জিহ্বা দেখেই রোগ বলে দেবে এআই
সাধারণত ডাক্তারের কাছে গেলে নাড়ি টিপে কিংবা স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পরীক্ষা করে রোগ বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু যদি এমন হয় যে, এর কোনোটিই না করে ডাক্তার শুধু জিহ্বা দেখেই রোগ বলে দিলেন! গল্প মনে হলেও, এটাই সত্যি! হাজার হাজার বছর ধরে ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা প্রাচীন চীনা চিকিৎসকরা ঠিক এই কাজটাই করে আসছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, জিহ্বার রং আর গঠন দেখেই শরীরের ভেতরের অনেক রোগ ধরে ফেলা যায়।
কিন্তু এই পদ্ধতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে আছে তুমুল বিতর্ক। চীনা চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন, জিহ্বার রং আমাদের শরীরের রক্ত এবং প্রাণশক্তির অবস্থা বলে দেয়। কিন্তু পশ্চিমা বা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই পদ্ধতিকে সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। তাদের যুক্তি, এই পরীক্ষাটা বড্ড বেশি খামখেয়ালি। কিন্তু কেন?
কারণ, একই জিহ্বা দেখে একজন চীনা ডাক্তার হয়তো বললেন, ‘জিহ্বা ফ্যাকাশে লাগছে’। আবার আরেকজন হয়তো বললেন, ‘না, এটা হলদেটে লাগছে।’ কিন্তু আসলে কোন ডাক্তারের চোখ ঠিক, তা মেপে দেখবে কে?
চীনা চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন, জিহ্বার রং আমাদের শরীরের রক্ত এবং প্রাণশক্তির অবস্থা বলে দেয়। কিন্তু পশ্চিমা বা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই পদ্ধতিকে সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, প্রাচীন চীনারা হয়তো ঠিকই ছিলেন। শুধু তাদের চোখ বা যন্ত্রটাই হয়তো একটু ভুল ছিল। তবে চোখের সেই সমস্যার সমাধান করবে এবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই।
অবশ্য এআইয়ের সাহায্যে কাজটা করতে গিয়েও বড় সমস্যায় পড়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সমস্যাটা হলো আলো! একজনের লাল জিহ্বার ছবি যদি আপনি হলুদ আলোতে তোলেন, তাহলে সেই জিহ্বাকে কমলা দেখাবে। আবার সাদা আলোতে তুললে দেখাবে গোলাপি। তাহলে এআই বুঝবে কীভাবে, আসল রং কোনটা?
এই সমস্যার এক দারুণ সমাধান বের করেছেন অস্ট্রেলিয়ার গবেষক জাভান চাহল ও তাঁর দল। তাঁরা একটি বিশেষ কিয়স্ক বা বাক্সের মতো যন্ত্র তৈরি করেছেন। এই বাক্সের ভেতরে আছে বিশেষ এলইডি বাতি। রোগী এই বাক্সে মাথা ঢুকিয়ে জিহ্বা বের করলে, ভেতরের ওই বাতিগুলো সবসময় একই রকম নিয়ন্ত্রিত আলো ফেলে। ফলে প্রতিবার জিহ্বার একদম নিখুঁত এবং আসল রঙের ছবি ওঠে!
বেষকেরা ইরাকের দুটি হাসপাতাল থেকে ৬০ জন রোগীর জিহ্বার ছবি নেন। এরপর এআইকে বললেন ওই ছবি দেখে রোগ ধরতে। ৬০টি ছবির মধ্যে ৫৮টিই এআই সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে!
এআই যেভাবে ডাক্তার হলো
এরপর শুরু হলো এআইয়ের ট্রেনিং। বিজ্ঞানীরা ৫ হাজার ২৬০টি জিহ্বার ছবি এআইকে দেখিয়ে শিখিয়েছেন, কোনটা লাল, কোনটা হলুদ, কোনটা সবুজ বা নীল, কোনটা ধূসর, সাদা বা গোলাপি। এর কিছু ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, আর কিছু নতুন তোলা হয়েছে।
ট্রেনিং শেষে এআই যখন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠল, তখন সে যা যা বলতে শুরু করল, তা এককথায় অবিশ্বাস্য! কোন রঙের জিহ্বা কেমন, তাও এআই বলে দিল।
সুস্থ জিহ্বা: সাধারণত গোলাপি রঙের হয়, তার ওপর একটা পাতলা সাদা আস্তরণ থাকে।
সাদাটে জিহ্বা: শরীরে আয়রনের ঘাটতি বা রক্তস্বল্পতা বোঝাতে পারে।
নীলচে-হলুদ আস্তরণ: ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়।
বেগুনি জিহ্বা ও পুরু আস্তরণ: নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে!
এই পরীক্ষা ৯৬ শতাংশ সফল ছিল! এআই কতটা ভালো কাজ করছে, তা পরীক্ষা করার জন্য গবেষকেরা ইরাকের দুটি হাসপাতাল থেকে ৬০ জন রোগীর জিহ্বার ছবি নেন। এরপর এআইকে বললেন ওই ছবি দেখে রোগ ধরতে। ৬০টি ছবির মধ্যে ৫৮টিই এআই সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে! অর্থাৎ, এর সফলতার হার ছিল ৯৬.৬ শতাংশ! এখন গবেষকরা এআইকে শুধু রং নয়, জিহ্বার আকার, ফাটল বা ঘা দেখে রোগ ধরতেও শেখাচ্ছেন।
বেনকাও নামে একটি এআই অ্যাপ ইতিমধ্যে চলে এসেছে। ব্যবহারকারীরা নিজেদের জিহ্বার ছবি আপলোড করলে, এআই সেই ছবি বিশ্লেষণ করে আপনাকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেবে।
তাহলে কি ডাক্তারের দিন শেষ
একদমই না! এখনই বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়বেন না! বিজ্ঞানীরা নিজেরাই এর সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। প্রথমত, প্রাচীন চীনা চিকিৎসাতেও জিহ্বা পরীক্ষা ছিল রোগ নির্ণয়ের অনেকগুলো ধাপের মধ্যে মাত্র একটি। শুধু জিহ্বা দেখে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, এই প্রযুক্তিকে সত্যিই কাজের বানাতে হলে লাখ লাখ জিহ্বার ছবির এক বিশাল ডেটাবেস এবং তাঁদের মেডিকেল হিস্ট্রি লাগবে। কারণ, এমন অনেক রোগই আছে, যার কোনো লক্ষণ জিহ্বায় দেখা যায় না! যেমন, আপনার পা ভেঙে গেল তা জিহ্বা দেখে বোঝা যাবে না।
তবে বেনকাও (BenCao) নামে একটি এআই অ্যাপ ইতিমধ্যে চলে এসেছে। ব্যবহারকারীরা নিজেদের জিহ্বার ছবি আপলোড করলে, এআই সেই ছবি বিশ্লেষণ করে আপনাকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেবে। তবে সাবধান! এই অ্যাপগুলো এখনই কোনো মেডিকেল ডায়াগনসিস বা রোগ নির্ণয় করছে না। ওটা শুধু ওয়েলনেস বা ভালো থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। কারণ, ডাক্তারি পরামর্শ দেওয়া অনেক বেশি জটিল এবং এর জন্য আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন।
কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট, কিছুদিন পরে হয়তো ফোনের ক্যামেরা শুধু সেলফি তোলার কাজে ব্যবহৃত হবে না, আপনার জিহ্বা দেখেই হয়তো বলে দেবে, ‘আজ আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি!’