চন্দ্রজয়ের দৌড়ে চীনের পেছনে পড়ার ভয়ে চুক্তি বাতিল হতে পারে স্পেসএক্সের
শেষবার মানুষ চাঁদে পা রেখেছিল ১৯৭২ সালে। অর্থাৎ, এখন থেকে প্রায় ৫৩ বছর আগের কথা! তারপর আর কেউ চাঁদে যায়নি। কিন্তু এখন আবার সবাই চাঁদে যেতে চায়। এই তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ১৯৭০-এর দশকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল, এখন সেখানে রাশিয়ার পরিবর্তে চীন ঢুকে পড়েছে। আবার দুটি দেশের মধ্যে শুরু হয়েছে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা।
সেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স। ২০২১ সালে নাসা স্পেসএক্সের সঙ্গে একটা বড় চুক্তি করে। সে চুক্তি ছিল প্রায় ২৯০ কোটি ডলারের! বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে মাথা ঘুরে যাবে। চুক্তিটা কীসের? স্পেসএক্সকে একটা বিশেষ যান বানাতে হবে, যেটা নভোচারীদের চাঁদের মাটিতে নামিয়ে দেবে। এই যানের নাম স্টারশিপ। আসলে এটা একটা মেগারকেটের ওপরের অংশকে একটু বদলে নেওয়া হয়েছে। খুব বড় আর শক্তিশালী এই রকেট।
নাসার পরিকল্পনা ছিল, আর্টেমিস ৩ নামের একটা মিশনে এই স্টারশিপ ব্যবহার করবে। এটাই হবে অনেকদিন পর প্রথম চাঁদে মানুষ পাঠানোর মিশন। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ, স্পেসএক্স যথেষ্ট দ্রুত কাজ করতে পারছে না। তাদের স্টারশিপ এখনো পুরোপুরি তৈরি নয়। এখনো চলছে পরীক্ষামূলক উড়ানো। এতেই নাসা এখন অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে। কারণ বেশি দেরি করলে তো চীন যুক্তরাষ্ট্রের আগে চাঁদে পৌঁছে যাবে। ভাবতে পারেন, চীন আগে চাঁদে গেলে কি সমস্যা? আমার আপনার সমস্যা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: নতুন মহাকাশ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আগে চীন চাঁদে নভোচারী পাঠালে কী হবে
নাসার পরিকল্পনা ছিল, আর্টেমিস ৩ নামের একটা মিশনে এই স্টারশিপ ব্যবহার করবে। এটাই হবে অনেকদিন পর প্রথম চাঁদে মানুষ পাঠানোর মিশন।
গত ২০ অক্টোবর নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শন ডাফি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার বলেছেন, ‘আমি স্পেসএক্সকে ভালোবাসি। এটা দারুণ একটা কোম্পানি। কিন্তু সমস্যা হলো, তারা পিছিয়ে আছে। তারা তাদের সময়সূচি বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা তো চীনের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতায় আছি।’
তিনি আরো বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট আর আমি চাই এই প্রেসিডেন্টের মেয়াদেই চাঁদে পৌঁছাতে। তাই আমি চুক্তিটা সবার জন্য উন্মোক্ত করে দেব। ব্লু অরিজিনের মতো অন্য কোম্পানিগুলোকেও সুযোগ দেব স্পেসএক্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার।’
ব্লু অরিজিন নামটাও হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন। এই কোম্পানিটা বানিয়েছেন জেফ বেজোস। আমাজন কোম্পানির মালিক। তিনিও মহাকাশ নিয়ে খুব আগ্রহী। ২০২৩ সালে নাসা ব্লু অরিজিনকেও একটা চুক্তি দিয়েছিল। সেটা আরো বড়, ৩৪০ কোটি ডলারের! তাদের কাজ হলো ব্লু মুন নামে একটা ল্যান্ডার বানানো। মূল পরিকল্পনা ছিল আর্টেমিস ৫ মিশনে এটা ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এখন যদি স্পেসএক্স আরও দেরি করে, তাহলে হয়তো ব্লু অরিজিনকেই আর্টেমিস ৩ মিশনে সুযোগ দেওয়া হবে।
তবে ইলন মাস্ক এতে খুশি নন। খুশি হওয়ার কথাও নয়। তিনি এক্সে লিখেছেন, ‘ব্লু অরিজিন কখনো কোনো পেলোড কক্ষপথে পাঠায়নি, চাঁদে তো দূরের কথা।’ পরে তিনি আরেকটু যোগ করেছেন, ‘ব্যবহারযোগ্য পেলোডের কথা বলছি।’
আসলে ব্লু অরিজিনের নিউ গ্লেন নামে একটা বিশাল রকেট আছে। এই বছরের জানুয়ারিতে সেটা প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে উড়ানো হয়েছিল। পৃথিবীর কক্ষপথে একটা প্রোটোটাইপ মহাকাশযান পাঠিয়েছিল ওটার সাহায্যে। তবে সেটাই এখন পর্যন্ত তাদের একমাত্র উড়ানোর রেকর্ড।
ইলন মাস্ক এক্সে লিখেছেন, ‘ব্লু অরিজিন কখনো কোনো পেলোড কক্ষপথে পাঠায়নি, চাঁদে তো দূরের কথা।’ পরে তিনি আরেকটু যোগ করেছেন, ‘ব্যবহারযোগ্য পেলোডের কথা বলছি।’
এদিকে আর্টেমিস-৩ মিশনের তারিখ অনেকবার পিছিয়েছে। এতে সব দোষ শুধু স্পেসএক্সের নয়। নাসার স্পেসস্যুট বানাতেও সমস্যা হচ্ছিল। নাসার ওরিয়ন ক্যাপসুলেও আছে কিছু সমস্যা। আরও অনেক প্রযুক্তিগত জিনিস আছে যেগুলো ঠিক করা এখনো বাকি।
প্রথমে পরিকল্পনা ছিল ২০২৪ সালের শেষের দিকে আর্টেমিস ৩ উড়বে। তারপর সেটা হলো ২০২৫। তারপর ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর। এরপর ২০২৭ সালের মাঝামাঝি। সম্প্রতি শন ডাফি জানালেন, ২০২৮ সালের কথা ভাবছেন তাঁরা!
