ঘটনার শুরু হয়েছিল একটা ছোট্ট টুইট থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছিল, পিডিএফ ফাইলের সর্বোচ্চ আকার নাকি ৩৮১ বর্গকিলোমিটার। এই আকার প্রায় জার্মানির অর্ধেকর সমান বা আইওয়া অঙ্গরাজ্যের সমান (যদিও জার্মানির আয়তন এর চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার বর্গকিলোমিটার)। বহু বছর ধরে এই অদ্ভুত তথ্যটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছিল। কিন্তু একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করলেন সফটওয়্যার ডেভেলপার অ্যালেক্স চ্যান। তিনি ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর চ্যানের সেই সামান্য কৌতূহলই শেষ পর্যন্ত রূপ নিল এক অবিশ্বাস্য আবিষ্কারে। তিনি তৈরি করে ফেললেন এমন এক পিডিএফ ফাইল, যা পুরো দৃশ্যমান মহাবিশ্বের চেয়েও বড়! সে গল্পটাই বলছি।
পিডিএফ বা পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাট আমরা কমবেশি সবাই ব্যবহার করি। ১৯৯৩ সালে অ্যাডোবির জন ওয়ারনক এই ফরম্যাটটি তৈরি করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জটিল এক সমস্যার সমাধান করা। ওয়ারনক বিভিন্ন কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের বিকৃতি দেখে হতাশ হয়েছিলেন। তিনি এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন যাতে ডকুমেন্টগুলো প্রিন্টে বা স্ক্রিনে একই রকম দেখাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির এক রেস্তোরাঁর ন্যাপকিনের ওপর তিনি তার ধারণাটি স্কেচ করেন। নাম দেন ‘ক্যামেলট প্রজেক্ট’। দুই বছরের মধ্যেই এটি পিডিএফে রূপান্তরিত হয় এবং জন্ম নেয় অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাট।
কোড ব্যবহার করে হাতে পিডিএফ ফাইল সম্পাদনা করে তিনি অ্যাক্রোব্যাট রিডারের সেই বাঁধাধরা নিয়ম ভাঙতে শুরু করলেন। অ্যাক্রোব্যাটের যে সীমাবদ্ধতা তা অ্যাপলের প্রিভিউ অ্যাপে ছিল না।
তবে শুরুতে পিডিএফ জনপ্রিয় হয়নি। কারণ, ফাইলগুলো ছিল বেশ ভারী। আর ১৯৯০-এর দশকের বড় ফাইল আপলোড বা ডাউনলোড করতে অনেক সময় লাগত। ফলে সুবিধার চেয়ে মানুষ অসুবিধায় বেশি পড়তেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবায় ট্যাক্স জমা দেওয়ার জন্য পিডিএফ ফাইল বেছে নিল, তখন এই ফরম্যাটের সাফল্য আসে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বাধ্য হয়ে পিডিএফ ব্যবহার শুরু করে। ২০০৮ সালের পর থেকে এই ফরম্যাটের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে।
বর্তমানে শিল্পী থেকে শুরু করে নভোচারী—সবাই পিডিএফ ব্যবহার করেন। শুধু ২০২৩ সালেই ২.৫ ট্রিলিয়ন পিডিএফ ডকুমেন্ট তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ পিডিএফ সাধারণ আকারের হলেও অ্যালেক্স চ্যান আবিষ্কার করলেন নতুন ধরনের ফরম্যাট। যে ফরম্যাটের কোনো সীমা নেই।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ৩৮১ কিলোমিটারের সীমা। আসলে অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাট রিডারের কিছু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। এটা তেমন একটা সীমা। মানে ৩৮১ বর্গকিলোমিটারের বেশি আকারের পিডিএফ ফাইল অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাটে তৈরি করা যায় না। অ্যাক্রোব্যাটের পিডিএফ দৈর্ঘে-প্রস্থে ১৫ মিলিয়ন ইঞ্চি বা ৩৮১ কিলোমিটারের বেশি হতে পারে না।
১৯৯৬ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবায় ট্যাক্স জমা দেওয়ার জন্য পিডিএফ ফাইল বেছে নিল, তখন এই ফরম্যাটের সাফল্য আসে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বাধ্য হয়ে পিডিএফ ব্যবহার শুরু করে।
কিন্তু অ্যালেক্স চ্যান এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি দেখলেন, এখানে যে যে সীমাবদ্ধতার কথা বলা হচ্ছে, তা অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাটের, পিডিএফ ফরম্যাটের নয়। তিনি পরীক্ষা শুরু করলেন। কোড ব্যবহার করে হাতে পিডিএফ ফাইল সম্পাদনা করে তিনি অ্যাক্রোব্যাট রিডারের সেই বাঁধাধরা নিয়ম ভাঙতে শুরু করলেন। অ্যাক্রোব্যাটের যে সীমাবদ্ধতা তা অ্যাপলের প্রিভিউ অ্যাপে ছিল না। মানে প্রিভিউ অ্যাপে যত বড় ইচ্ছা ফাইল বানানো যায়। এবার অ্যালেক্স সত্যিকারের জার্মানির চেয়েও বড় আকারের পৃষ্ঠা নিলেন। ধীরে ধীরে বাড়াতে শুরু করলেন তাঁর পিডিএফ ফাইলের আকার। শীঘ্রই তার ডকুমেন্ট এক ট্রিলিয়ন ইউনিট চওড়া হয়ে গেল। এক ট্রিলিয়ন ইউনিট মানে প্রায় ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭৭৮ কিলোমিটার (প্রতি ইউনিট ১/৭২ ইঞ্চি ধরে)। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে প্রায় চাঁদের দূরত্বের সমান।
কিন্তু এখানেই থামলেন না চ্যান। তাঁর পরীক্ষা চালিয়ে গেলেন। এরপর তিনি যে পিডিএফ ফাইলটা তৈরি করলেন, সেটির আকার প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ বর্গক্ষেত্র। যদিও এই ফাইলের বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা, কিন্তু তিনি তৈরি তো করেছেন। এ ব্যাপারে অ্যালেক্স চ্যান বলেন, ‘স্বীকার করতেই হবে এর বেশির ভাগটাই ফাঁকা জায়গা, তবে মহাবিশ্বও তাই।’
আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। আর অ্যালেক্সের বানানো পিডিএফ ৩৭ ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ বর্গক্ষেত্রে। এই পিডিএফ ফাইলের তুলনায় দৃশ্যমান মহাবিশ্ব অনেক ছোট।
তবে অ্যালেক্স চ্যান মজার ছলে সতর্ক করে বলেছেন, ‘দয়া করে এটি প্রিন্ট করার চেষ্টা করবেন না। কারণ, সম্ভবত মহাবিশ্বের কাছেও এত কালি নেই!’
