ডিপ লার্নিংয়ের উত্থান এবং আপনার প্রতিটি কাজে যেভাবে প্রভাব রাখছে এই প্রযুক্তি

ডিপ লার্নিং। এই বিশেষ ধরনের অ্যালগরিদম বদলে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খোলনলচে। ২০২৪ সালে নোবেলজয়ী জিওফ্রি হিন্টন এই ধারণার প্রবর্তন করেন। কীভাবে এআই জগতে উত্থান হলো ডিপ লার্নিংয়ের, কীভাবে এটি প্রভাব রাখছে আমাদের জীবনে, সেই কাহিনি…

ডিপ লার্নিং, প্রতীকী ছবি

লেখাটি ভালোভাবে বুঝতে প্রথমে পড়ুন: ডিপ লার্নিং যেভাবে বদলে দিয়েছে এআই জগৎ

 

বিগ ডেটা এবং হার্ডওয়্যার বিপ্লব

২০০৬ সালে ফেই-ফেই লি এবং তাঁর দল স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেন ‘ইমেজনেট’ নামের বিশাল এক ডেটাসেট। এই ডেটাসেটে ছিল লাখ লাখ ছবির তথ্য, যার প্রতিটির সঙ্গে ছিল সুস্পষ্ট লেবেল। এর লক্ষ্য ছিল বড় আকারের ভিজ্যুয়াল ডেটাসেট সরবরাহ করা, যার অভাবে আগে নিউরাল নেটওয়ার্ক ট্রেনিং বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এই ডেটাসেট তৈরির মাধ্যমে মেশিন লার্নিং গবেষণায় ডেটার ঘাটতি অনেকটাই মিটে গেল। (বিস্তারিত পড়ুন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছবি শনাক্ত করতে শিখল কীভাবে-১)। ঠিক একই সময়ে গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউর শক্তি ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে এনভিডিয়ার জিপিইউ প্যারালাল কম্পিউটিংয়ের জন্য খুব উপযোগী প্রমাণিত হয়। কিছু গবেষক বুঝতে পারেন, এই জিপিইউগুলো দিয়ে নিউরাল নেটওয়ার্ককে আগের তুলনায় অনেক দ্রুত প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।

২০০৯ সালের দিকে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বড় ডেটাসেট (যেমন ইমেজনেট) এবং জিপিইউর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত নিউরাল নেটওয়ার্কের কার্যক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার নিউরাল নেটওয়ার্ক গবেষণায় নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ২০০৯ সালের দিকে দেখা গেল, বক্তৃতা বা কথাবার্তা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাক্য লেখার কাজেও ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক অভূতপূর্ব ফল দিচ্ছে। এতদিন এই কাজে ব্যবহৃত হতো পরিসংখ্যানভিত্তিক কিছু মডেল (যেমন হিডেন মারকোভ মডেল), কিন্তু হিন্টন ও মাইক্রোসফটের গবেষকরা মিলে এমন এক ডিপ নেটওয়ার্ক তৈরি করলেন, যা মানুষের ভাষণকে লেখা বাক্যে রূপান্তর করতে আগের সব পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত। এরপর যেন বন্যার স্রোত নেমে এল—বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারল, এতদিন পাশ কাটিয়ে চলা এই ‘ডিপ লার্নিং’ পদ্ধতিই আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ।

প্রতিযোগিতার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। অ্যালেক্সনেটের ভুলের হার ছিল মাত্র ১৬%, যেখানে অন্য দলগুলোর ভুলের হার ছিল প্রায় ২৬% বা তার বেশি। এই বিশাল ব্যবধান গবেষকদের হতবাক করে দেয়।

