শুরুতেই জানতে চাই, কেমন আছেন?
মইনুল জাবের: আমি ভালো আছি।
আপনারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রথম এ ধরনের আয়োজন করলেন। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কেমন? কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মইনুল জাবের: আমরা যখন প্রথম এ নিয়ে চিন্তা করি, তখন ভাবিনি এত সাড়া পাব। মানে এখানে আয়োজন শুরু হওয়ার আগের দিনও এত মানুষ আশা করিনি। কারণ, আমাদের ধারণা ছিল, মানুষ ভাববে এটা এআই নিয়ে কাজ, সুতরাং হয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির কিছু হবে! ফলে চারুকলার আসাযাওয়া করা মানুষদের কাছে এটা কি ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক, সেটি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল মনে! শেষতক আমরা চিন্তা করাই বাদ দিলাম। ঠিক করলাম, এটা আমরা করব। সেটা শিল্প হোক বা না হোক, বিজ্ঞান হোক বা না হোক, কিছু একটা তো হবে। এভাবেই শুরু করলাম।
আমারা খুব একটা প্রচার করিনি।কিন্তু দেখলাম,আমাদের ভুল প্রমাণ করে এখানে অনেক মানুষ আসছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষ থাকে, নানা প্রশ্ন করে। প্রথমে ছিল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। পরে চাপ সামলানোর জন্যে সেটা কমিয়ে ১১টা থেকে ১টা, আর এখন ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। যা-ই হোক, আমি বলব, দর্শকের এমন সাড়া অপ্রত্যাশিত। এটা আমরা একেবারেই ভাবিনি। অনেকে আসছেন ঠিকই, তবে হয়তো বিষয়গুলো অত সহজে তাঁদেরকাছে ধরা পড়ছে না । বা কতটা বুঝতে পারছেন, সে ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। কিন্তু সমাগমের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব, আমরা সফল। দারুণ সাড়া পেয়েছি।
আপনারা এমন একটা প্রদর্শনী বা ওয়ার্কশপ করার কথা কেন ভাবলেন?
মইনুল জাবের: ব্যাপারটা একটু পুরোনো। আমার নিজের কাজ তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এর প্রাওয়গিগ ব্যবহার নিয়ে। অনেক বছর ধরে এ নিয়েই কাজ করছি। আমাদের মূল লক্ষ্য, ডেটানিয়ে গবেষণা করা এবং সেটাকে প্রায়োগিকভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা।
আমরা চাইছিলাম ভালো কাজে কীভাবে এআই ব্যবহার করা যায়। সে চিন্তা থেকেই আমরা এমন কিছু করার সিদ্ধান্ত নিই। বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশে এআই নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে। ওদের অনেক কম্পিউটিং ক্ষমতা এবং এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত লোকবল আছে। টাকা বা ফান্ডিংও আছে যথেষ্ট। আমাদের অত কিছু নেই ঠিকই, তবু আমাদের নিজেদের মতো করে কাজ করার জন্য এখনি শুরু করতে হবে।
যুগ পাল্টে যাচ্ছে। সে জন্য যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে কাজ করছি আমরা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটা অ্যান্ড ডিজাইন ল্যাবে যেসব গবেষণা করছি আমরা ,সেসবের মূল লক্ষ্যই হল কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেটি খুঁজে বের করা, আর মানুষ যেন তা ব্যবহার করতে পারে সেভাবে ডিজাইনকে প্রভাবিত করা।
এখানে আমরা আসলে শিল্পের দিকে আসার চেষ্টা করছি। আমার নিজের জীবনে শিল্পের অনেক প্রভাব। আমার বাবা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সূত্রে শিল্পের সঙ্গে আমার জন্ম থেকেই বসবাস। তাই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা তো খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার আমার জন্য। আমি নিজেও শিল্প তৈরির চেষ্টা করি। সেটা অবশ্য চিরায়ত শিল্পমাধ্যম গুলোতেই করি। এআই এবং ডেটা নিয়ে শিল্প করে সেটি মানুষকে দেখানর চেষ্টা এই প্রথম! এই চিরায়ত শিল্প এবং এআইকে মেলানোর চেষ্টা করছি আমরা।
এমন কিছু করব অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম! কী করে, কাদের সঙ্গে মিলে আমরা এটা করব, সেটি বুঝতে পারছিলাম না। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশবার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যপক আজিজ শারাফি এগিয়ে এলেন। ইলেকট্রনিক আর্ট নিয়ে তিনি অনেকদিন কাজ করছেন। এসব ব্যাপারে বেশ আগ্রহীও। বলা যায় তাঁর নেতৃত্বে এবং (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের প্রচ্ছন্ন উৎসাহে এবং সহযোগিতার বলে আমরা কাজটা শুরু করলাম। চারুকলা আমাদের হোস্ট করায় এখানেই আয়োজনটা করে ফেললাম। আর এটা তো শুধু প্রদর্শনী না। আজিজ ভাইয়ের ওয়ার্কশপ রয়েছে এখানে। পাশাপাশি শিল্প এবং এআই নিয়ে সেমিনার ও রয়েছে।
এখানে আপনাদের প্রত্যাশিত মূল দর্শক কি শুধু শিল্পীরা? আরেকটা বিষয় জানতে চাই—সাধারণ মানুষ এখান থেকে কী বার্তা নিয়ে যাবে?
