মহাকাশ স্টেশনে কি মহাকর্ষ বল শূন্য

মহাকাশ স্টেশনে মহাকর্ষ বল নেই, এটা ডাহা মিথ্যা কথা! সেখানেও পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ মহাকর্ষ বল কাজ করে। তাহলে নভোচারীরা পাখির মতো ভাসে কেন? কেন স্টেশনটি ধপাস করে পৃথিবীতে পড়ে যায় না?

মহাকাশ স্টেশনে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ মহাকর্ষ বল কাজ করেকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা সহজেই ভেসে বেড়ান। তাঁদের জিনিসপত্রও ভাসে। কেন? বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন, সেখানে মহাকর্ষীয় টান শূন্য। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের মান শূন্য, তাই মানুষ বা অন্য যেকোনো কিছু সেখানে ভেসে থাকতে পারে।

এই ধারণাটা কিন্তু একেবারেই ভুল। মহাকাশ স্টেশনে মহাকর্ষ বলের মান পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা কম, কিন্তু শূন্য নয়। তেমনি মহাকাশে যে স্যাটেলাইট ঘুরছে, সেগুলো মাটিতে পড়ে যাচ্ছে না, এর কারণও এই নয় যে সেখানে মহাকর্ষ বল শূন্য। তাহলে কেন পড়ে যাচ্ছে না? 

এটা বোঝার আগে আরেকটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলে, দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে, তাদের মধ্যকার মহাকর্ষীয় টান কমে, দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে। অর্থাৎ বস্তু দুটির দূরত্ব বেড়ে যদি দ্বিগুণ হয়, মহাকর্ষীয় টানের মান কমবে চার গুণ। দূরত্ব বেড়ে তিন গুণ হলে মহাকর্ষ বলের মান কমবে ৯ গুণ।

তাই পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুর দূরত্ব যত বেশি, মহাকর্ষ বলের মানও সেখানে তত কম। কিন্তু একেবারে শূন্য হবে না। কারণ মহাকর্ষ বলের সীমা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই মহাকাশ স্টেশন কিংবা স্যাটেলাইটগুলোর ওপর মহাকর্ষীয় টান মোটেও শূন্য নয়। 

মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন পড়ে যায় না? এবার আসা যাক সেই উত্তরে। আসলে এগুলো পড়ছে। সব সময় পড়ছে। কিন্তু একটুও নিচে নামছে না। ব্যাপারটা উদ্ভট মনে হতে পারে। এর পেছনে কাজ করছে প্রচণ্ড গতি। মহাকাশ স্টেশন বা স্যাটেলাইট  প্রচণ্ড গতিতে ঘোরে। আসলে এগুলো সোজাসুজি ছোটে। সোজাসুজি ছুটলে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সোজা মহাশূন্যে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু যাচ্ছে না পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টানের কারণে।

আরও পড়ুন
মহাশূন্য স্টেশনের গতিশক্তি একে সোজাপথে চালাতে চায়, কিন্তু পৃথিবীর মহাকর্ষ বল স্টেশনকে নিচের দিকে টানছে। এই দুই বলের লব্ধি বা ফলাফলের কারণেই স্পেস স্টেশন কোনো দিকেই যেতে পারছে না।

মহাকর্ষ বল স্পেস স্টেশনকে নিচের দিকে টানছে, ওদিকে স্পেস স্টেশন দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও স্টেশনকে যেকোনো এক দিকে যাওয়ার কথা। হয় পৃথিবীর দিকে পড়বে, নইলে ছুটে মহাশূন্যের দিকে পালাবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।

সহজ করে বললে, মহাশূন্য স্টেশনের গতিশক্তি একে সোজাপথে চালাতে চায়, কিন্তু পৃথিবীর মহাকর্ষ বল স্টেশনকে নিচের দিকে টানছে। এই দুই বলের লব্ধি বা ফলাফলের কারণেই স্পেস স্টেশন কোনো দিকেই যেতে পারছে না। সে পৃথিবীর বক্রতা মেনে তার কক্ষপথে ঘুরছে। স্যাটেলাইটগুলোও এ কারণে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। চাঁদও একই কারণে ঘুরছে।

তাহলে মানুষ ভাসে কেন? ধরা যাক, একজন নভোচারীকে স্পেসস্যুট পরিয়ে মহাকাশ স্টেশনের কাছে পাঠানো হলো। তাঁকে মহাশূন্য স্টেশনে না ঢুকিয়ে স্টেশনের ঠিক পেছনে ছেড়ে দেওয়া হলো। তারপর তাঁকে গতিশীল করা হলো মহাশূন্য স্টেশনের সমান গতিতে। তিনিও সামনে ছুটতে চাইবেন, মহাকর্ষ বলও তাঁকে একইভাবে নিচের দিকে টানতে থাকবে। ফলে স্পেস স্টেশনের মতো তিনিও ঘুরতে থাকবেন।

একজন নভোচারীকে স্পেসস্যুট পরিয়ে মহাকাশ স্টেশনের কাছে পাঠানো হলে কী হবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি

অর্থাৎ দুই বলের পাল্লায় পড়ে স্টেশনের মতো নভোচারীও সমান বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবেন এবং শূন্যে ভাসবেন। নভোচারীর গতি আর মহাকাশ স্টেশনের গতি সমান বলে নভোচারীর সঙ্গে স্টেশনের সমান দূরত্ব থাকবে, তাঁদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হবে না।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মুক্তপতন। মহাকাশ স্টেশন এবং এর ভেতরের নভোচারী একই গতিতে পৃথিবীর দিকে সব সময় পড়ছেন।

এখন যদি নভোচারীকে মহাশূন্য স্টেশনের সামনে বা পেছনে না রেখে নভোযানের ভেতরেই ছেড়ে দেওয়া হয় এবং নভোচারী ও স্পেস স্টেশনের বেগ সমান হয়, তাহলে কী হবে? স্পেস স্টেশনের বাইরে তিনি যেমন ভেসে ছিলেন, ভেতরেও ভেসে থাকবেন। গতি এক বলে স্টেশনের ভেতরের কোনো দেয়ালে বাড়ি খাবেন না। আবার তাঁর ওপর দুই দিকে ক্রিয়াশীল দুটি বল সমান বলে তিনি নিচের দিকেও একচুল নামবেন না। 

বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মুক্তপতন। মহাকাশ স্টেশন এবং এর ভেতরের নভোচারী একই গতিতে পৃথিবীর দিকে সব সময় পড়ছেন। কিন্তু পৃথিবীর গোলকাকার আকৃতির কারণে তাঁরা মাটিতে আছড়ে না পড়ে অনবরত ঘুরছেন। যেহেতু স্টেশন এবং নভোচারী একই হারে পড়ছেন, তাই নভোচারীর মনে হয় তিনি ভাসছেন।

এরপরও নভোচারীদের দেখা যায়, তাঁরা দেয়াল ধরে হাঁটছেন বা উড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন। এসব করার জন্য তাঁরা শারীরিক শক্তি ব্যবহার করেন। এখন যদি নভোচারীর বদলে একটা পাথরের টুকরোকে একইভাবে স্পেস স্টেশনে রেখে আসেন, তাহলে সেটাও একইভাবে ভাসবে। কিন্তু এসবের অর্থ এই নয় যে, স্পেস স্টেশনে বা স্যাটেলাইটের কক্ষপথে মহাকর্ষ বলের মান শূন্য। স্রেফ মহাকর্ষের টানে মুক্তপতনের কারণেই স্টেশনের ভেতরে তিনি ভাসছেন।

সূত্র: অল অ্যাবাউট স্পেস

আরও পড়ুন