ধারাবাহিক
আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ৮
মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের বিস্ময়-আগ্রহ পুরকালের। পৌরাণিক যুগ থেকেই প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভান্ডার। আধুনিক যুগে এসে আমূলে বদলে গেছে মহাকাশবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। মানুষ এখন অনন্ত মহাবিশ্বের গভীর থেকে গভীরে ডুব দিতে চায়। কতটুকু সফল সে চেষ্টায়? ইতিহাস আর বিজ্ঞানের খেরোখাতায় চোখ রাখা যাক।
আকাশের তারাদের চেনা
আকাশ সবার জন্য। সেই সুদূর অতীত থেকে মানুষ আকাশ নিয়ে কল্পনা করেছে, রূপকথায় তারাদের জীবন্ত করে তুলেছে। মানুষের কিংবদন্তিতে কালপুরুষ ও বৃষরাশির মতো নক্ষত্রমণ্ডল অথবা সপ্তর্ষি ও কৃত্তিকার মতো নকশা বা এস্টেরিজমে ঠাঁই পেয়েছে। আকাশের তারাদের অবস্থান মনে রাখতে আকাশকে বিভিন্ন তারামণ্ডলে ভাগ করা হয়েছে। আধুনিক জ্যোতির্বিদেরা প্রাচীনকালের নক্ষত্রমণ্ডলদের সে রকমভাবে বদলাননি, কিছুটা প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা করতে, কিছুটা নিজেদের সুবিধার জন্য। তবে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান যেহেতু নক্ষত্রমণ্ডলের সীমানার ওপর নির্ভর করে না, সে জন্য নক্ষত্রমণ্ডলের পরিচয় এখন অনেকটা শৌখিন জ্যোতির্বিদ্যার অন্তর্গত। বর্তমানের আকাশ ৮৮টা নক্ষত্রমণ্ডলে বিভক্ত, কিন্তু যেসব নামে এই নক্ষত্রমণ্ডলদের অভিহিত করা হয়েছে, তাদের সেভাবে চেনা দুরূহ। অরিগা নক্ষত্রমণ্ডলকে সারথি বলা হয়, কিন্তু অরিগার তারাদের রেখা দিয়ে যুক্ত করলে একটা বিশাল আয়তক্ষেত্র ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রমণ্ডলে কোনো সুন্দরী রানিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বীণা বা লাইরামণ্ডলে পাওয়া যাবে না কোনো বাদ্যযন্ত্রকে। রাতের আকাশ সহজে চেনার জন্য আমরা সবচেয়ে লক্ষণীয় তারা এবং নকশাগুলো ব্যবহার করব। লেখাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ১ নম্বর চিত্রটা সব সময় দেখতে হবে।
সপ্তর্ষি
মার্চ, এপ্রিল আর মে মাসে উত্তর আকাশের সাতটি তারা আমাদের খুব পরিচিত (চিত্র ১)। তাদের আমরা বলি সপ্তর্ষি, সাতটি ঋষি—ক্রতু (Dhube), পুলহ (Merak), পুলস্ত্য (Phad), অত্রি (Megre), অঙ্গিরা (Alioth), মরীচি (Mizar) ও বশিষ্ঠ (Alkaid)। কিন্তু আধুনিক আকাশে সপ্তর্ষি কোনো আলাদা মণ্ডলী নয়, বরং এটি একটি এস্টরিজম এবং উরসা মেজর (বৃহৎ ভলুক) নক্ষত্রমণ্ডলীর অংশ। এর সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা হচ্ছে ক্রতু ও অঙ্গিরা। এ দুটিই ১.৮ মাত্রার তারা।
ধ্রুবতারা
সপ্তর্ষির পুলহ থেকে ক্রতু পর্যন্ত একটা রেখা টেনে আরও বর্ধিত করলে সেটি ধ্রুবতারার খুব কাছাকাছি দিয়ে যাবে (চিত্র ১)। যারা ধ্রুবতারা চেনে না, তাদের মধ্যে অনেকেই মনে করে ধ্রুবতারা খুব উজ্জ্বল এক তারা। আসলে আমাদের আকাশে ধ্রুবতারা খুব উজ্জ্বল নক্ষত্র নয় (এর মান ২.০), উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধ মিলিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সারিতে ধ্রুবতারার অবস্থান ৪৮তম। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে ধ্রুবতারা খুব উজ্জ্বল, সূর্য থেকে প্রায় ২৫০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল। তার দূরত্বের জন্যই তাকে এত ম্রিয়মাণ লাগে।
