই ব্যবস্থা বোঝার মাধ্যমে দূরের গ্যালাক্সিতে ঘটে চলা অনেক অজানা রহস্য সম্পর্কে পাওয়া যেতে পারে মূল্যবান তথ্য।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
প্রায় পাঁচ বছরের পর্যবেক্ষণ তাঁকে মূল্যবান তথ্যের জোগান দিয়েছে। এসব অগ্ন্যুৎপাত থেকে বেরিয়ে আসা সালফার ও সোডিয়াম কীভাবে প্লাজমা চক্রের জ্বালানী হচ্ছে, তা গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য করেছেন তিনি।
নভোযান জুনো (বামে) ও বৃহস্পতির উপগ্রহ আইও
নাসা/জেপিএল-ক্যালটেক

প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইনস্টিটিউটের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেফ মর্গেন্থালার ২০১৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির আইও সম্পর্কিত ইনপুট-আউটপুট মানমন্দির (আইও ইনপুট-আউটপুট অবজারভেটরি, IoIO) ব্যবহার করে উপগ্রহটি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন।

বৃহস্পতি আকারে দানবীয় এবং বেশ উজ্জ্বল। মানমন্দিরটিতে তাই পর্যবেক্ষণ করা হয় করোনাগ্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে বৃহস্পতি থেকে প্রতিফলিত উজ্জ্বল আলো ফিল্টার করে কমিয়ে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। উজ্জ্বল আলোক উৎসের আলো কমিয়ে নেওয়ার ফলে আশেপাশের তুলনামূলক কম আলোর উৎসগুলো ভালো করে দেখা যায়। এদের মাঝে আইও বা বৃহস্পতির অন্যান্য উপগ্রহ যেমন আছে, তেমনি আছে প্লাজমার চক্র।

এভাবে তিনি প্রতিবছর আইও-এর অগ্ন্যুৎপাত পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রায় পাঁচ বছরের পর্যবেক্ষণ তাঁকে মূল্যবান তথ্যের জোগান দিয়েছে। এসব অগ্ন্যুৎপাত থেকে বেরিয়ে আসা সালফার ও সোডিয়াম কীভাবে প্লাজমা চক্রের জ্বালানী হচ্ছে, তা গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য করেছেন তিনি।

তিনি দেখলেন, সম্প্রতি প্লাজমা চক্রের আয়তন বাড়লেও উজ্জ্বলতা বাড়েনি। বরং গত বছরগুলোর চেয়ে কিছুটা কমেছে। কেন এমন হয়েছে, বিজ্ঞানীরা তা এখনও জানেন না। জানতে পারলে বৃহস্পতি এবং আইও সম্পর্কে আরও নতুন তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

প্লাজমা চক্র সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়ার জন্য আপাতত বিজ্ঞানীদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। নাসার পাঠানো জুনো নভোযান এই মুহূর্তে বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। এই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে জুনো নভোযানকে পুরো বৃহস্পতির প্লাজমার অবস্থা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিমাপ করতে হবে। সেজন্য সময় প্রয়োজন।

চলতি বছরের ডিসেম্বরে জুনো আইও উপগ্রহটির পাশ দিয়ে উড়ে যাবে। তখন হয়তো হলুদাভ আগ্নেয়গিরি ভরা এই উপগ্রহ সম্পর্কে আরও চমৎকার সব তথ্য আসবে বিজ্ঞানীদের হাতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেঁজগাও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া