এখানে আরও একটু জানিয়ে রাখি, ওরিয়ন ক্যাপসুলটা আসলে নভোচারীদের চাঁদের কক্ষপথ পর্যন্ত নিয়ে যাবে। সেখানে তারা স্টারশিপ বা অন্য কোনো ল্যান্ডারে উঠবে। তারপর সেই ল্যান্ডার তাদের নামিয়ে দেবে চাঁদের মাটিতে।
এবার আর্টেমিস প্রোগ্রাম নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। কারণ এই সবকিছু শেষ পর্যন্ত আর্টেমিস প্রোগ্রাম নিয়েই। আর্টেমিস হলো নাসার একটা বড় প্রোগ্রাম। এর লক্ষ্য মানুষকে আবার চাঁদে পাঠানো। শুধু তাই নয়, এবার চাঁদে একটা স্থায়ী ঘাঁটিও বানাবে তারা; যাতে নভোচারীরা সেখানে কিছুদিন থাকতে পারে এবং গবেষণা করতে পারে।
এখন পর্যন্ত আর্টেমিস প্রোগ্রামের একটা মিশন সফল হয়েছে। সেটা হলো আর্টেমিস ১। ২০২২ সালের শেষের দিকে সেই মিশনে কোনো মানুষ ছাড়াই ওরিয়ন ক্যাপসুল চাঁদের চারদিকে ঘুরে এসেছিল। সব ঠিকঠাক কাজ করেছিল। পরের মিশন হলো আর্টেমিস ২। এটাতে চারজন নভোচারী থাকবে। তারা চাঁদের চারপাশে ১০ দিনের একটা ভ্রমণ করবে, কিন্তু চাঁদে নামবে না। শুধু ঘুরে আবার চলে আসবে। এই মিশনটা আগামী বছর, মানে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে।
আর্টেমিস হলো নাসার একটা বড় প্রোগ্রাম। এর লক্ষ্য মানুষকে আবার চাঁদে পাঠানো। শুধু তাই নয়, এবার চাঁদে একটা স্থায়ী ঘাঁটিও বানাবে তারা; যাতে নভোচারীরা সেখানে কিছুদিন থাকতে পারে এবং গবেষণা করতে পারে।
তবে স্পেসএক্স কিন্তু বসে নেই। তারা তাদের স্টারশিপ রকেট নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১১টা পরীক্ষামূলক উড়ান হয়েছে। তবে এগুলো সাবঅরবিটাল, মানে পুরো কক্ষপথে যায়নি। পৃথিবীর ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আবার নেমে এসেছে।
শেষ দুটো উড়ান খুব ভালো হয়েছে। একটা আগস্ট মাসের ২৬ তারিখে, আরেকটা অক্টোবরের ১৩ তারিখে। দুটোই পুরোপুরি সফল হয়েছে। মানে রকেট ঠিকভাবে উড়েছে, ঠিকভাবে নেমেছে। এটা অবশ্যই ভালো খবর।
তবে চাঁদে মানুষ নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও অনেক পরীক্ষা করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে আরও অনেক কিছু। এতেই স্পেসএক্সের সময় লাগছে।
তা বলে চীন কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। তারাও চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের পরিকল্পনা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে তাদের নভোচারী পাঠানো। আর তারা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যই আমেরিকার এত তাড়া। তারা চায় চীনের আগে চাঁদে পৌঁছাতে। এটা একরকম প্রতিযোগিতা হয়ে গেছে। অনেকটা পুরনো দিনের মতো, যখন আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করেছিল।