ধ্রুবতারা একটা শেফালি বা সেফিড বিষম তারা, সেটা খগোল উত্তর মেরুর খুব কাছে অবস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে ধ্রুবতারাকে নিশ্চল মনে হলেও তারও একটা বামাবর্তী গতি আছে। খগোল সুমেরু থেকে তার দূরত্ব হচ্ছে ৪২ কৌণিক মিনিট (১ কৌণিক ডিগ্রি থেকে একটু কম)। আর পৃথিবীর অক্ষের দিক পরিবর্তনের বা অয়ন চলনের ফলে ধ্রুবতারা এই মুহূর্তে সুমেরুর কাছাকাছি আসছে। ২১১৪ সালে তার অবস্থান খগোল সুমেরু থেকে ২০ কৌণিক মিনিট দূরে থাকবে, এরপর আবার সে দূরে সরতে থাকবে। আবার ৬০০০ বছর পরে ধ্রুবতারা তার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। তাই ধ্রুবতারাকে ঠিক ধ্রুব বলা যায় না। ৫০০০ বছর আগে থুবান নামে একটি অনুজ্জ্বল তারা খগোল সুমেরুর কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। প্রাচীন মিসরের অনেক স্থাপত্য থুবানের অবস্থান অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল।
সপ্তর্ষি থেকে স্বাতী ও চিত্রা
সপ্তর্ষির লেজের তিনটি তারাকে যোগ করে দক্ষিণ দিকে বর্ধিত করলে আমরা পৌঁছাব বুটিস মণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল লালচে একটি তারায় (চিত্র ১)। এর নাম হলো স্বাতী (আর্কটুরাস)। স্বাতী আকাশের চতুর্থ উজ্জ্বল তারা। স্বাতী থেকে এই অধিচাপটি আর একটু বাড়ালে আমরা পাব কন্যা রাশির নীল তারাটি, যার নাম হলো চিত্রা (স্পাইকা)।
স্বাতী একটি লাল দানব, এর ভর সূর্যের সমান হলেও এর ব্যাস সূর্য থেকে ২৫ গুণ বড়, ঔজ্জ্বল্য ১৭০ গুণ বেশি। M টাইপ এই তারাটি আমাদের থেকে প্রায় ৩৬ আলোকবর্ষ দূরে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যার আকাশে একে প্রায় মাথার ওপরে দেখা যাবে।
চিত্রা একটি জোড়া তারা, একটা ১০ সৌরভরের নীল দানব ও একটা ৭ সৌরভরের শেফালি বিষম তারার সমন্বয়ে গঠিত এই সিস্টেমটা পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ১০ সৌরভরের মূল তারাটি সূর্য থেকে প্রায় ১২ হাজার গুণ বেশি উজ্জ্বল এবং বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি টাইপ ২ সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হতে পারে।
দেনেব, অভিজিৎ, আলটেয়ার—গ্রীষ্ম ত্রিভুজ
গ্রীষ্মের আকাশে তিনটি উজ্জ্বল তারা দেনেব, ভেগা (অভিজিৎ) ও আলটেয়ার—রচনা করে গ্রীষ্ম ত্রিভুজের। মূলত জুন, জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরে উত্তর গোলার্ধের মধ্যবর্তী অক্ষাংশের যেকোনো স্থান থেকে এ ত্রিভুজকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। দেনেব হচ্ছে সিগনাস বা হংস নক্ষত্রমণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, সিগনাস বা হংসকে খুব সহজেই চেনা যায় তার ক্রুস চিহ্ন দিয়ে। সেই ক্রুস একটা বড় রাজহাঁসকে বোঝায়, যে রাজহাঁস ছায়াপথের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ১ নম্বর চিত্র অনুযায়ী দেনেবকে আমরা খুঁজে পাব সপ্তর্ষি থেকে। সপ্তর্ষি থেকে দেনেব প্রায় ৫০ ডিগ্রি দূরে অবস্থিত।
গ্রীষ্ম ত্রিভুজের অন্য উজ্জ্বল (এই ত্রিভুজের সবচেয়ে উজ্জ্বল) তারা অভিজিৎ (ভেগা) বীণা (লায়রা) নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। বীণাকে চেনা যাবে আভিজিতের নিচে চারটি তারা দিয়ে গঠিত একটা সুন্দর সামান্তরিক দিয়ে। এই সামান্তরিকের একটি অংশে বলয় নীহারিকা নামে খুবই সুন্দর একটি প্ল্যানেটারি নেবুলা অবস্থিত। এর মেসিয়ের নম্বর হচ্ছে ৫১।