২০১২ সাল ছিল ডিপ লার্নিং প্রযুক্তির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। সেই বছর ইমেজনেট লার্জ স্কেল ভিজ্যুয়াল রিকগনিশন চ্যালেঞ্জে (ILSVRC) টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওফ্রি হিন্টনের নেতৃত্বাধীন দল অংশ নেয়। হিন্টনের এই দলে ছিলেন তাঁর ছাত্র অ্যালেক্স ক্রিজেভস্কি এবং ইলিয়া সাটস্কেভার। তাঁদের মডেল ছিল এক বিশাল ডিপ কনভোল্যুশনাল নিউরাল নেটওয়ার্ক। এটির প্রশিক্ষণের জন্য তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন অত্যাধুনিক জিপিইউ, সাধারণ প্রসেসরের চেয়ে অনেক দ্রুত এটি গাণিতিক গণনা সামলে নিতে পারত। দীর্ঘ সময় ধরে সেই মডেলটিকে লাখ লাখ ছবি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। তাঁদের তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কের নাম ছিল অ্যালেক্সনেট। এটি ছিল একটি ডিপ কনভোল্যুশনাল নিউরাল নেটওয়ার্ক বা সিএনএন। এই মডেলটি ইমেজনেটে থাকা লাখ লাখ ছবির তথ্য থেকে নিজেই ছবি চিনতে শিখেছিল।

আরও পড়ুন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত দিন ঘনিয়ে এল। হিন্টনের দলের সবাই কিছুটা উত্তেজিত ছিলেন, কারণ তাঁরা জানতেন, তাঁদের মডেল অন্যদের চেয়ে ভালো করছে; কিন্তু কতটা ভালো, তা নিশ্চিত ছিলেন না। ফলাফল ঘোষণা করার জন্য এক সম্মেলন হলে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষকেরা জড়ো হলেন। বিচারকমণ্ডলী যখন বিজয়ীর নাম ডাকলেন, শোনা গেল টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্টনের দলের নাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য হলঘরে একধরনের নিস্তব্ধ বিস্ময় নেমে এল, তারপর করতালিতে ফেটে পড়ল সবাই। হিন্টন শান্ত হাসিমুখে তাঁর ছাত্র অ্যালেক্স ও ইলিয়াকে পাশে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। প্রতিযোগিতার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। অ্যালেক্সনেটের ভুলের হার ছিল মাত্র ১৬%, যেখানে অন্য দলগুলোর ভুলের হার ছিল প্রায় ২৬% বা তার বেশি। এই বিশাল ব্যবধান গবেষকদের হতবাক করে দেয়। এই সাফল্যকে অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় ‘ইউরেকা মুহূর্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা। এক লাফে যেন কম্পিউটার ভিশন এক দশক এগিয়ে গেল। সেই সম্মেলনের হলে উপস্থিত গবেষকেরা অবাক হয়ে দেখলেন, এতদিন যার ওপর কেউ তেমন ভরসা করেনি, সেই নিউরাল নেটওয়ার্কই সবার সেরা হয়ে উঠেছে। অনেকেই ছুটে এসে হিন্টনকে অভিনন্দন জানালেন। তরুণ গবেষকেরা মুগ্ধ হয়ে দেখল, যাঁর আইডিয়াকে বইয়ে পড়ে অবাস্তব মনে হতো, তিনি বাস্তবে প্রমাণ করে দিলেন এর কার্যকারিতা।

ভাষান্তরের জগতে এল বিপ্লব—ডিপ লার্নিংয়ের জোরে কম্পিউটার এখন বাংলায় বলা বাক্য ইংরেজিতে প্রায় মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে অনুবাদ করতে পারে।
২০১২ সালের ইমেজনেট প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে অ্যালেক্সনেট

এই বিপ্লবের পর থেকে ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি কম্পিউটারবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি জগতের কেন্দ্রে চলে আসে। গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, এবং এনভিডিয়ার মতো কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি গ্রহণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। গুগল তাদের সেবাগুলো—যেমন গুগল ফটোস, ইউটিউব, গুগল ট্রান্সলেট এবং গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য ডিপ লার্নিং ব্যবহার করতে শুরু করে। ফেসবুক ছবির ট্যাগিং, ভিডিও এবং কনটেন্ট সাজেশনে, অ্যামাজন প্রোডাক্ট সাজেশনে এবং মাইক্রোসফট তাদের কর্টানা এবং আজুর সেবায় ব্যাপকভাবে ডিপ লার্নিং ব্যবহার শুরু করে।

 

প্রযুক্তি বিশ্বে ডিপ লার্নিংয়ের উত্থান (২০১৩ থেকে)

এই বিজয়ের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডিপ লার্নিং রাতারাতি প্রযুক্তি জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে করে হিন্টন, লেকুন, বেঙ্গিও এবং তাঁদের শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করতে লাগল নিজেদের পণ্য ও সেবাকে আরও উন্নত করতে।

