কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বদলে যাচ্ছে প্রতিবন্ধীদের অলিম্পিক

সাইবাথলন রেসের পাইলট ওয়েন কোলম্বছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

ওয়েন কোলম্ব নামে আয়ারল্যান্ডের এক লোকের জীবন থমকে গিয়েছিল ১৯৯৩ সালে। মাত্র ২১ বছর বয়সে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিনি একটি খাদে পড়ে গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডের একটি হাড় ভেঙে যায় তাঁর। তিনি স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হাতের বাইসেপস ছাড়া শরীরের কোনো অংশ তিনি নাড়াতে পারতেন না। হাত তুলতে পারলেও নামানোর সক্ষমতা ছিল না। হাত নামানোর জন্য কাঁধ ঘুরিয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্য নিতে হতো। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর তিনি আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরে বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের কাজে যুক্ত হন। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন।

তাঁর সহকারী সিলভিয়া ফিলিপিয়েক প্রথমদিকে তাঁকে হুইলচেয়ারে তুলতেও অসুবিধায় পড়তেন। সময়ের সঙ্গে তাঁরা দুজনই নিজেদের মধ্যে মানিয়ে নেন। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে এই দুজন চলে যান ইংল্যান্ডের বাথ শহরে। সেখানে তাঁরা সাইব্যাথলন নামের বিশেষ এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। 

সাইব্যাথলন হলো প্রযুক্তিনির্ভর এক ধরনের অলিম্পিক। এই অলিম্পিকে প্রতিবন্ধী অংশগ্রহণকারীরা প্রতিযোগিতা করেন। যাদের বলা হয় ‘পাইলট’। এই অলিম্পিকে পাইলটরা বাস্তব জীবনের মতো কাজ করে দেখান। ভবিষ্যতের প্রতিবন্ধি মানুষদের জন্য সাহায্যকারী প্রযুক্তি কতটা কার্যকর হবে, তা পরীক্ষা করার জন্য এই অলিম্পিকের আয়োজন করা হয়।

সুইজারল্যান্ডের ক্লোটেনে ২০২৪ সাইবাথলনে ওয়েন কোলম্ব
ছবি: নিকোলা পিটারো/ইটিএইচ জুরিখ/সাইবাথলন

এই অলিম্পিক আয়োজন করে ‘ইটিএইচ জুরিখ’। এতে আটটি আলাদা বিভাগ আছে। কোনো বিভাগের প্রতিযোগিতায় কৃত্রিম হাত ব্যবহার করতে হয়, কোনোটিতে কৃত্রিম পায়ের প্রয়োজন হয়। কোনো বিভাগে আছে অন্ধদের জন্য বিশেষ ভিশন সিস্টেম। এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য হলো, প্রযুক্তি কীভাবে মানুষকে আরও স্বাধীন করতে পারে, তা যাচাই করে দেখা। সাইব্যাথলনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রোলান্ড সিগ্রিস্ট বলেছেন, ‘এটি প্রযুক্তির দৌড় না, এটি মানুষের স্বাধীনতার দৌড়।’ এখানে নায়ক হচ্ছে পাইলটরা, প্রযুক্তি নয়।

ওয়েন কোলম্ব প্রথম সাইব্যাথলন থেকেই অংশ নিচ্ছেন। তাঁর প্রতিযোগিতার নাম ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস বা বিসিআই। এই প্রতিযোগিতায় শরীর নড়ানো লাগে না। শুধু মস্তিষ্ক দিয়ে স্ক্রিনের কার্সর নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। যারা নিজেদের শরীর নাড়াতে পারেন না, তাঁদের জন্য এই প্রযুক্তি খুব সহায়ক হয়ে উঠছে। বিসিআই ব্যবহার করে গেম খেলা, ইন্টারনেট ব্যবহার করা, এমনকি নিজে হুইলচেয়ার চালানোও এখন সম্ভব হচ্ছে। 

আরও পড়ুন
সাইব্যাথলন হলো প্রযুক্তিনির্ভর এক ধরনের অলিম্পিক। এই অলিম্পিকে প্রতিবন্ধী অংশগ্রহণকারীরা প্রতিযোগিতা করেন। যাদের বলা হয় ‘পাইলট’।

মস্তিষ্কে যন্ত্র বসানো

২০২৪ সালের সাইব্যাথলনের জন্য কোলম্বকে প্রস্তুত করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব বাথের নিউরোটেকনোলজি অধ্যাপক ডেমিয়ান কয়েল। তিনি বৈদ্যুতিক মস্তিষ্কলেখচিত্রণ বা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফিভিত্তিক (ইইজি) মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস বিশেষজ্ঞ। এতে মাথার ওপরে ইলেকট্রোড বসানো হয়। কেউ মন থেকে কোনো দিকে যাওয়ার কথা ভাবলে মাথার যে অংশে সিগন্যাল তৈরি হয়, কম্পিউটার সেটি চিনতে পারে। 

