মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা কি সত্যিই ধাক্কা লাগবে

ভবিষ্যতে হয়তো বিশাল এক মহাজাগতিক দুর্ঘটনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কারণ, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দিকে ধেয়ে আসছে অ্যান্ড্রোমিডা নামে আরেকটি বিশাল গ্যালাক্সি। মিল্কিওয়ের প্রতিবেশি সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সি এটি। আকাশের নির্দিষ্ট স্থানে তাকালে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দেখা যায়। বিশেষ করে গ্রীষ্মের শেষে এবং শরৎকালের শুরুর দিকে উত্তর গোলার্ধের অ্যান্ড্রোমিডাকে দেখা যায় একটা ঝাপসা ফোঁটার মতো। ম্লান হলেও ওই বিন্দুটা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও বড়। ধীরে ধীরে এটি আরও বড় হতে থাকবে। একসময় পুরো আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এই গ্যালাক্সি। খালি চোখেই দেখা যাবে বিশাল অ্যান্ড্রোমিডার রূপ। আর তারপরই ঘটতে পারে সেই ভয়ানক দৃশ্য—অ্যান্ড্রোমিডা আর মিল্কিওয়ের সরাসরি সংঘর্ষ।

এই সংঘর্ষ হবে একেবারে মুভির দৃশ্যের মতো। একটি গ্যালাক্সি ধীরে ধীরে অন্যটির মধ্যে প্রবেশ করতে থাকবে। নক্ষত্রগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকবে চারদিকে। এমনকি আমাদের সৌরজগতও কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারে।

তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। এমনটা যে হতেই হবে, তা কিন্তু এখনো নিশ্চিত নয়। যদিও অনেক গবেষণা বলে, এই দুটি গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষ হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে অন্য কথা। এই গবেষণাটা (arXiv.org) এখনো পিয়ার-রিভিউড নয়, কিন্তু তবুও গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের তৈরি একটি মডেল অনুযায়ী, অন্য আশপাশের গ্যালাক্সিগুলোর প্রভাব হিসাব করলে সংঘর্ষের সম্ভাবনা মাত্র ৫০ শতাংশ। মানে ব্যাপারটা কয়েন টসের মতো। হেড পড়লে হয়তো সংঘর্ষ হবে, কিন্তু টেল পড়লে সংঘর্ষ না হয়ে পাশ কাটিয়ে যাবে!

আরও পড়ুন

এবার একটু গ্যালাক্সি দুটি সম্পর্কে জেনে নিই। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা ডিস্কের মতো। এর প্রস্থ ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার আলোকবর্ষ। এর মধ্যে আছে শত শত কোটি নক্ষত্র, গ্যাস আর ধুলার মেঘ, মৃত নক্ষত্র এবং বিশাল একটা ব্ল্যাকহোল। গ্যালাক্সির মাঝখানে আছে ব্ল্যাকহোলটি। পুরো গ্যালাক্সির ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে দেড় ট্রিলিয়ন গুণ বেশি। বুঝতেই পারছেন আমাদের গ্যালাক্সি কত বড়!

আর অ্যান্ড্রোমিডাকে বলা যায় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির জমজ ভাই। কিন্তু অ্যান্ড্রোমিডা হলো বড় ভাই। মিল্কিওয়ের চেয়ে ওটার ভর আরও ৩০ শতাংশ বেশি। এটি আমাদের থেকে প্রায় ২৫ লাখ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। প্রতি সেকেন্ডে অ্যান্ড্রোমিডা ১১০ কিলোমিটার গতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে! আমাদের গ্যালাক্সির মতোই ওর চারপাশেও রয়েছে অসংখ্য পুরোনো নক্ষত্র আর ডার্ক ম্যাটারের হেলো। দুটি গ্যালাক্সিই স্থানীয় গ্যালাক্সিগুচ্ছ বা লোকাল গ্রুপে অবস্থিত। এই লোকাল গ্রুপে প্রায় ১০০টা গ্যালাক্সি আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় চারটি হলো মিল্কিওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডা, ট্রায়াঙ্গুলাম বা এম৩৩ ও লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউড। এরমধ্যে এম৩৩ মিল্কিওয়ে থেকে ২৭০ লাখ আলোকবর্ষ এবং অ্যান্ড্রোমিডা থেকে ৭ লাখ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

বড় গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। গ্যালাক্সিগুচ্ছের মধ্যে মাঝেমধ্যেই এমন ঘটনা ঘটে। গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের আকর্ষণে ধীরে ধীরে কাছে আসে। তারপর কোনোটা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, আবার কোনোটা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তবে সংঘর্ষ হলে দুটি গ্যালাক্সি মিলে তৈরি হয় একটা বিশালাকার নতুন গ্যালাক্সি। মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমিডা সংঘর্ষ হলে নতুন যে গ্যালাক্সি তৈরি হবে, তার নাম দেওয়া হয়েছে মিল্কিমিডা। 

তবে এই সংঘর্ষ একেবারে নিঃশব্দ নয়, বরং এতে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। একে অপরকে আকর্ষণের কারণে গ্যালাক্সিগুলোতে লম্বা লেজের মতো তৈরি হয়। একে বলে টাইডাল টেইলস। এগুলো গ্যাস আর নক্ষত্র দিয়ে তৈরি হয়। এই টাইডাল টেলস দৈর্ঘ্যে কয়েক লাখ আলোকবর্ষ পর্যন্ত হতে পারে। 