২০১৩ সালে গুগল হিন্টনের প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট ডিপ লার্নিং কোম্পানি ‘ডিএনএনরিসার্চ ইংক.’ কিনে নেয়। এর মাধ্যমে জিওফ্রি হিন্টন, অ্যালেক্স ক্রিজেভস্কি এবং ইলিয়া সাটস্কেভার গুগলের অংশ হয়ে যান। একই সময়ে ইয়ান লেকুন ফেসবুকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন এবং ইয়োশুয়া বেঙ্গিও মন্ট্রিয়েলে তাঁর গবেষণার পরিসর বাড়াতে থাকেন। পাশাপাশি ফেসবুক, মাইক্রোসফট, আমাজন এবং অন্যান্য টেক জায়ান্টরা ডিপ লার্নিং রিসার্চে বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

ডিপ লার্নিংয়ের জয়যাত্রা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ল। কম্পিউটার দেখতে শিখল। স্বচালিত গাড়ি এখন সড়কে চলার সময় নিউরাল নেটওয়ার্কের ‘চোখ’ দিয়ে রাস্তার চিহ্ন ও পথচারী শনাক্ত করতে পারে, বিপজ্জনক পরিস্থিতি হলে মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে যায়। আমাদের দৈনন্দিন স্মার্টফোনও এখন কথাবার্তা বুঝতে শিখেছে। একজন ছাত্র ঘরে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘আজকের আবহাওয়া কেমন? তার ফোনের ডিজিটাল সহকারী নিউরাল নেটওয়ার্কের ‘কৃত্রিম মস্তিষ্ক’ দিয়ে প্রশ্নটি বুঝে সঙ্গেই সঙ্গেই উত্তর দেয়, যেন কোনো বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন চলছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত গাড়িগুলো ডিপ লার্নিংয়ের সাহায্যে রাস্তার সব ধরনের বস্তু চিনতে পারে। এই গাড়িগুলো ক্যামেরা, লিডার এবং সেন্সর ব্যবহার করে চারপাশের তথ্য সংগ্রহ করে।

ভাষান্তরের জগতে এল বিপ্লব—ডিপ লার্নিংয়ের জোরে কম্পিউটার এখন বাংলায় বলা বাক্য ইংরেজিতে প্রায় মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে অনুবাদ করতে পারে। ডিপ লার্নিংয়ের কল্যাণে বর্তমানে এমন ভাষানির্ভর মডেল তৈরি হয়েছে, যারা মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, গল্প-কবিতা লিখতে পারে, এমনকি কোড পর্যন্ত লিখে ফেলতে পারে। সাম্প্রতিককালে চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল মানুষের সঙ্গে প্রায় স্বাভাবিকভাবে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে। এই অসাধারণ কীর্তির মূলে রয়েছে ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্কের শক্তি। সৃজনশীল কাজেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার কারিশমা দেখাচ্ছে—ছবি আঁকা, সুর সৃষ্টি করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নিউরাল নেটওয়ার্ক পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছে।

টুরিং পুরস্কার

টুরিং পুরস্কার জয় এবং ডিপ লার্নিংয়ের গডফাদার স্বীকৃতি (২০১৮)

ডিপ লার্নিংয়ের বৈপ্লবিক সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে কম্পিউটারবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান, টুরিং অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয় জিওফ্রি হিন্টন, ইয়ান লেকুন এবং ইয়োশুয়া বেঙ্গিওকে। সংবাদমাধ্যম এবং গবেষকমহল এই তিন বিজ্ঞানীকে সম্মানের সঙ্গে ‘ডিপ লার্নিংয়ের গডফাদার’ বলে ডাকতে শুরু করে। পুরস্কার গ্রহণের সময় তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে এই প্রযুক্তির উন্নয়নে অবদান রাখা পূর্বসূরি গবেষকদেরও স্মরণ করেন। হিন্টনের কথা ছিল, ‘যন্ত্র যদি শেখে, সেটা মানুষের মতোই শেখা উচিৎ। ভুল করে, ভুল স্বীকার করে, তারপর শেখা।’ তাঁর কাজ শুধু কোড নয়, একধরনের দার্শনিক ভাবনা—কীভাবে আমরা মানুষ হিসেবে শিখি এবং সেই প্রক্রিয়া কীভাবে প্রযুক্তিকে শেখানো যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি একটি শিশুকে শেখাতে পারি ভালোবাসা দিয়ে, তাহলে যন্ত্রকেও শেখাতে হবে ধৈর্য আর সহানুভূতির সঙ্গে।’