গ্রীষ্ম ত্রিভুজ ছাড়াও এই সময়ের আকাশে স্যাজিটেরিয়াস (ধনুরাশি) ও স্করপিয়াস (বৃশ্চিক রাশি) নক্ষত্রমণ্ডলকে পাওয়া যাবে দক্ষিণ আকাশে সূর্যপথ বা অয়নরেখার (ecliptic) ওপর। বৃশ্চিক রাশির মূল তারা জ্যেষ্ঠা (আন্টারিস) এর মধ্য লক্ষণীয়। এই লাল প্রথম মানের তারাটি জ্বলজ্বল করছে বৃশ্চিকের বুকে। জ্যেষ্ঠার ওপরে তিনটি তারা বৃশ্চিকের দাঁড় বা নখকে বোঝায় ও নিচে একটা তারার সারি বা রেখা বৃশ্চিকের লেজকে বোঝায়। বৃশ্চিক রাশির লেজ বেঁকে এসে শেষ হয়েছে ছায়াপথের ওপর।
আন্টারিস কথাটার মানে হলো অ্যান্টি এরিস বা মঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বী। আন্টারিস কেমন করে মঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো? যেহেতু আন্টারিস অয়নরেখার খুব কাছে অবস্থিত এবং অনেক সময় মঙ্গল গ্রহ আন্টারিসের কাছাকাছি দিয়ে ভ্রমণ করে, এই দুটি উজ্জ্বল বস্তুর মধ্য কোনটা মঙ্গল ও কোনটা আন্টারিস তা নিয়ে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। এই রকম অবস্থায় আন্টারিসের ঝিকিমিকি আলো দিয়ে তাকে চেনা যাবে, মঙ্গলের আলো হবে স্থিত।
সিগনাস নক্ষত্রমণ্ডল থেকে বৃশ্চিকে যেতে হলে আকাশের মধ্যপ্রান্তে অবস্থিত দেনেবের ক্রুস চিহ্ন ধরে প্রায় ৯৫ ডিগ্রি দূরে আকাশের দক্ষিণ প্রান্তে যেতে হবে। বৃশ্চিক রাশির পূর্ব দিকে ধনু রাশি অবস্থিত।
ধনু রাশি একটি প্রাচীন নক্ষত্রমণ্ডল অর্থাৎ প্রাচীন সভ্যতাগুলো কয়েক হাজার বছর আগেই এই অঞ্চলটাকে ধনুকধারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পশ্চিম দেশে একে এখন অনেক সময় চায়ের কেতলির মতোও বলা হয়। ধনু রাশি মূলত দ্বিতীয় মানের তারা দিয়ে গঠিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র ধনু রাশির কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে ছায়াপথের ওপর অবস্থিত। শহর থেকে দূরে অন্ধকার জায়গা থেকে ধনু রাশিকে দেখা যাবে মেঘলা ছায়াপথের ওপর। বাইনোকুলার দিয়ে ছায়াপথকে দেখলে বোঝা যাবে ছায়াপথ হাজার হাজার নক্ষত্র দিয়ে সৃষ্টি। ধনু ও বৃশ্চিকের অঞ্চল থেকে ছায়াপথ উঠে গেছে সিগনাসের দিকে।
ওফিউকাসের শূন্যতা
গ্রীষ্ম ত্রিভুজ ও বৃশ্চিক/ধনু রাশির মাঝামাঝি আকাশে কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্র নেই। এই মাঝের শূন্যতায় রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ মাত্রার তারা দিয়ে গঠিত প্রাচীন ওফিউকাস বা সর্পধারী মণ্ডল। ওফিউকাসের একমাত্র উজ্জ্বল দ্বিতীয় মানের তারা রাসালহেগ এই অঞ্চলে অবস্থিত।
হারকিউলসের গুচ্ছ স্তবক M31
দেনেব থেকে অভিজিৎ নক্ষত্র পর্যন্ত একটা রেখা টেনে তাকে আরও একটু বাড়ালে আমরা পৌঁছে যাব হারকিউলিস-মণ্ডলের চতুর্ভুজে। অভিজিৎ ও স্বাতী তারার মধ্যে হারকিউলিসের অবস্থান। যদিও হারকিউলিস মাত্র চতুর্থ মাত্রার তারাদের নিয়ে গঠিত। কিন্তু এই মণ্ডলে রয়েছে একটা গুচ্ছ স্তবক, যা কিনা সব শৌখিন জ্যোতির্বিদের জন্য দ্রষ্টব্য। এটি বাইনোকুলার দিয়ে দেখার জন্য একটা অন্যতম খগোল বস্তু। গ্রীষ্মের সময় এই সুন্দর স্তবকটা বলতে গেলে প্রায় মাথার ওপর দিয়ে যায়। এই মণ্ডলীর ছয়টি তারা নিয়ে দুটি আয়তক্ষেত্র চিন্তা করা যেতে পারে। দুটি আয়তক্ষেত্র একটি মানুষের আকৃতি দেবে। ওপরের আয়তক্ষেত্রের ও হারকিউলিসের মধ্যে একটা রেখা টানলে, থেকে এক-তৃতীয়াংশ দূরে ওই রেখাটির এক পাশে এই স্তবকটি দেখা যাবে। ২৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এই স্তবকটিতে প্রায় তিন লাখ তারা আছে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি স্তবকটি প্রায় মাথার ওপরে মধ্যরেখার কাছাকাছি থাকে। সেই জন্য সেটার দিকে বাইনোকুলার তাক করা একটু মুশকিল। তাই জুন বা আগস্ট মাসে একটু হেলানো অবস্থায় থাকলে স্তবকটা দেখতে সুবিধা হয়।
