১৪ দিন মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরল চারটি ইঁদুর
চীনের মহাকাশ গবেষকেরা এক অদ্ভুত প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা প্রথমবারের মতো চারটি জীবিত ইঁদুর টানা চৌদ্দ দিন মহাকাশ স্টেশনে রেখে দিয়েছেন। ইঁদুরগুলো এরই মধ্যে মহাকাশ স্টেশনে টানা দুই সপ্তাহ কাটিয়ে সুস্থভাবে ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। শেনঝো-২১ মহাকাশযানে করে ইঁদুরগুলো তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিল। ইঁদুরগুলো ফিরে এসেছে শেনঝো-২০ ক্রুদের সঙ্গে।
মহাকাশে ইঁদুরের আচরণ পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকেরা জানতে পারবেন, ভবিষ্যতে মানুষ এবং অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মহাকাশে কীভাবে টিকে থাকবে। কেমন করে প্রাণী মহাকাশের পরিবেশে মানিয়ে নেবে, তা জানার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ।
চারটি ইঁদুরের মধ্যে দুটি পুরুষ এবং দুটি স্ত্রী ইঁদুর ছিল। শুরু থেকে চীনা গবেষকেরা জানার চেষ্টা করেছেন, মহাকাশের সীমিত পরিবেশে কীভাবে টিকে থাকে ইঁদুরগুলো। ওজনহীনতার প্রভাব, মাইক্রোগ্রাভিটি কীভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণীর আচরণ বদলায়, মহাকাশে ইঁদুরের কী ধরনের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে এবং ইঁদুরের মানসিক অভিযোজনকে কতটা প্রভাবিত করে? পৃথিবীতে এগুলো ছিল সাধারণ ল্যাব ইঁদুর। কিন্তু এই মহাকাশ অভিযানের কারণে এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নভোচারী ইঁদুর’।
মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছানোর পর এদের যাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়। ভিডিওফুটেজে দেখা গেছে, বক্সের মতো বিশেষ কন্টেইনার থেকে এদের তোলার পর নভোচারীরা ইঁদুরের পরীক্ষাগারটি পাওয়ার সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। সিস্টেমের ভেতরে তাপমাত্রা ছিল ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানে ঘরের মতো আরামদায়ক পরিবেশ বজায় রাখা হয়েছিল। ওজনহীনতার কারণে এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ানো খাবারের টুকরা কিংবা ইঁদুরের মল যেন চারদিকে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য ছিল বিশেষ বায়ুপ্রবাহ। এই প্রবাহ সবকিছু নিচের আঠালো প্যানেলে জড়ো করে রাখত।
পৃথিবীতে ফেরার পরপরই গবেষকেরা ইঁদুরগুলোর আচরণ, চলাফেরা, শারীরবৃত্তীয় অবস্থা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা দেখতে চেয়েছেন, এগুলোর শরীর কতটা চাপের মধ্যে ছিল?
ফুটেজে ইঁদুরগুলোকে সাবলীলভাবে খেতে দেখা গেছে। ইঁদুরগুলো মাথা নাড়ানো, কখনো কখনো খাঁচার দেয়াল বেয়ে ওঠার মতো কাজগুলো স্বাভাবিকভাবেই করেছে। নতুন পরিবেশে খুব দ্রুত মানিয়ে নিয়েছে। এদের রাখা হয়েছিল নরম জায়গায়। এক বলা হয় ‘শেল্টার নেস্ট’। এই থাকার জায়গা ইঁদুরগুলোকে নিরাপত্তার অনুভূতি দিয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, মহাকাশে প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে গেলে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে ফেরার পরপরই গবেষকেরা ইঁদুরগুলোর আচরণ, চলাফেরা, শারীরবৃত্তীয় অবস্থা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা দেখতে চেয়েছেন, এগুলোর শরীর কতটা চাপের মধ্যে ছিল? মাইক্রোগ্রাভিটি এদের হাড়, মাংসপেশি, স্নায়ুতন্ত্র বা হরমোনের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে? এ সব প্রশ্নের উত্তর পরের ধাপের গবেষণায় জানা যাবে।
এই যাত্রায় যাওয়ার আগে ইঁদুরগুলোকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য ছিল ঘূর্ণায়মান রড, যা ছিল এদের ‘এক্সারসাইজ বাইক’। মহাকাশ স্টেশনে টিকে থাকার জন্য ইঁদুরগুলোর শক্তি ও সহনশীলতার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এরপর ছিল মাথা ঘোরা বা মোশন সিকনেস প্রতিরোধের পরীক্ষা। বহু দিক থেকে ঘূর্ণনের মধ্যে স্থির থাকার অভ্যাস তৈরি করা হয়েছিল ইঁদুরগুলোর। আচরণগত পরীক্ষাও ছিল। এই পরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে কোন ইঁদুর বেশি সাহসী, কোনটি বেশি মানিয়ে নিতে পারে। কোনটি চাপের মুখে সক্রিয় থাকে, তাও দেখা হয়েছে। গোলকধাঁধা পরীক্ষায় দেখা হয়েছে, এরা পরিবেশ বুঝে খাবার খুঁজে নিতে পারে কিনা। সবশেষে ছোট সিমুলেটেড কেবিনে অভিযোজনের পর সেরা চারটি ইঁদুর মহাকাশ অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
মহাকাশে দীর্ঘমেয়াদে মানুষের থাকা, ভবিষ্যতে মানুষের প্রজনন বা মহাকাশে বিস্তারের সম্ভাবনা যাচাই করার জন্য এই পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ। মাইক্রোগ্রাভিটি প্রাণীর আচরণকে বদলে দেয় কিনা, জানার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি। চাপের পরিস্থিতিতে শরীর কীভাবে মানিয়ে নেয়, তা এই প্রকল্পের সাহায্যে জানার চেষ্টা করছেন গবেষকেরা। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার প্রথম ধাপ হলো ইঁদুরগুলোর মহাকাশযাত্রা।
ইঁদুরগুলো ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে চীনা গবেষকেরা বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক নমুনা, পরীক্ষার ফলাফল ও তথ্য পেয়েছেন। এই অভিযানকে চীনের ‘স্পেস লাইফ সায়েন্সে’ বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।