২০১৮ সালে টুরিং পুরস্কার জেতেন (ছবিতে বাঁ থেকে দ্বিতীয়) ইয়োশুয়া বেঙ্গিও, জিওফ্রে হিন্টন এবং ইয়ান লেকুন।

ডিপ লার্নিংয়ের বাস্তব প্রয়োগ

ডিপ লার্নিংয়ের প্রয়োগ বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বদলে দিচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ আগেই দিয়েছি। যেমন ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইমেজ রিকগনিশন, স্বচালিত যানবাহন বা ড্রাইভারবিহীন গাড়ি চালনা এবং মেডিকেল ইমেজিং। প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিপ লার্নিং কীভাবে কাজ করে এবং কীভাবে এটি মানব জীবনকে সহজতর করছে, তা বোঝা যাক। ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, যেমন অ্যাপলের সিরি, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং অ্যামাজনের অ্যালেক্সা, ডিপ লার্নিংয়ের সাহায্যে মানুষের কথা শোনে এবং সেগুলো বুঝতে পারে। এই প্রযুক্তিটি মানব কণ্ঠস্বর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেটিকে টেক্সটে রূপান্তর করে। এরপর এটি প্রশিক্ষিত ডিপ লার্নিং মডেল ব্যবহার করে মানুষের কথার অর্থ বোঝে এবং উত্তর দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলেন, ‘আজকের আবহাওয়া কেমন?’ তাহলে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে প্রশ্নটি বুঝবে এবং আবহাওয়ার তথ্য দেবে। এই প্রযুক্তি ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে এবং এখন অনেক ভাষা এবং উচ্চারণ বুঝতে সক্ষম।

আরও পড়ুন

ডিপ লার্নিংয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো ইমেজ রিকগনিশন। এই প্রযুক্তি ছবি থেকে বস্তু চিনতে বা শনাক্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে ছবি থেকে মানুষের মুখ চেনে এবং তাদের ট্যাগ করে। একই প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার দেখা যায় গুগল ফটোসেও। এ ছাড়াও এই প্রযুক্তি সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তি কোনো স্থানে ঢুকলে সিস্টেমটি তা শনাক্ত করতে পারে। ইমেজ রিকগনিশন মেশিন লার্নিং মডেলগুলো কয়েক লাখ ছবি দেখে এবং এ থেকে বস্তুগুলোর বৈশিষ্ট্য শেখে। এরপর এটি নতুন ছবিতে সেই বৈশিষ্ট্যগুলি খুঁজে বের করে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত গাড়িগুলো ডিপ লার্নিংয়ের সাহায্যে রাস্তার সব ধরনের বস্তু চিনতে পারে। এই গাড়িগুলো ক্যামেরা, লিডার এবং সেন্সর ব্যবহার করে চারপাশের তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর ডিপ লার্নিং মডেলগুলো এই তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে গাড়িটি কীভাবে চালানো উচিত। উদাহরণস্বরূপ, টেসলা এবং ওয়েমোর মতো কোম্পানিগুলো ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে তাদের গাড়িগুলোকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। এই প্রযুক্তি ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি যানবাহন চালানোর সম্পূর্ণ নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

গুগল, ফেসবুকের মেটা, ওপেনএআই, এনভিডিয়ার মতো কোম্পানিগুলো বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করে তুলছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে ডিপ লার্নিং। এটি এক্স-রে, এমআরআই এবং সিটি স্ক্যানের মতো মেডিক্যাল ইমেজ, অর্থাৎ চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে এবং রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। যেমন, গুগল হেলথ ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য একটি মডেল তৈরি করেছে। এই মডেল এক্স-রে ইমেজ বিশ্লেষণ করে এবং ক্যান্সার আছে কি না, তা নির্ধারণ করে। এই প্রযুক্তি ডাক্তারদের সাহায্য করছে, যাতে তাঁরা আরও দ্রুত এবং সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারেন।

এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, ডিপ লার্নিং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এটি মানব জীবনকে সহজতর করছে। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে ডিপ লার্নিং আমাদের প্রযুক্তি এবং দৈনন্দিন জীবনকে বদলে দিচ্ছে। ডিপ লার্নিং আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লবের হৃৎপিণ্ড। এটি শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং আমাদের জীবনযাত্রা, কাজের পদ্ধতি এবং সমাজের কাঠামো পরিবর্তনের শক্তিশালী এক চালক। আমরা যেসব সুবিধা প্রতিদিন ব্যবহার করি—স্মার্টফোনের ভয়েস কমান্ড থেকে শুরু করে অনলাইন শপিংয়ের সাজেশন, রোগ নির্ণয় থেকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ—এই সবকিছুর পেছনেই রয়েছে ডিপ লার্নিংয়ের অবদান।

আরও পড়ুন

এই প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল কয়েক দশক আগে, কিছু দূরদর্শী গবেষকের স্বপ্ন দিয়ে। জিওফ্রি হিন্টন, ইয়ান লেকুন, ইয়োশুয়া বেঙ্গিওর মতো বিজ্ঞানীরা যখন নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখন অনেকেই এটিকে অবাস্তব মনে করতেন। কিন্তু তাঁদের অধ্যবসায় এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির সমন্বয়ে আজ আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে যন্ত্র মানুষের মতো দেখতে, শুনতে ও কিছু ক্ষেত্রে চিন্তা করতে পারে।

গুগল, ফেসবুকের মেটা, ওপেনএআই, এনভিডিয়ার মতো কোম্পানিগুলো বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করে তুলছে। টেনসরফ্লো, পাইটর্চের মতো ওপেনসোর্স টুলের কারণে এই প্রযুক্তি এখন আর শুধু বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা একটি ছোট স্টার্টআপও আজ ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে বিভিন্ন সমস্যার অভিনব সমাধান করতে পারে।

ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ডিপ লার্নিংয়ের প্রভাব আরও গভীর ও ব্যাপক হবে। স্বাস্থ্যসেবায় এটি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিপ্লব আনবে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ব্যক্তিগতকৃত পাঠ্যক্রম সম্ভব হবে। আমরা জানি, ইতিমধ্যেই চ্যাটজিপিটিতে একসঙ্গে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ভবিষ্যতে পরিবহনব্যবস্থা এর মাধ্যমে হয়ে উঠবে আরও নিরাপদ ও দক্ষ। কৃষিকাজে আরও কম সম্পদ দিয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে।

ডিপ লার্নিংয়ের গল্পের এটি শেষ নয়, বরং বলা যায় শুরু। প্রতিদিন এর নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় এটি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে আরও ব্যাপকভাবে বদলে দেব।

তবে এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জও আসবে। প্রাইভেসি, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ডিপ লার্নিংয়ের শক্তি ব্যবহার করতে গেলে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন এটি সমাজের সবার কল্যাণে আসে, শুধু কয়েকজনের হাতে এই শক্তি কেন্দ্রীভূত না হয়। এই প্রযুক্তি বুঝে নেওয়া আজকের যুগে অপরিহার্য। আমরা চাই বা না চাই, ডিপ লার্নিং আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাব আরও বাড়বে। এটি কীভাবে কাজ করে, কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর সুবিধা-অসুবিধা কী—এসব জানা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সবচেয়ে বড় কথা, ডিপ লার্নিংয়ের গল্পের এটি শেষ নয়, বরং বলা যায় শুরু। প্রতিদিন এর নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় এটি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে আরও ব্যাপকভাবে বদলে দেব। এই নতুন যুগে আমাদেরও ক্রমাগত শিখে যেতে হবে, যেন প্রযুক্তি ও মানবতার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জিওফ্রি হিন্টন আমাদের পথ দেখিয়েছেন—এখন আমাদের দায়িত্ব এই পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

লেখক: ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার, ওমরণ হেলথকেয়ার, সিঙ্গাপুর (স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ নিয়ে কাজ করেন)

আরও পড়ুন