বিশ্বব্যাপী ২৫০ কোটি মানুষকে ভূমিকম্প সতর্কবার্তা দেবে গুগল

ভূমিকম্প সতর্কতা বা এইএ (AEA) সিস্টেম স্মার্টফোনের অ্যাক্সিলোমিটার ব্যবহার করে ১১ হাজারটিরও বেশি ভূমিকম্প রেকর্ড করেছে

ভূমিকম্প মুহূর্তেই জনজীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এর পূর্বাভাস দেওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করা কি সম্ভব) তবে কয়েক সেকেন্ডের আগাম সতর্কতাও বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। সে জন্য বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোতে ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সতর্কবার্তা দেওয়ার কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক দরিদ্র দেশে এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। সে জন্য গুগল এবার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় দুই বিলিয়নেরও বেশি অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ব্যবহার করে একটি বিশাল ভূমিকম্প শনাক্তকরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।

নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে, গুগল ২ বিলিয়নেরও বেশি স্মার্টফোনের মোশন সেন্সর ব্যবহার করে একটি ভূমিকম্প পূর্বাভাস ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই ব্যবস্থা সাধারণ ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র সিসমোমিটারের মতোই কার্যকর।

গুগল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ভূমিকম্প সারা বিশ্বের মানুষের জন্য একটা বড় বিপদ। যদিও আমরা এখন কিছুটা বুঝতে পারি ভূমিকম্প কোথায় হতে পারে, তবুও যখন এটা হয়, তখন অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়।

২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ভূমিকম্প সতর্কতা বা এইএ (AEA) সিস্টেম স্মার্টফোনের অ্যাক্সিলোমিটার ব্যবহার করে ১১ হাজারটিরও বেশি ভূমিকম্প রেকর্ড করেছে। একই সময়ে এটি ৯৮টি দেশের অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য ১ হাজার ২০০টিরও বেশি সতর্কতা পাঠিয়েছে।

আগে থেকে এই সিস্টেম ব্যবহার করে ভূমিকম্পের সতর্কতা পাওয়া মানুষের সংখ্যা দশ গুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ২৫ কোটি মানুষ এই সুবিধা পেত। এখন তা ২.৫ বিলিয়ন বা ২৫০ কোটিতে পৌঁছেছে। গবেষকেরা ১৭ জুলাই সায়েন্স জার্নালে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন

গুগল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ভূমিকম্প সারা বিশ্বের মানুষের জন্য একটা বড় বিপদ। যদিও আমরা এখন কিছুটা বুঝতে পারি ভূমিকম্প কোথায় হতে পারে, তবুও যখন এটা হয়, তখন অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। যদি আমরা মানুষকে ভূমিকম্প শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে জানাতে পারি, তাহলে কেমন হয়? এই কয়েক সেকেন্ডে মানুষ সিঁড়ি দিয়ে নামতে, বিপজ্জনক জিনিস থেকে সরে যেতে এবং নিরাপদে আশ্রয় নিতে যথেষ্ট সময় পাবে।’

স্মার্টফোনের অক্সিলোমিটারের সেন্সরের সমন্বয়ে তৈরি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এইএ সিস্টেম ভূমিকম্পের মাত্রা শনাক্ত করতে পারে

গত কয়েক দশকে চীন, মেক্সিকো, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে ভূমিকম্প সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে এই সিস্টেমগুলো তৈরি হয় ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র সিসমিক স্টেশন ব্যবহার করে, যা বেশ খরচসাপেক্ষ। ভূমিকম্পপ্রবণ বেশির ভাগ দেশে কেবল কিছু এলাকায় এই সুবিধা আছে। আর অনেক দেশেই এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য গুগলের গবেষকেরা অ্যান্ড্রয়েড ভূমিকম্প সতর্কতা তথা এইএ সিস্টেম তৈরি করেছেন। এই সিস্টেমে স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচের অ্যাক্সিলোমিটার ব্যবহার করে। এটি ভূমিকম্পের সময় দ্রুত গতিশীল পি-তরঙ্গ বা প্রাথমিক তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। এই প্রাথমিক তরঙ্গটি ভূমিকম্পের মূল এবং বেশি ধ্বংসাত্মক এস-তরঙ্গ বা সেকেন্ডারি ওয়েভ, মানে মাধ্যমিক তরঙ্গের আগে আসে। প্রাথমিক তরঙ্গটি তরল ও কঠিন—দুই ধরনের পদার্থের মধ্য দিয়েই চলতে পারে। এটি দ্রুতগামী, তবে মাধ্যমিক বা পরবর্তী তরঙ্গের মতো অত ভয়ংকর নয়। এই পরবর্তী তরঙ্গ বা এস-ওয়েভ শুধু কঠিন পদার্থের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। এটি ধীরে চলে, কিন্তু ক্ষতি করে বেশি।