মইনুল জাবের: না, প্রত্যাশিত দর্শক শুধু শিল্পীরা, সেটা আমি বলব না। এ আয়োজন সবার কথা ভেবেই আমরা করেছি। আমাদের এ প্রদর্শনীর একটা বিষয় হচ্ছে, এআইকে শিল্পীদের জন্য টুল হিসেবে ব্যবহার করা। এআই আর্ট বলতে যেটা বোঝায়, তার সঙ্গে আমাদের এ কাজের সম্পর্ক নেই। আমরা আসলে প্রচলিত প্রম্পটিং নির্ভর এআই আর্ট নিয়েও কাজ করছি না। আমরা বরং এখানে কনসেপ্টকে আমাদের জীবন ও পরিবেশের নানা ডেটা এবং মেশিন ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ছবি তৈরির কাজটা করছি। আপনি যদি ডেটাকে রং হিসেবে ভাবতে পারেন, আর এআই টুলকে ব্রাশ ভাবেন, তাহলে আপনার কাছে রং এবং ব্রাশ দুটিই রইল। আর মডেল হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষ। ফলে আপনার রং, ব্রাশ ও মডেল—সব প্রস্তুত। এখন শুধু আঁকতে হবে। সেই কাজটাই আমরা এখানে করছি।
কাজটা আমরা এআইকে দিয়ে করাচ্ছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে এআইকে কতগুলো ডেটা দেওয়া আছে, সেই হিসেবে কাজটা করছে। আমি কাজটা করাচ্ছি। আপনি যেমন আঁকার জন্য পেনসিল ব্যবহার করেন, এখানে আমাদের এআই অ্যালগরিদম শুধু সেই পেনসিলের কাজটা করছে। সেটা কীভাবে আঁকব বা কী আঁকা হবে, তা আমার ওপর নির্ভর করে। এখানে এআই আপনার হয়ে কাজ করে দিচ্ছে না। আসলে আপনাকেই ক্রিয়েটিভ হতে হবে। আমাদের কাজ এর অন্য লক্ষ্য ছিল সেই ক্রিয়েটিভ হওয়ার শুরুটা এটা হতে পারে। কারণ, সব মানুষই তো শিল্পী। আপনি, আমি—আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে শিল্পী। আপনার মন শিল্পমনা হলে আর কোনো বাধা থাকার আসলে কারণ নেই।
এআই কি শিল্পীদের বিকল্প হয়ে যাচ্ছে, নাকি শিল্পীরা এআইকে নিজেদের কাজে টুল হিসেবে ব্যবহার করছেন?
