সৌরজগতের কোথায় এলিয়েন লুকিয়ে থাকতে পারে

সৌরজগতের ভেতরে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে বের করার জন্য বেশ কিছু জায়গায় অনুসন্ধান চালানো হচ্ছেগেটি ইমেজ

এখন পর্যন্ত এলিয়েনের সঙ্গে মানুষের দেখা হয়নি। তবু বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে এলিয়েন নিয়ে কল্পনার শেষ নেই। রাতের আকাশে বহু মানুষ তাকিয়ে থাকে। ভাবে, মহাবিশ্বের কোথাও কি কেউ আমাদের দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে? কল্পনার পরিধিকে আমরা একটু কমিয়ে আনি। মহাবিশ্বের কথা না ভেবে আমরা সৌরজগতের ভেতরে এলিয়েন থাকার সম্ভাবনা ভেবে দেখতে পারি। আমাদের সৌরজগতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভবনা কেমন?

উত্তর জানার আগে একটি কথা বলে রাখা দরকার। এলিয়েন বলতে আমরা সৌরজগতে বুদ্ধিমান প্রাণীর কথা ভাবছি না। বিজ্ঞানীদের কাছে এলিয়েন হলো পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব। সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, প্রাণ থাকলেই তাকে আমরা বলব এলিয়েন।

পৃথিবীর বাইরে সৌরজগতে প্রাণ আছে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সৌরজগতে ভিনগ্রহী প্রাণীর অস্তিস্ত্ব থাকা অসম্ভব নয়। সৌরজগতের ভেতরেই প্রাণের চিহ্ন খুঁজে বের করার জন্য বেশ কিছু জায়গায় অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। কিছু জায়গায় প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

মঙ্গল গ্রহে কি প্রাণ আছে

আমাদের কল্পনার এলিয়েনের ছবি অনেকটা হিউম্যানয়েড। মানে সবুজ রঙের ছোটখাটো মানুষের মতো প্রাণী, যার মাথায় অ্যান্টেনা আছে। এমন কোনো প্রাণী আসলে মঙ্গলে নেই। তবে মঙ্গলে আগে ক্ষুদ্র অণুজীবের অস্তিত্ব ছিল কিনা, সেটাই খুঁজে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে মঙ্গল গ্রহ একদম ঠাণ্ডা মরুভূমি। মঙ্গলে পাঠানো রোভারগুলো বিজ্ঞানীদেরকে খবর পাঠিয়েছে, অনেক আগে এই গ্রহে তরল পানি ছিল। আর পানি মানে জীবন। যেখানে পানি আছে, সেখানেই জীবন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। 

মঙ্গল গ্রহ
নাসা

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ভূতত্ত্বের অধ্যাপক এবং নাসার কিউরিওসিটি ও পারসিভারিয়েন্সের সদস্য অ্যামি উইলিয়ামস। তিনি বলেছেন, ‘কিউরিওসিটি রোভার অতীতে মঙ্গলের পৃষ্ঠে অণুজীবের জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত ছিল কিনা, তা খুঁজে দেখেছেন।’  

মঙ্গল গ্রহের পরিবেশ নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এই রোভারটি বিশেষ পাথরের নমুনা সংগ্রহ করছে। ভালোভাবে বিশ্লেষণের জন্য এই পাথর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ‘মার্স স্যাম্পল রিটার্ন’ মিশনের মাধ্যমে এই নমুনাগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা চলছে।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ভূতত্ত্বের অধ্যাপক এবং নাসার কিউরিওসিটি ও পারসিভারিয়েন্সের সদস্য অ্যামি উইলিয়ামস। তিনি বলেছেন, ‘কিউরিওসিটি রোভার অতীতে মঙ্গলের পৃষ্ঠে অণুজীবের জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত ছিল কিনা, তা খুঁজে দেখেছেন।’  

শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কি প্রাণ লুকিয়ে আছে

শুক্রকে পৃথিবীর ‘যমজ’ বলা হয়। তবে সৌরজগতে প্রাণ খুঁজলে প্রথমেই এখানে খোঁজা হবে না। এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রচণ্ড গরম। সীসা গলে যাবে এমন অবস্থা। এর পৃষ্ঠের চাপ পৃথিবীর চাপের চেয়ে ৯০ গুণের বেশি। আবার আমাদের যেমন পানি বা বাষ্পের মেঘ থাকে, এখানেও আছে তেমন ঘন সালফিউরিক অ্যাসিডের মেঘ। 

শুক্র গ্রহ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এত বৈরী পরিস্থিতি, তবু চরম পরিবেশে বসবাসকারী অণুজীব শুক্রের বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে টিকে থাকতে পারে। এখানে তাপমাত্রা ও চাপ তুলনামূলক কম। এই বিষয়ে জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) মর্নিং স্টার মিশন তৈরি করছে। এই মিশনের মাধ্যমে শুক্রের বায়ুমণ্ডল থেকে মেঘের নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে।