তবে এতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। মাথার খুলির ভেতরের সঠিক সিগন্যাল সবসময় পাওয়া যায় না। তাই এর বিকল্প হলো ইমপ্লান্ট পদ্ধতি। ইলন মাস্কের নিউরোলিংক এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে। মস্তিষ্কে সরাসরি চিপ বসালে পরিষ্কার সিগন্যাল পাওয়া যায়। কিন্তু এই অপারেশন জটিল, ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কের কাজ আলাদা হওয়ায় একই ধরনের বিশ্লেষণ সবার ক্ষেত্রে কাজ নাও করতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অফ বাথে অনুশীলন করছেন মিস্টার কোলম্ব
ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

এখানে সাহায্য করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। অসংখ্য সিগন্যাল থেকে প্যাটার্ন খুঁজে বের করা এবং ব্যক্তিভেদে আলাদা সিগন্যাল বোঝার জন্য এআই খুব কার্যকর। তাই গবেষকরা একজন পাইলটের সঙ্গে দীর্ঘদিন অনুশীলন করেন। যেন তাঁর মস্তিষ্কের সঠিক ছন্দ জানা যায়।

কোলম্ব ২০১০ সাল থেকে মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করছেন। শুরুতে তিনি এটি পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন না। তবে পরে অধ্যাপক ডেমিয়ান কয়েল তাঁকে সাহায্য করেন। ধীরে ধীরে তাঁরা বুঝতে পারেন, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দুটি সংকেত হলো ডান এবং বাম। কোলম্বের ডান বাহু কল্পনায় নড়ানো মানেই ডানে সিগন্যাল দেওয়া। বাম বাহুর কল্পিত নড়াচড়া মানেই বাঁ দিকে যেতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এই দুই সংকেত দিয়েই পুরো নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

আরও পড়ুন
কোলম্ব ২০১০ সাল থেকে মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করছেন। শুরুতে তিনি এটি পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন না। তবে পরে অধ্যাপক ডেমিয়ান কয়েল তাঁকে সাহায্য করেন।

মানুষ আর মেশিনের পার্থক্য

২০২৪ সালের প্রস্তুতির সময় কোলম্বের মাথায় ৩২টি ইলেকট্রোড লাগানো শক্ত ক্যাপ ছিল। সে সময় তাঁর মাথা ঘামে ভিজে যাচ্ছিল। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সে বছর প্রস্তুতির সময় ছয়টি ভার্চুয়াল কাজ শেষ করতে তাঁর আট মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। প্রস্তুতির পর্বে তিনি দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন।

প্রথম হয়েছিলেন আমেরিকান পাইলট ফিলিপ ম্যাকেঞ্জি। তাঁর মস্তিষ্কে ইমপ্লান্ট রয়েছে। তিনি একই কাজ কোলম্বের অর্ধেক সময়ের মধ্যে করতে পারেন। মূল প্রতিযোগিতাতেও তিনি প্রথম হন। কোলম্ব হন চতুর্থ। হতাশ কোলম্ব ভাবতে শুরু করেছিলেন, থাইল্যান্ডে গিয়ে ইমপ্লান্ট করিয়ে ফেলবেন।

২০২৪ সাইবাথলনে অংশ নেওয়া ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ দলের বিজয়ী পাইলট ফিলিপ ম্যাকেঞ্জি
ছবি: ইউপিএমসি অ্যান্ড পিট হেলথ সায়েন্সেস

ইমপ্লান্ট নিয়ে প্রতিযোগীরা যা ভাবছেন

ফিলিপ ম্যাকেঞ্জির ইমপ্লান্ট ছিল তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা। ২০১২ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগেছেন। ২০২৩ সালে তিনি ইমপ্লান্ট করানোর মাত্র এক মাসেই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস তাঁর কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে। দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি রোবোটিক হাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তাঁর মতে, এটি ছিল হাতমোজা পরার মতো সহজ আর স্বাভাবিক।

তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার মানেই সব ঠিক হয়ে যায় না। নতুন সক্ষমতা পেয়ে নতুন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হয়েছে তাঁকে। চার বছর পরে এর প্রভাব কেমন হবে তা কেউ জানে না। কারণ সাইব্যাথলন চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন
২০১২ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর ফিলিপ ম্যাকেঞ্জির ইমপ্লান্ট দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগেছেন। ২০২৩ সালে তিনি ইমপ্লান্ট করানোর মাত্র এক মাসেই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস তাঁর কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে।
ইউনিভার্সিটি অফ বাথে ড. কয়েলের কোম্পানি নিউরোকনসাইসের তৈরি নতুন প্রযুক্তিতে চলছে অনুশীলন
ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

কোলম্ব এক বছর ভেবে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি মস্তিষ্কে ইমপ্লান্ট করবেন না। তাঁর মতে, প্রতিযোগিতা এক ধরনের ব্যাপার। কিন্তু বাস্তব জীবন আলাদা। স্বাধীনতা এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ চিপ বসালেই পাওয়া যাবে, তিনি এমন মনে করছেন না।

ম্যাকেঞ্জি অবশ্য ভিন্নভাবে ভেবেছেন। তাঁর কাছে নিজের শরীর নিয়ন্ত্রণ করাটা স্বাধীনভাবে চলাফেরার অংশ। তিনি এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ২০২৮ সালের সিঙ্গাপুর সাইব্যাথলনের জন্য।

এই প্রতিযোগিতা প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন সহজ করবে বলে গবেষকেরা মনে করছেন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন