একবার সার্চ করলে এআই চ্যাটবটের বিদ্যুৎ খরচ কত

চ্যাটজিপিটির মতো অন্যান্য চ্যাটবটকে প্রশিক্ষণ দিতে অনেক বিদ্যুৎ খরচ হয়রয়টার্স

যেকোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এখন অনেকেই গুগলের পরিবর্তে চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির মতো চ্যাটবট ব্যবহার করে। কোনো প্রশ্ন করার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্তারিত তথ্য চলে আসে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের ফলাফল দেখানোর জন্য এর পেছনে কতটা বিদ্যুৎ খরচ হয়? আসলে বিদ্যুৎ খরচ হয় আপনার ধারণার চেয়েও বেশি। ঠিক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, চলুন তা জানার চেষ্টা করি।

ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান চলতি বছর জুলাইয়ে জানিয়েছেন, ‘প্রতিদিন চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীরা ২৫০ কোটিরও বেশি প্রশ্ন বা অনুরোধ করছেন।’ মাত্র কয়েক মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ কোটি। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, খুব অল্প সময়ে চ্যাটজিপিটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ওপেনএআইয়ের তথ্যমতে, প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ কোটির বেশি প্রম্পট দেওয়া হয় এবং বাকিগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আসে।

আরও পড়ুন
জিপিটি ৫ মডেল
রয়টার্স

২০২৩ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এআইয়ের বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত ডেটা সেন্টারগুলো দেশটির মোট বিদ্যুতের ৪.৪ শতাংশ খরচ করেছে। আর সারা বিশ্বে এআইয়ের অন্যান্য ডেটা সেন্টারগুলো মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ১.৫ শতাংশ ব্যবহার করে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি করতে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ খরচ হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। মানুষ এখন শুধু সার্চ বা প্রশ্নের উত্তর জানতে এআই ব্যবহার করেন না। ছবি তৈরি, ভিডিও এডিট ও আরও নানা কাজে এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এর চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। আর এ কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এআইয়ের জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার অন্তত দ্বিগুণ হবে।

আরও পড়ুন

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এআই চ্যাটবটগুলো এত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কেন? এর প্রধান কারণ, এআইকে শেখানো ও কাজ করানোর জন্য অনেক বেশি তথ্যের প্রয়োজন হয়। এতে বিদ্যুৎ খরচ হয় অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের কম্পিউটার বিজ্ঞানী মোশারফ চৌধুরী জানান, ‘এআইয়ের দুটি কাজ সবচেয়ে বেশি শক্তি ব্যবহার করে। একটি হলো প্রশিক্ষণ, অন্যটি উত্তর তৈরি করা।’

জেমিনি এআই
রয়টার্স
আরও পড়ুন

সহজ কথায় বললে, একটি এআই চ্যাটবট মূলত দুটি ধাপে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। প্রথমত, একে যখন বিপুল তথ্য দিয়ে শেখানো হয়, তখন অনেক শক্তি খরচ হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রশিক্ষণ। এ ধরনের বড় এআই মডেলগুলো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (LLM) নামে পরিচিত। এই বিপুল পরিমাণ তথ্যের মাধ্যমে এআই শেখে ও ব্যবহারকারীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য অনুমান করতে পারে। দ্বিতীয়ত, যখন এটি ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে, তখনো অনেক শক্তি লাগে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইনফারেন্স। এআই প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটি মডেল যত বেশি তথ্য দিয়ে শেখানো হয়, ততই সেটি ভালো উত্তর বা ফলাফল দিতে পারে। আর এ কারণে এর জন্য আরও বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন।

এই ব্যাপারে কম্পিউটার বিজ্ঞানী মোশারফ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে এআই মডেলগুলো এতই বড় হয়ে গেছে যে, সেগুলো মাত্র একটি জিপিইউ বা সার্ভারে রাখা যায় না। এগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একাধিক শক্তিশালী কম্পিউটার একসঙ্গে কাজ করে যাতে একসঙ্গে অনেক তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে।’

আরও পড়ুন

এআই মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে কী পরিমাণ শক্তি খরচ হয় তা জানার আগে জানা দরকার, এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কি পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে। একটি এনভিডিয়া ডিজিএক্স এ১০০ সার্ভারের মতো শক্তিশালী কম্পিউটার প্রায় ৬.৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এমন একাধিক সার্ভার লাগে। প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া টানা কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে চলে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। চ্যাটজিপিটি-৪ মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে ৫০ গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ লেগেছিল। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরের সব মানুষকে তিন দিন বিদ্যুৎ সেবা দেওয়া যেত।

এরপর এআই যা শিখেছে, তা কাজে লাগিয়ে একটি প্রম্পট বা তথ্য জানানোর অনুরোধের ওপর ভিত্তি করে উত্তর তৈরি করে। যদিও একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল প্রশিক্ষণের চেয়ে উত্তর দেওয়ার সময় কম শক্তি ব্যবহার করে। তবুও একদিনে ২৫০ কোটির বেশি প্রম্পট দেওয়ার কারণে এই ইনফারেন্স প্রক্রিয়ায় প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। এখানে শুধু চ্যাটজিপিটির পরিসংখ্যান দেওয়া হলেও বিদ্যুৎ খরচের হিসাব যদি গুগলের জেমিনির মতো অন্যান্য জনপ্রিয় চ্যাটবটগুলোকেও ধরা হয়, তাহলে মোট পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।

কম্পিউটার বিজ্ঞানী মোশারফ চৌধুরী

কম্পিউটার বিজ্ঞানী মোশারফ চৌধুরীর মতো বিজ্ঞানীরা এখন এই বিপুল শক্তির চাহিদা কীভাবে কমানো যায়, তা বোঝার জন্য কাজ করছেন। তাঁরা এআইয়ের বিদ্যুৎ খরচ আরও ভালোভাবে পরিমাপ করার চেষ্টা করছেন। মোশারফ চৌধুরী একটি ‘এমএল এনার্জি লিডারবোর্ড’ তৈরি করেছেন, যা ওপেনসোর্স এআই মডেলগুলোর বিদ্যুৎ খরচ ট্র্যাক করে।

তবে অন্যান্য জনপ্রিয় এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর বিদ্যুৎ খরচের সঠিক তথ্য বেশিরভাগ সময়ই জানা যায় না। গুগল, মাইক্রোসফট ও মেটার মতো বড় কোম্পানিগুলো এই সংখ্যাগুলো গোপন রাখে। অথবা তারা এমন কিছু তথ্য দেয় যা এই অ্যাপ্লিকেশনগুলোর প্রকৃত প্রভাব সম্পর্কে খুব কম ধারণা পাওয়া যায়। ফলে এআই আসলে কতটা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তা নির্দিষ্টভাবে সংখ্যায় প্রকাশ করা কঠিন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স