২০২০ সালে শুক্রের মেঘে ফসফিন গ্যাস শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ফসফিন গ্যাসকে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাব্য লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। যদিও সিগন্যালটি খুব দুর্বল ছিল এবং সমালোচকেরা বলেছিলেন, এটি ডেটার ত্রুটির কারণেও হতে পারে। আগামীতে মর্নিং স্টার মিশন শুক্রের রসায়নিক অবস্থা নিয়ে আরও বেশি তথ্য দেবে। এই গ্রহে ফসফিন আছে কিনা, তা জানা যাবে সেই মিশন থেকে।

আরও পড়ুন
২০২০ সালে শুক্রের মেঘে ফসফিন গ্যাস শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ফসফিন গ্যাসকে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাব্য লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়

শনি ও বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোতে কি প্রাণ আছে

সৌরজগতের আরও গভীরে শনি এবং বৃহস্পতি গ্রহ অবস্থিত। এদের কয়েকটি উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। বিশেষ করে এনসেলাডাস এবং ইউরোপাতে।

শনির উপগ্রহ এনসেলাডাসের পুরু বরফের স্তরের নিচে একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ মহাসাগর আছে। এই মহাসাগর থেকে বেরিয়েছে লবণাক্ত পানির বিশাল ফোয়ারা। এই ফোয়ারা ওপরে দিকে লবণ-পানি ছুঁড়ে দেয়। ক্যাসিনি মিশন ২০০৫-২০১৭ সাল পর্যন্ত এনসেলাডাসের পাশ দিয়ে বেশ কয়েকবার উড়ে গিয়েছে। এই ফোয়ারাগুলো থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ক্যাসিনি। ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এনসেলাডাসে ফসফেট শনাক্ত করেছেন। এর মানে, বিজ্ঞানীরা এই উপগ্রহের মহাসাগরে প্রাণের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব মৌলিক রাসায়নিক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন।

সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি
রয়টার্স

বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাও এনসেলাডাসের মতো বরফে ঢাকা। এখানেও ভূগর্ভস্থ মহাসাগর আছে। বৃহস্পতির প্রবল মহাকর্ষীয় টান ইউরোপাতে নানা পরিবর্তন ঘটায়। এ কারণে সম্ভবত এই মহাসাগরের পানি জমে না গিয়ে তরল থাকে। লবণাক্ত মহাসাগর এবং পাথুরে অবস্থার কারণে এখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। এখানকার পরিবেশ পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশপাশের পরিবেশের মতো। একইরকম পরিবেশে পৃথিবীতে কিছু প্রাণী বাস করে।ইউরোপাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন পাঠানো হয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করেছে। এটি ২০৩১ সালের মধ্যে বৃহস্পতিতে পৌঁছানোর কথা। অন্যদিকে নাসার ইউরোপা ক্লিপার মিশন ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর যাত্রা শুরু করেছে। ২০৩০ সালে এটি বৃহস্পতিতে পৌঁছাবে।

আরও পড়ুন
বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাও এনসেলাডাসের মতো বরফে ঢাকা। এখানেও ভূগর্ভস্থ মহাসাগর আছে। বৃহস্পতির প্রবল মহাকর্ষীয় টান ইউরোপাতে নানা পরিবর্তন ঘটায়।

শনি গ্রহের আরেকটি উপগ্রহ টাইটান। সৌরজগতের সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। এখানে পৃথিবীর পানিচক্রের মতো একটি মিথেন চক্র আছে। আছে একটি পুরু নাইট্রোজেন ও মিথেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলও। ক্যাসিনি মিশনের তথ্য থেকে জানা গেছে, টাইটানের বায়ুমণ্ডল এমন জটিল অণু তৈরি করতে পারে। এটি জীবনের বিল্ডিং ব্লক হিসেবে কাজ করে। নাসা বর্তমানে গাড়ির মতো দেখতে অক্টোকপ্টার পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এটি টাইটানের বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে।

সৌরজগতের আর কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে

সৌরজগতে আরও কিছু জায়গায় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। যার মধ্যে বামন গ্রহ সেরেস অন্যতম। ২০১৫ সালে ডন মিশনের পাঠানো ছবি থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেরেসের বরফ ও পাথরের আবরণের নিচে প্রচুর তরল পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা সৌরজগতে যত বেশি খোঁজাখুঁজি করছেন, তত বেশি প্রাণ টিকে থাকার মতো পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে। যদি এসব জায়গায় সত্যিই প্রাণের অস্তিত্ব থাকে, সম্ভবত এই প্রাণী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো যথেষ্ট উন্নত না। তাই আমাদেরকেই হয়তো এসব প্রাণকে খুঁজতে যেতে হবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন