প্রায় সাড়ে ৪ কোটি গ্যালাক্সির বিশাল মানচিত্র বানিয়েছে গায়া টেলিস্কোপ

গায়া মিশনের মাধ্যমে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি নক্ষত্র ও নীহারিকা বা নেবুলার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছেছবি: ইসা

মহাকাশ ভ্রমণ করা অনেকেরই স্বপ্ন। কিন্তু যদি বলি পৃথিবীতে বসেই এখন আপনি মহাবিশ্বের বিশাল অংশ ঘুরে দেখতে পারবেন, বিশ্বাস করবেন! বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কারণ, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি গ্যালাক্সির একটি নতুন ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করেছেন। এই মানচিত্রে সৌরজগতের সূর্য থেকে প্রায় ৪ হাজার আলোকবর্ষ দূরের মহাকাশও দেখা যাবে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইসার গায়া মিশন থেকে আসা এই মানচিত্রে ৪ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি নক্ষত্র, ধুলোর বিশাল মেঘ ও মহাজাগতিক শক্তির অঞ্চল রয়েছে। এটি মহাবিশ্বের এক নতুন ছবি। আর এটি কেবল শুরু। কারণ, মানচিত্র আরও বড় ও নিখুঁত করার জন্য বিজ্ঞানীরা এখনো কাজ করছেন।

পৃথিবী থেকে রাতের আকাশে মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ দেখা বেশ সহজ। কিন্তু এর অনেক বড়। প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ ব্যাসের কারণে বাইরে থেকে একে দেখা প্রায় অসম্ভব। তাই বিজ্ঞানীরা আমাদের মহাজাগতিক প্রতিবেশীর একটি সঠিক ছবি পেতে ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করেছেন। গায়া মিশনের মাধ্যমে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি নক্ষত্র ও নীহারিকা বা নেবুলার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন বিজ্ঞানীরা সেসব তথ্য ব্যবহার করে গ্যালাক্সির সবচেয়ে নির্ভুল ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করেছেন।

নতুন মানচিত্রে সাধারণ ৪ কোটি ৪০ লাখ নক্ষত্রের পাশাপাশি ৮৭টি বিরল ‘ও’ টাইপ নক্ষত্রও রয়েছে। এই নক্ষত্রগুলো খুব বিশাল এবং এদের জীবনকালের শুরুর দিকে খুবই বেশি তাপমাত্রায় উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকে।

ইসা ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গায়া টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করে। তখন থেকে মিল্কিওয়ের ভরের বর্তমান সঠিক মান, এর ভেতরে ডার্ক ম্যাটার, ত্রিমাত্রিক মানচিত্রসহ আরও অনেক কিছু জানার জন্য এই টেলিস্কোপ কাজ করে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

স্টের্লার নার্সারির মানচিত্র তৈরি করা খুব কঠিন। কারণ এই অঞ্চলগুলো ঘন ধুলো ও গ্যাসের মেঘ দিয়ে ঢাকা থাকে। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই অন্ধকার কাজে লাগিয়ে গায়া মহাকাশ পর্যবেক্ষণাগার নক্ষত্রের ‘বিলুপ্তি’ পরিমাপ করে এদের অবস্থান নির্ণয় করতে পেরেছেন। এখানে ‘বিলুপ্তি’ বলতে মহাজাগতিক ধূলার কারণে আলো যে পরিমাণ বাধা পায়, তা বোঝানো হয়েছে। বিজ্ঞানীরা একবার নক্ষত্রের বিলুপ্তি পরিমাপ করার পর, সেসব ধুলোময় অঞ্চলকে একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্রে রূপান্তর করেন। এরপর তাঁরা সেখানে আয়নিত হাইড্রোজেন গ্যাসের উচ্চ মাত্রার অঞ্চলগুলো খুঁজে বের করেন।

নতুন মানচিত্রে সাধারণ ৪ কোটি ৪০ লাখ নক্ষত্রের পাশাপাশি ৮৭টি বিরল ‘ও’ টাইপ নক্ষত্রও রয়েছে। এই নক্ষত্রগুলো খুব বিশাল এবং এদের জীবনকালের শুরুর দিকে খুবই বেশি তাপমাত্রায় উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকে। একটি ‘ও’ টাইপ নক্ষত্রের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এতই শক্তিশালী যে এটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে ইলেকট্রন সরিয়ে দেয়। পরে আরও আয়নিত গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাসগুলোই মহাকাশে উজ্জ্বলভাবে জ্বলে ওঠে। এগুলোই আমরা দূর থেকে দেখতে পাই।

এই গবেষণার সহলেখক জ্যোতির্বিজ্ঞানী লুইস ম্যাককালাম বলেন, ‘আয়নিত গ্যাসের বন্টনের এমন কোনো মডেল আগে কখনো তৈরি হয়নি। এতে আমরা নিশ্চিত যে, ওপর থেকে আমাদের ছায়াপথের যে দৃশ্য ও ভিডিও তৈরি করা হয়েছে, তা ত্রিমাত্রিক মানচিত্রে এই মেঘগুলো দেখতে কেমন হবে, তার একটি ভালো ধারণা দেবে।’

আরও পড়ুন
নতুন এই মানচিত্রে ক্যালিফোর্নিয়া নীহারিকা, উত্তর আমেরিকান নীহারিকা, গাম নীহারিকা এবং ওরিয়ন-এরিডানাস সুপারবাবলের মতো মহাজাগতিক জায়গাগুলোর বিস্তারিত ছবি রয়েছে।
গায়া টেলিস্কোপ
ছবি: ইসা

জ্যোতির্বিজ্ঞানী লুইস ম্যাককালাম ও তাঁর দল নতুন মানচিত্র থেকে ‘ও’ টাইপ নক্ষত্রের জন্মস্থান সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, কিছু নক্ষত্র তৈরির মেঘ ভেঙে একটি বিশাল শূন্যস্থান বা গহ্বর তৈরি করেছে, যা এখন আবার গ্যাস ও ধুলো দিয়ে ভরে উঠছে। এই মানচিত্র খুব সুন্দরভাবে দেখায় যে কীভাবে বিশাল নক্ষত্রের বিকিরণ তার চারপাশের গ্যাসকে প্রভাবিত করে এবং সেই গ্যাস ও ধুলো কীভাবে এই বিকিরণের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে।

নতুন এই মানচিত্রে ক্যালিফোর্নিয়া নীহারিকা, উত্তর আমেরিকান নীহারিকা, গাম নীহারিকা এবং ওরিয়ন-এরিডানাস সুপারবাবলের মতো মহাজাগতিক জায়গাগুলোর বিস্তারিত ছবি রয়েছে। তবে এটি কেবল শুরু। গায়া পর্যবেক্ষণ দলের পরিকল্পনা হলো, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে তাদের কাছে আসা নতুন ডেটা সেট দিয়ে এই মানচিত্রটিকে আরও বড় ও উন্নত করা। এই নতুন তথ্যের সাহায্যে মানচিত্রটি আরও বিস্তারিত হবে বলে মনে করেছেন বিজ্ঞানীরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: পপুলার সায়েন্স ও ইসা

আরও পড়ুন