বিশ্বের সবচেয়ে ছোট পেসমেকার

চালের দানার চেয়ে ছোট নতুন পেসমেকারছবি: এনডিটিভি

বিজ্ঞানীরা চালের দানার আকারের একটি পেসমেকার তৈরি করেছেন। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট  পেসমেকার। আলোর সাহায্যে চলবে এটি। তবে এ যন্ত্রটা কাজ করবে সাময়িক বা অস্থায়ী হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রক হিসেবে। ডিভাইসটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে অনায়াসে স্থাপন করা যাবে মানবদেহে। কাজ শেষে দ্রবীভূত হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। গত ২ এপ্রিল নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতির কথা প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বের ক্ষুদ্রতম এই পেসমেকার তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী। এই পেসমেকার লম্বায় মাত্র ৩.৫ মিলিমিটার, চওড়ায় ১.৮ মিলিমিটার এবং পুরুত্বে প্রায় ১ মিলিমিটার। চালের দানার চেয়েও ছোট এই ডিভাইসটি আকারে ক্ষুদ্র হলেও প্রচলিত পেসমেকারের মতোই কার্যকর বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।

চাঁদে পা রাখা প্রথম নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং ২০১২ সালে তাঁর পেসমেকার অপসারণের পর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে কারণে মারা যান।

যদিও মানুষের দেহে এর পরীক্ষা শুরু হতে এখনো কয়েক বছর বাকি। বিজ্ঞানীরা এই তারহীন পেসমেকারটিকে একটি ‘বৈপ্লবিক অগ্রগতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এটি।

পেসমেকার লম্বায় মাত্র ৩.৫ মিলিমিটার, চওড়ায় ১.৮ মিলিমিটার এবং পুরুত্বে প্রায় ১ মিলিমিটার

অনেকে ভাবতে পারেন, এত ছোট একটি পেসমেকার কেন প্রয়োজন? মূলত নবজাতক ও শিশুদের কথা মাথায় রেখেই এই সাময়িক ব্যবহার উপযোগী পেসমেকারটি তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ পেসমেকার ব্যবহার করেন। এটি হৃৎপিণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে স্পন্দিত রাখতে বৈদ্যুতিক সংকেত প্রদান করে। জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের শরীরে বড়দের পেসমেকার স্থাপন করা যেমন কঠিন, তেমনি অস্ত্রোপচারেও থাকে জটিলতা। এমন সমস্যার সমাধানে এই ক্ষুদ্র পেসমেকার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

আরও পড়ুন

নতুন এই ডিভাইসের উদ্ভাবক দল জানিয়েছে, জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত এক শতাংশ শিশুকে সাহায্য করার অনুপ্রেরণা থেকে এটি তৈরি করা হয়েছে, যাদের অস্ত্রোপচারের পর কয়েক সপ্তাহ অস্থায়ী পেসমেকারের প্রয়োজন হয়। পেসমেকারটি প্রাপ্তবয়স্কদের হার্ট সার্জারি থেকে সেরে ওঠার সময় স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন ফিরে পাওয়া পর্যন্ত সাহায্য করতে পারে।

পেসমেকারটি একটি গ্যালভানিক কোষ দিয়ে চালিত হয়, যা শরীরের তরল ব্যবহার করে রাসায়নিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে এবং সেই সংকেত হৃৎপিণ্ডকে উদ্দীপিত করে।

বর্তমানের পেসমেকার বসাতে হলে ছোট একটা অপারেশন করতে হয়। অস্থায়ী পেসমেকার স্থাপনের জন্য হৃৎপিণ্ডের পেশিতে ইলেকট্রোড* (বিদ্যুৎ পরিবাহী উপাদান) সেলাই করতে অস্ত্রোপচার করে। আর এই যন্ত্র চালানোর জন্য রোগীর বুকের বাইরে একটি যন্ত্রের সঙ্গে তারের সংযোগ করা হয়। যখন পেসমেকারের আর প্রয়োজন হয় না, তখন চিকিৎসকরা তারগুলো টেনে বের করে ফেলেন। এতে মাঝেমধ্যে রোগীদের ক্ষতি হয়। চাঁদে পা রাখা প্রথম নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং ২০১২ সালে তাঁর পেসমেকার অপসারণের পর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে কারণে মারা যান।

বর্তমানের পেসমেকার বসাতে হলে ছোট একটা অপারেশন করতে হয়
ছবি: সংগৃহীত

তবে নতুন উদ্ভাবিত এই পেসমেকারটি তারহীন। মাত্র এক মিলিমিটার পুরু ও ৩.৫ মিলিমিটার লম্বা হওয়ায় এটি একটি সিরিঞ্জের অগ্রভাগে সহজেই স্থাপন করা যায়। আর এটি এমন ভাবে নকশা করা যে কাজ শেষে তা শরীরে দ্রবীভূত হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুসারে, এই পেসমেকারটি রোগীর বুকের ওপর লাগানো একটি নরম প্যাচের সাহায্যে যুক্ত থাকে। যখন প্যাচটি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন শনাক্ত করে, তখন এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলোর ঝলকানি দেয়, যা পেসমেকারকে কখন হৃদস্পন্দন শুরু করতে হবে তা নির্দেশ করে। পেসমেকারটি একটি গ্যালভানিক কোষ দিয়ে চালিত হয়, যা শরীরের তরল ব্যবহার করে রাসায়নিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে এবং সেই সংকেত হৃৎপিণ্ডকে উদ্দীপিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত ইঁদুর, কুকুর এবং মানুষের হৃদপিণ্ডের কোষের ওপর পরীক্ষায় পেসমেকারটি কার্যকরভাবে কাজ করেছে।

মূলত নবজাতক ও শিশুদের কথা মাথায় রেখেই এই সাময়িক ব্যবহার উপযোগী পেসমেকারটি তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ পেসমেকার ব্যবহার করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জন রজার্স জানান, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই মানুষের শরীরে এই পেসমেকারের পরীক্ষা শুরু হতে পারে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তাঁর ল্যাব একটি স্টার্ট-আপ কোম্পানি চালু করেছে। রজার্স আশাবাদী, এই প্রযুক্তি মানব স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও অনন্য বায়োইলেক্ট্রনিক মেডিসিনে আরও অনেক সম্ভাবনার জন্ম দেবে।

নোট: *প্রাণিকোষ সাধারণত খুব স্পর্শকাতর ও নমনীয় হয়। তাই এর মধ্যে সরাসরি শক্ত বিদ্যুৎ পরিবাহী কিছু প্রবেশ করানো যায় না। তাতে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা দেহের মধ্যে ইলেকট্রোড (বিদ্যুৎ পরিবাহী উপাদান) তৈরির জন্য বিশেষ ধরনের জেল ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করান।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট, পপুলার সায়েন্স, সিবিএস নিইজ

আরও পড়ুন