গবেষকেরা জানিয়েছেন, এই ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। স্মার্টফোনের অ্যাক্সিলোমিটারগুলো ভূমিকম্প মাপার মূল যন্ত্রের সিসমোমিটারের মতো অত নির্ভুল নয়।

স্মার্টফোনের অক্সিলোমিটারের সেন্সরের সমন্বয়ে তৈরি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এইএ সিস্টেম ভূমিকম্পের মাত্রা শনাক্ত করতে পারে এবং এটি কোথায়, কতদূর জুড়ে আঘাত হানতে পারে, তা অনুমান করতে পারে। এরপর বিপদজনক এলাকার ব্যবহারকারীদের কাছে সতর্কতা পাঠিয়ে দেয়। অবশ্য গুগলের এই সতর্কতা ব্যবস্থা কিন্তু ভূমিকম্প কোথায় হবে, তা আগে থেকে অনুমান করতে পারে না। বরং কোথাও ভূমিকম্প শনাক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে এটি দ্রুত আশপাশের বিপজনক এলাকার সব স্মার্টফোন ব্যবহারকারীকে সতর্কবার্তা পাঠাতে পারে।

আরও পড়ুন

গবেষকেরা জানিয়েছেন, এই ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। স্মার্টফোনের অ্যাক্সিলোমিটারগুলো ভূমিকম্প মাপার মূল যন্ত্রের সিসমোমিটারের মতো অত নির্ভুল নয়। তাই গবেষকেরা এই বিপুল সংখ্যক অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করার সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন। তাঁরা সব ফোন থেকে পাওয়া তথ্য একসঙ্গে করে একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা তৈরি করেছেন। তবে বিভিন্ন ফোনের সেন্সরের পার্থক্য ও ভবনগুলোর কাঠামোগত ভিন্নতাসহ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই বিজ্ঞানীদের কাজ করতে হয়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে বর্তমানে এই অ্যান্ড্রয়েড ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থা তথা এইএ সিস্টেম কাজ করছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এইএ মোট ১ হাজার ২৭৯টি সতর্কতা জারি করেছে এসব অঞ্চলে।

ভূমিকম্প
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে জানা গেছে, যাঁরা ভূমিকম্পের সময় এই সিস্টেম ব্যবহার করেছেন, তাঁদের ৮৫ শতাংশই সতর্কতা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশ মানুষ ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগেই সতর্কতা পান, ২৮ শতাংশ পেয়েছেন ভূমিকম্প চলাকালীন, আর ২৩ শতাংশ পেয়েছেন ভূমিকম্প শেষ হওয়ার পর। মাত্র তিনটি সতর্কতা ভুল ছিল। এর মধ্যে দুটি হয়েছিল বজ্রপাতের কারণে। আরেকটি ছিল পাবলিক নোটিশের জন্য।

গুগল জোর দিয়ে বলছে, তাদের তৈরি প্রযুক্তি শুধু সরকারি সতর্কীকরণ ব্যবস্থাকে আরও সাহায্য করবে। কিন্তু সেগুলোকে পুরোপুরি সরিয়ে দেবে না। এ থেকে বোঝা যায়, গুগলের এই সতর্কবার্তাই শেষ কথা নয়।

তবে এই সিস্টেমে কিছু সমস্যা এখনো আছে। যেমন ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কে যে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, এর মাত্রা এইএ সিস্টেম সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেনি। অর্থাৎ ভূমিকম্পের আসল মাত্রার চেয়ে অনেক কম দেখিয়েছিল। গবেষকেরা এর কারণ হিসেবে কিছু ভুল অ্যালগরিদম, সফটওয়্যারের নির্দেশনা এবং তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এখন সেগুলো ঠিক করে আপডেট করে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে একটা প্রশ্ন উঠেছে—জীবন বাঁচানোর মতো জরুরি সফটওয়্যার যদি কোনো বেসরকারি কোম্পানির হাতে থাকে, সেটা কতটা নিরাপদ? সবচেয়ে বড় কথা, এটি যেহেতু ভূমিকম্প শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করে, আগে থেকে অনুমান করতে পারে না; তাই এটি ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে সব সময় কাজে আসবে না, এটা বলা বাহুল্য।

গুগল জোর দিয়ে বলছে, তাদের তৈরি প্রযুক্তি শুধু সরকারি সতর্কীকরণ ব্যবস্থাকে আরও সাহায্য করবে। কিন্তু সেগুলোকে পুরোপুরি সরিয়ে দেবে না। এ থেকে বোঝা যায়, গুগলের এই সতর্কবার্তাই শেষ কথা নয়। বরং ভূমিকম্পে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রাথমিক করণীয় বিষয়গুলো খেয়াল রাখা ও মেনে চলা বেশি জরুরি। যেমন বাড়িঘর নির্মাণে বিল্ডিং কোড মেনে চলা, ভূমিকম্প হলে আত্মরক্ষার্থে করণীয় বিষয়গুলো মানা, ইত্যাদি। এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন: ভূমিকম্পে কী করবেন

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, গুগল

আরও পড়ুন