মইনুল জাবের: একটু প্রাচীনকালের কথা ভাবুন। চার্চে বা পাথরের দেয়ালে খোদাই করা যে আর্ট এখন আমরা দেখি, সেগুলো তো অনেক অনেক আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা এঁকে গেছেন। কিন্তু এখন তো আমরা ক্যানভাসে আঁকি। সেই দেয়ালে আঁকার ধারা ভেঙে যেখন প্রথম ক্যানভাসে আঁকা শুরু হলো, তখনও কিন্তু মানুষ এটাই বলেছে বা ভেবেছে যে আর্ট কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কারণ, ক্যানভাসের আঁকা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু দেয়ালের আঁকা তো আপনি চাইলেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন না কোথাও। তখন আর্টিস্টরাই প্রথমে বলেছিল, আমরা যারা দেয়ালে আঁকি, তাঁদের বিকল্প কি এই নতুন শিল্পীরা (যারা ক্যানভাসে আঁকে) হয়ে গেল? আসলে যখনই নতুন কিছু আসে, তখন আমাদের মধ্যে এই চিন্তাটাও আসে যে এটা আগেরটার জায়গা দখল করবে কি না।
আগুনের কথাই ধরুন। আগুন দিয়ে তো একটা বন সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলা যায়। আগুন যখন প্রথম আবিষ্কৃত হলো, তখন যদি কোনো আদিম মানুষ এসে বলত আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে ফেলা যায়, সুতরাং এটা আমরা তৈরি করব না। আমাদের ক্ষতি হবে তাতে। আমাদের সম্পূর্ণ পরিবার বা জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই তখনো এ কথা কেউ কেউ বলেছেন। কিন্তু তাঁদের কথা শুনে আগুন জ্বালানো বন্ধ করে দিলে আমরা এখন কোথায় থাকতাম, ভাবুন! আমি আসলে এখনো বর্তমানের এআইকে বুদ্ধিমত্তা বলেই মনেই করি না। এর জন্য যে গণিত রয়েছে, সেটা এখনো বুদ্ধিমান কোনো কিছু তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেনি। সে রকম গণিতই আমাদের নেই। ওই গণিত তৈরি হলে যে বুদ্ধিমত্তা তৈরি হবে, সেটাকে হয়তো আমরা শিল্পীর বিকল্প শিল্পী বা বুদ্ধির বিকল্প বুদ্ধি বলতে পারব। কিন্তু সেটা এত দ্রুত বলা সম্ভব নয়। বর্তমানে আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, যে এআই আমাদের আছে, সেটার মানুষের বিকল্প হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
বর্তমানে অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন জায়গায় এআই ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় আমাদের কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন?
মইনুল জাবের: প্রথমে আমাদের ভাবতে হবে, সবার জন্য এআই। মানে এআইয়ের কোনো বিকল্প নেই। তার মানে এটা নয় যে ক্লাস ওয়ান থেকে সবাইকে এআই ব্যবহার করতে হবে, প্রোগ্রামিং করতে হবে, কোডিং শিখতে হবে। আসলে আমাদের প্রযুক্তিগত একটা পরিবর্তন এসেছে। সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে নিজেদের। ক্রেন দেখলে কিন্তু মিস্ত্রি এখন ভয় পায় না যে আমার চাকরি এই ক্রেনের কারণে চলে যাবে। বরং সে খুশি হয় যে তার কষ্টটা আগের চেয়ে যোজন-যোজন কমেছে। আমাদের ভয় আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্রেন আমাদের চেয়ে বেশি কি না, সেটা নিয়ে! দেখা যায়, দাবা খেলতে গেলে আমরা চিন্তা করি, এআই বা কম্পিউটার আমার চেয়ে ভালো দাবা খেলতে পারে কি না। এবার আমার আর আপনার কথা চিন্তা করুন। আমাদের দুজনের মধ্যে কেউ একজন দাবায় একটু হলেও ভালো, আরেকজন একটু হলেও কম। এই যে আপনার চেয়ে আমার দাবা খেলার দক্ষতা কিছুটা হলেও কম, এটা নিয়ে কিন্তু আমাদের চিন্তা নেই। চিন্তাটা হচ্ছে এআইকে নিয়ে। তবে দাবা খেলার পারঙ্গমতা কিন্তু জটিল সমস্যার সমাধানএর নিয়ামক নয়। বিলিয়ন বিলিয়ন খেলার তথ্য থাকলে আর কম্পিউটিং ক্ষমতা থাকলে এটি করতে পারতে আমাদের বর্তমান গণিতজ্ঞান যথেষট । কিন্তু একটি ছোট্ট চড়ুই পাখি ওই ছোট্ট মগজ দিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আমাদের এআই সেটির জন্য তৈরি নয় ! কিন্তু এই অপরিপক্ব বিজ্ঞানকেও মানুষ নানা কাজে ব্যাবহার করছে। সুফল পাচ্ছে। নানা গড়বড় ও হচ্ছে। আসলে তুলনা করতে চাইলে আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন, কিন্তু সেটার ওপর ভিত্তি করে পলিসি তৈরি করা যায় না। আমাদের এখন বর্তমান চিন্তাটা করতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে ভাবতে হবে, আমাদের উন্নত দেশ হতে হলে প্রযুক্তির হাত ধরতেই হবে।
