পৃথিবীর বাইরে কেমন শোনাবে আপনার কণ্ঠস্বর
কল্পনা করুন, আপনি মঙ্গল, শুক্র কিংবা শনির উপগ্রহ টাইটানের পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে কোনো স্পেসস্যুট নেই! যদিও বাস্তবে এটা অসম্ভব, কিন্তু কল্পনায় তো দোষ নেই। এখন ধরুন, আপনি কথা বলার চেষ্টা করছেন। আপনার কি মনে হয়, পৃথিবীর মতোই শোনাবে আপনার গলার স্বর? মোটেই না!
শব্দ আসলে একধরনের যান্ত্রিক তরঙ্গ। এটি চলাচলের জন্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। আর এই মাধ্যমের ঘনত্বের ওপরই নির্ভর করে শব্দের গতি এবং প্রকৃতি। মহাশূন্য বা শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে শব্দ চলতে পারে না। তবে অন্য গ্রহের বায়ুমণ্ডল যেহেতু পৃথিবীর মতো নয়, তাই সেখানে শব্দের আচরণও বেশ অদ্ভুত।
সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া আরও তিনটি জায়গা আছে, যেখানে শব্দ চলাচলের জন্য বায়ুমণ্ডল যথেষ্ট ঘন। এগুলো হলো শুক্র গ্রহ, মঙ্গল গ্রহ এবং শনির বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান।
শুক্র গ্রহের পরিবেশকে নরকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এখানে রয়েছে সিসা গলে যাওয়ার মতো তাপমাত্রা। আর এমন প্রচণ্ড চাপ থাকে, যা মুহূর্তেই একজন মানুষকে চ্যাপ্টা করে দিতে পারে। কিন্তু আমরা যেহেতু কল্পনা করছি, তাই ধরে নিচ্ছি আমরা সেখানে নিরাপদেই আছি।
পৃথিবীতে উচ্চতা ও তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে শব্দের গতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৪০ মিটার। ১৯৮০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দুটি মিশন ভেনেরা ১৩ ও ১৪ শুক্র গ্রহে শব্দের গতি পরিমাপ করেছিল। সেখানে শব্দের গতি পাওয়া গিয়েছিল সেকেন্ডে প্রায় ৪১০-৪২০ মিটার, যা পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি।
শব্দ আসলে একধরনের যান্ত্রিক তরঙ্গ। এটি চলাচলের জন্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। আর এই মাধ্যমের ঘনত্বের ওপরই নির্ভর করে শব্দের গতি এবং প্রকৃতি।
২০১২ সালে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাজ্যের সাউথহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম লেইটন। শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত ঘন। এই গ্রহে কথা বলার সময় আমাদের স্বরতন্ত্রী বা ভোকাল কর্ড খুব ধীরে কম্পিত হবে। ফলে গলার স্বর হয়ে যাবে খুব ভারী বা গম্ভীর। কিন্তু শব্দের গতি সেখানে বেশি হওয়ায় আমাদের মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হবে। সব মিলিয়ে আপনার গলার স্বর শোনাবে গম্ভীর।
২০০৫ সালে ক্যাসিনি মিশনের হাইজেনস প্রোব শনির উপগ্রহ টাইটানে অবতরণ করে। টাইটানের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর চেয়ে ঘন, কিন্তু অনেক বেশি ঠান্ডা। সেখানে শব্দ পৃথিবীর চেয়ে ধীরগতিতে চলে, সেকেন্ডে প্রায় ১৯৪ থেকে ২০০ মিটারের মতো। ফলে সেখানে কথা বললে আপনার কণ্ঠস্বর বেশ অদ্ভুত ও দীর্ঘায়িত মনে হতে পারে।
পৃথিবীর বাইরে মঙ্গলেই আমরা শব্দের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তথ্য পেয়েছি। নাসার পারসিভারেন্স রোভার প্রথমবারের মতো মঙ্গলে ধূলিঝড় এবং লেজারের শব্দ রেকর্ড করেছে। ২০২২ সালে পারসিভারেন্স রোভারের সাহায্যে জানা গেছে, মঙ্গলে শব্দের গতি সেকেন্ডে প্রায় ২৪০ মিটার, যা পৃথিবীর চেয়ে কম। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ১ শতাংশ ঘন।
টাইটানের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর চেয়ে ঘন, কিন্তু অনেক বেশি ঠান্ডা। সেখানে শব্দ পৃথিবীর চেয়ে ধীরগতিতে চলে, সেকেন্ডে প্রায় ১৯৪ থেকে ২০০ মিটারের মতো।
অর্থাৎ পৃথিবীর তুলনায় খুব পাতলা। এই পাতলা বায়ুমণ্ডলে উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ দ্রুত হারিয়ে যায়। শুধু নিচু স্বর বা ভারী শব্দ শোনা যায়। অনেকটা দূর থেকে শোনা ডাইনোসরের গর্জনের মতো। সেখানে আপনার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে মনে হবে, দেয়ালের ওপাশ থেকে ফিসফিস করে কথা বলছেন।
এরপর আসা যাক গ্রহরাজ বৃহস্পতির কথায়। এই গ্রহে কোনো শক্ত পৃষ্ঠ নেই, কিন্তু এর কেন্দ্রে ঘনত্ব ও চাপ অকল্পনীয়। এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসে ভর্তি। তাই বৃহস্পতিকে গ্যাসীয় দানব বলা হয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, বৃহস্পতির কেন্দ্রের প্রচণ্ড চাপে ধাতব হাইড্রোজেনের স্তরে শব্দের গতি তাত্ত্বিকভাবে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে পারে। এই গতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার! এটি হীরার মধ্য দিয়ে শব্দের গতির দ্বিগুণ এবং পৃথিবীর বাতাসের গতির চেয়ে ১০০ গুণ।