আরও পড়ুন

সবচেয়ে ভয়ংকর হল গ্যাসের সংঘর্ষ। একেকটা গ্যাসমেঘ কয়েকশো আলোকবর্ষ চওড়া হতে পারে। ওরা মুখোমুখি ধাক্কা খেলে প্রচুর নতুন নক্ষত্র তৈরি হয়, বিশাল শক্তির বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সঙ্গে প্রচুর গ্যাস আর ধুলা ঢুকে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোলের গহ্বরে। ব্ল্যাকহোলের চারপাশের গ্যাস আর ধুলা চক্রাকারে ঘুরে বিশাল আলো ও শক্তির উৎস হয়ে ওঠে। এই আলো পুরো গ্যালাক্সির সব নক্ষত্রের মিলিত আলো থেকেও বেশি!

এই কারণেই গ্যালাক্সির সংঘর্ষ যত ধীর গতিরই হোক না কেন, তা দারুণ নাটকীয় একটা ব্যাপার। আর এই পরিস্থিতিতে কোনো বাসযোগ্য গ্রহের টিকে থাকা খুবই কষ্টকর। 

এবার মূল প্রশ্নে ফিরি। অ্যান্ড্রোমিডা আর মিল্কিওয়ে একদিন ধাক্কা খাবে? আগেই বলেছি, অ্যান্ড্রোমিডা সেকেন্ডে ১১০ কিলোমিটার গতিতে আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্রায় সব গ্যালাক্সিই পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু অ্যান্ড্রোমিডাই উল্টো আমাদের দিকে আসছে।

তবে এখানেও একটা খটকা আছে। ওটা আমাদের দিকে আসছে ঠিকই, কিন্তু যদি এর ট্রান্সভার্স ভেলোসিটি বেশি হয়, তাহলে হয়তো একেবারে ধাক্কা না খেয়ে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে।

তবে এখানেও একটা খটকা আছে। ওটা আমাদের দিকে আসছে ঠিকই, কিন্তু যদি এর ট্রান্সভার্স ভেলোসিটি বেশি হয়, তাহলে হয়তো একেবারে ধাক্কা না খেয়ে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে। ট্রান্সভার্স ভেলোসিটি মানে, কোনো বস্তুর সরাসরি আপনার দিকে বা আপনার থেকে দূরে না গিয়ে বরং পাশ দিয়ে যাওয়ার গতি। ধরুন, আপনি একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। একটা গাড়ি যদি সরাসরি আপনার দিকে আসতে থাকে, তাহলে সেটা হলো গাড়ির সরাসরি গতি। কিন্তু যদি গাড়িটা আপনার পাশ দিয়ে অন্য দিকে চলে যায়, তাহলে সেই পাশ দিয়ে যাওয়ার গতিটাই হলো ট্রান্সভার্স ভেলোসিটি।

এখন মুশকিল হলো এই ট্রান্সভার্স গতি মাপা। কারণ, অ্যান্ড্রোমিডা অনেক দূরে। আর এই ট্রান্সভার্স গতিও চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে খুব সামান্য হলেও এই গতি মাপা গেছে। সেই হিসেবই বলছে, মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমিডা ধাক্কা খেতেও পারে, আবার নাও পারে।

আরও পড়ুন

এ কারণেই নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বহুবার কম্পিউটার সিমুলেশন চালিয়েছেন। বারবার ইনপুটের মান একটু একটু বদলে পরীক্ষা করেছেন সম্ভাব্য পথগুলো। শুধু মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা ধরলে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি!

তবে বিজ্ঞানীরা শুধু এই দুটি গ্যালাক্সির সিমুলেশন করেই থেমে থাকেননি। তাঁরা এম৩৩ ও  লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউডকে হিসেবের মধ্যে রেখে সিমুলেশন চালিয়েছেন। এরমধ্যে লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউডের আকর্ষণে মিল্কিওয়ে একটু পাশের দিকে সরে যায়। ফলে সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে। কিন্তু এম৩৩-কে ধরলে আবার সেই সম্ভাবনা বাড়ে। কারণ, এটা আমাদের অ্যান্ড্রোমিডার দিকে টেনে আনে।

সব মিলিয়ে, আমরা সত্যিই জানি না এই মহাজাগতিক মিলনের শেষ পরিণতি কী হবে। আদৌ মিলন হবে কিনা, তাও শতভাব নিশ্চিত নয়। আর যদি এমন কোনো মিলন ঘটেও, নিশ্চিত থাকুন তা আপনি দেখে যেতে পারবেন না। কারণ, ওই মিলন বা সংঘর্ষ যদি হয়ও, তাতে সময় লাগবে আরও ৮০০ কোটি বছর। ততদিনে সূর্যেরই অস্তিত্ব থাকার কথা নয়।

তা বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গ্যালাক্সিদের এমন সংঘর্ষ হয়েই থাকে। মিল্কিওয়ে নিজেও অতীতে অনেক ছোট গ্যালাক্সিকে গিলে খেয়ে বড় হয়েছে। আর এই সংঘর্ষ হবে কিনা, তা নিশ্চিতভাবে জানতে দরকার আরও পর্যবেক্ষণ, গবেষণা। হয়তো ভবিষ্যতে কোনোদিন মানুষ শতভাগ নিশ্চিতভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে! 

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

আরও পড়ুন