বিদ্যুতের খুঁটিতে গুনগুন শব্দ শোনা যায় কেন
রাস্তার ধারে ইলেকট্রিক খুঁটি বা ট্রান্সফরমারের কাছে গেলে অনেক সময় অদ্ভুত গুনগুন শব্দ শোনা যায়। এই শব্দ বেশি শোনা যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ প্লান্টের কাছে গেলে। কখনো মৃদু শব্দ আবার কখনো বেশ জোরালো। অনেকে এই শব্দকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেন। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এমন শব্দ কেন হয়? তারচেয়েও বড় কথা, এই শব্দ কি কোনো বিপদের লক্ষণ?
বিদ্যুৎ যে গুনগুন শব্দ করে, তাকে কারিগরি ভাষায় বলা হয় ‘মেইনস হাম’। এই শব্দ উৎপন্ন হয় বিদ্যুতের উৎপাদন পদ্ধতির কারণে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, সেটি আসলে অল্টারনেটিং কারেন্ট বা এসি। এই এসি কারেন্ট এক ধরনের বিদ্যুৎ প্রবাহ যা সময়ের সঙ্গে নিজের দিক ও মান উভয়ই পরিবর্তন করে। কারেন্টের দিক পরিবর্তনের ফলে ট্রান্সফরমারের চৌম্বকীয় অংশে কম্পন হয়। আর সেই কম্পন থেকেই শোনা যায় গুনগুন শব্দ।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমাদের বাসা-বাড়িতে আসার সময় বিদ্যুৎকে উচ্চ ভোল্টেজ থেকে কমিয়ে আনার জন্য ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা হয়। এটি বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকে রক্ষা করে।
প্রতি সেকেন্ডে কারেন্ট কতবার দিক পরিবর্তন করে, তা প্রতিটি দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে বিদ্যুৎ প্রতি সেকেন্ডে ৬০ বার দিক বদলায়। একে বলা হয় ৬০ হার্জ। বাংলাদেশেসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এই পরিবর্তনের হার ৫০ বার প্রতি সেকেন্ডে। অর্থাৎ ৫০ হার্জ। বিদ্যুতের দ্রুত দিক পরিবর্তনের কারণেই আমরা এই গুনগুন শব্দ শুনতে পাই।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের রাইস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গ্যারি উডস জানান, ‘বিদ্যুতের যে গুনগুন শব্দ শোনা যায় তা সাধারণত এসি পাওয়ারের ফ্রিকোয়েন্সির প্রায় দ্বিগুণ। যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু এসি পাওয়ার ৬০ হার্জ, তাই সেখানে গুনগুন শব্দ হয় ১২০ হার্টজে। আর অন্যান্য দেশে ৫০ হার্জ হওয়ায় শব্দ হয় ১০০ হার্টজে।’
কিন্তু কোন জিনিসের কম্পনের কারণে এমন শব্দ তৈরি হয়? এই শব্দ সাধারণত কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ভেতরের চৌম্বকীয় অংশ থেকে আসে। বিদ্যুতের খামের কাছে থাকলে যে শব্দ শোনা যায়, তা আসে ট্রান্সফরমার থেকে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমাদের বাসা-বাড়িতে আসার সময় বিদ্যুৎকে উচ্চ ভোল্টেজ থেকে কমিয়ে আনার জন্য ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা হয়। এটি বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকে রক্ষা করে। একটি ট্রান্সফরমারের ভেতরে একটি ইন্ডাক্টর থাকে। এটি চৌম্বকীয় অংশ। মূলত লোহার একটি টুকরোর চারপাশে তার জড়ানো থাকে। প্রতিটি ট্রান্সফরমারের ভেতরেই এটি থাকে। যখন অল্টারনেটিং কারেন্ট বা এসি কারেন্ট এই ইন্ডাক্টরের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এটি দ্রুত কম্পন তৈরি করে। ফলে আমরা গুনগুন শব্দ শুনতে পাই।
যখন কোনো পাওয়ার লাইনের চারপাশের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়, তখন এটি আশপাশের বাতাসকে আয়নিত করে। বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়।
যেকোনো ইলেকট্রনিক্স থেকে গুনগুন শব্দ শুনতে পাওয়ার কারণ হলো, যন্ত্রপাতির ভেতরে থাকা তড়িৎচুম্বক। এই চৌম্বকীয় অংশগুলোকে ছোট চুম্বকের মতো ভাবতে পারেন। যখন বৈদ্যুতিক শক্তি এগুলোতে যায়, তখন এরা প্রতি সেকেন্ডে ৬০ বার অন ও অফ হয়। এই কারণেই এরা সামান্য কেঁপে ওঠে ও শব্দ করে। ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব থেকে শুরু করে ওভেনের মতো সব ধরনের ইলেকট্রনিক্সেই এমনটা ঘটে।
তবে পাওয়ার লাইনগুলো যে গুনগুন শব্দ হয়, এর কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। একে বলা হয় করোনা ডিসচার্জ। যখন কোনো পাওয়ার লাইনের চারপাশের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়, তখন এটি আশপাশের বাতাসকে আয়নিত করে। বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়। এই বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে এক ধরনের শক্তি নির্গমন ঘটে। তখন গুনগুন শব্দ তৈরি হয়।
যদি করোনা ডিসচার্জ হয়, তাহলে এটি বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ, এটি ওজোনের মতো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে। যদিও বেশিরভাগ আধুনিক পাওয়ার লাইন এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন এই সমস্যা না হয়, বিশেষ করে শুষ্ক আবহাওয়ায়।
যদি কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আগে কখনো শব্দ না করে হঠাৎ করে গুনগুন করা শুরু করে, আর সেই শব্দ দিন দিন আরও বাড়তে থাকে, তাহলে সম্ভবত যন্ত্রটির ভেতরের কোনো যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে চলেছে।