দেখুন, আমাদের জনবলের অভাব নেই। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে জনবল দক্ষ করা। আর সে জন্য তাদের প্রথমে এআই সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তারপর আমাদের সবার এ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একজনের কথা শুনেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব, তা নয়। বরং আমাদের নিজেদের আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এআইকে ভয় না পেয়ে বরং কীভাবে সবাই সব জায়গা থেকে ব্যবহার হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এ দেশে এখন যে এআই ব্যবহার করছি, এগুলোর ট্রেনইং ডেটা কিংবা অ্যালগরিদম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু আমাদের নয়। বিদেশি কোম্পানি আমাদের থেকে ডেটা নিয়ে অ্যালগরিদম বানিয়ে দেয়, আমরা শুধু সেগুলো ব্যবহার করি। কাজ কিছু হচ্ছে বাংলা ভাষার জন্য প্রযোজ্য সফটওয়্যার কিছু তৈরির চেষ্টা চলছে সফটওয়্যার কিন্তু আমাদের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি এমন কাজের জন্য তৈরিনা ।কারণ আমাদের সেরকম প্রশিক্ষিত লোকবল বা অর্থ নেই। গবেষণায় ঢালার মতো হাজার হাজার কোটি টাকা নেই। আমরা আসলে বিদেশি পাওয়ার হাউজগুলোর দাস হয়ে যাচ্ছি। সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সে ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি? এটা শুধু একজন ইঞ্জিনিয়ার বা একজন আর্টিস্ট করতে পারবে না। এটা একটা ইন্টারডিসিপ্লিনারি সিস্টেম। কারণ এআই সমাজের মানুষ ব্যাবহার করে, সবাইকে কানেক্ট (যুক্ত) করে। সমাজ আবার সমাজবিদ ভালো বোঝেন। মানে বলতে চাইছি, আপনাকে সব বিভাগের দক্ষ লোক নিয়ে কাজটি করতে হবে। কোনো একটা বিভাগের কাজ এটা নয়।
আমাদের আরও কিছু বিষয় বুঝতে হবে।বর্তমানের এই প্রযুক্তির বিপ্লব ভিন্নধরনের।ডটকম বিপ্লবের সময় সফটওয়্যার বিশ্বের সবখানে একি কাজই করত। ধরুন, ওয়ার্ড ফাইল। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও যা, আমাদের জন্যও তা-ই। একইভাবে কাজ করে। কিন্তু এআই তা নয়। আপনি এআইকে ইংরেজিতে একটা কমান্ড বা নির্দেশ দিলেন, এআই যত ভালোভাবে সেটা পালন করতে পারবে, বাংলায় তা পারবে না। একটা উদাহরণ দিই। ইংরেজিতে বললেন, আই লাভ ইউ। এর মানে কিন্তু একটাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু বাংলায় এটা আপনি কয়েকভাবে বলতে পারবেন। প্রত্যেকবার কিছুটা আলাদা অর্থ হবে। কোন শব্দে জোর দিচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করেও বদলে যায় অর্থ। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবাসি তোমাকে আমি—এই দুটির ভাব কিন্তু এক নয়। আবার অন্যভাবে বললে, এই শব্দের অদল-বদলে ভাব বদলে যাবে। কিন্তু ইংরেজিতে এ সমস্যা নেই। আই লাভ ইউ মানে এআই একটা জিনিসই বুঝবে। সুতরাং, বাংলা ভাষার এই ভাব ধরতে গেলে বাংলায় নির্দেশ দিলে সম্পূর্ণ মনের ভাব বুঝবে, এমন এআই লাগবে। তা না হলে আপনি মানুষকে কীভাবে সাহআয্য করবেন? সে জন্য আমাদের সে ধরনের মানুষ তৈরি করতে হবে।
এই শিল্প উপস্থাপনার এআই সিস্টেমটা তো আপনাদেরই তৈরি?
মইনুল জাবের: হ্যাঁ, সম্পূর্ণ কনসেপ্ট আমাদের নিজেদের তৈরি। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটা অ্যান্ড ডিজাইন ল্যাবে এটা করেছি।
এআই দিয়ে চাইলে তো আমরা এখন অনেক কিছুই করতে পারি বা করছি। সে ক্ষেত্রে কি আমাদের স্কিল বা দক্ষতা কমে যাচ্ছে? আমরা কি এআইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি?
মইনুল জাবের: দেখুন, মানুষের অনেক স্কিল থাকে। সেগুলো হয়তো সে সবটা সব সময় ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু কমন কিছু স্কিল সবার মধ্যে থাকে। প্রাচীনকালে সব শিশুই জানত (পাথরে পাথর ঘষে) কীভাবে আগুন জ্বালাতে হয়। একটা ষাঁড় সামনে চলে এলে কীভাবে সেটাকে সামলাতে হবে। কিন্তু আমরা আধুনিক হওয়ার পর ধীরে ধীরে কিছু স্কিল বা দায়িত্ব অন্যদের হাতে তুলে দিচ্ছি। যেমন পুলিশ আছে আমাদের নিরাপত্তার জন্য। আমরা ভাবি, কেউ আমাদের হঠাৎ আক্রমণ করতে পারবে না। আইন আছে, পুলিশ আছে। তারাই আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টা নিশ্চিত করবে। তাই আমরা রাস্তায় নির্ভয়ে চলাফেরা করি। এটা আমাদেরকে নিরাপত্তার একটা বোধ দেয়। বলা যায়, একরকম বিশ্বাস। তেমনি আপনাকেও প্রযুক্তিকে ওটুকু বিশ্বাস করতে হবে। নতুন প্রযুক্তি আসতেই থাকবে। সঙ্গে আমাদের অনেক স্কিলও বদলে যাবে। সেটার সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে।
ক্যালকুলেটরের কথা ভাবুন। আমরা এখন কিছু হিসেব করতে গেলেই ক্যালকুলেটর ব্যবহার করি। আমাদের বাবা-মা কিন্তু মুখেমুখেই হিসাব করতে পারেন। তেমনি আমাদের ছেলেমেয়েরাও ক্যালকুলেটর ব্যবহার না করে কম্পিউটার ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক। আসলে স্কিলের পরিবর্তন হতেই থাকবে। আপনি ব্যবহার করুন বা না করুন, সে সম্পর্কে জানতে হবে, সেই স্কিলটা আপনার থাকতে হবে।
একনজরে
নাম: মইনুল জাবের
বাবা: কাইয়ুম চৌধুরী
মাতা: তাহেরা খানম
স্ত্রী: মৃত্তিকা সহিতা
সন্তান: এক মেয়ে (রোহিণী)
প্রিয় বই: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান যাত্রী
প্রিয় লেখক: ফিয়েদর দস্তয়েভস্কি
আপনাদের এই ওয়ার্কশপ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মইনুল জাবের: আমরা আরও বড় করে এই প্রদর্শনী করতে চাই ভবিষ্যতে। আমাদের এই প্রকল্পের যে থিম, ‘মানুষের পরিচয় তার নামে নয়, পরিবেশের সঙ্গে তার সম্পর্কের ওপর’। পরিবেশ থেকে আমি কী নিই এবং নেওয়ার ফলে পরিবেশের কী হয়—এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা চাই, মানুষ ভাবুক। আমরা মানুষকে বোঝাতে চাই, আপনার পরিবেশের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই আপনার পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তন নিয়েই আপনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন। এই আইডিয়াটার অনেক সম্ভাবনা আছে। কারণ আমরা মনে করি, শিল্পের মাধ্যমে মানুষকে ডেটা, সমাজ ও পরিবেশ সচেতন করে তোলা সম্ভব। সে লক্ষ্যে এটা আমাদের প্রথম পদক্ষেপ । আমরা চাই, আমাদের সঙ্গে আরও নতুন মানুষ আসবে, কাজ করবে। শুধু কিছু কপি করা যাবে না। নতুন আইডিয়া নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।
বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর-তরুণ। তাদের উদ্দেশে কিছু বলেন।
মইনুল জাবের: সবার মধ্যেই অনেক রকম স্বপ্ন থাকে। যে স্বপ্নই থাকুক না কেন, শিল্পমনস্ক এবং বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। আর এ জন্য বিজ্ঞানী হতে হবে না, শিল্পীও হতে হবে না। আবার উল্টোটাও হয়। অনেকে শিল্পী বা বিজ্ঞানী হয়েও শিল্পমনষ্ক এবং বিজ্ঞানমনস্ক হন না। মাথায় রাখতে হবে, যা-ই করি না কেন, আমাদের জিজ্ঞাসার চর্চা করতে হবে। পৃথিবীকে কিছু দিতে চাইলে বা পৃথিবী থেকে কিছু নিতে চাইলে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার বিকল্প নেই।